প্রস্তুতিহীন অপারেটর মান কমছে সেবার

নিজস্ব প্রতিবেদক

কভিড-১৯-এর সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে দেশে লকডাউন বা অবরুদ্ধ অবস্থা চলছে। এতে ঘরবন্দি বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ। এমন অবস্থায় সেলফোন ইন্টারনেট সেবার ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে কয়েক গুণ। দেশেও এর প্রভাব পড়েছে। গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে ডাটাভিত্তিক সেবার ব্যবহার ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে কমেছে সেবার মান। বাড়তি চাপের কারণে সেবার মানের ওপর প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছে অপারেটরগুলো। যদিও অপ্রস্তুত অপারেটরদের কারণেই এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, সাধারণ ছুটিতে রাজধানী ঢাকা ছেড়েছে কোটির বেশি মানুষ। আবার ঘরবন্দি মানুষের ডাটার চাহিদাও বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েক গুণ। সব মিলিয়ে নেটওয়ার্কের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে তা সেবার মানের ওপর প্রভাব ফেলছে। কল ড্রপ, ইন্টারনেটের কাঙ্ক্ষিত গতি না পাওয়ার মতো অন্যান্য সমস্যায় পড়তে হচ্ছে গ্রাহকদের।

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা সোহেল আহমেদ বেসরকারি একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা। সাধারণ ছুটিতে বাসা থেকেই অফিসের কাজ করতে হচ্ছে তার। তিনি জানালেন, নেটওয়ার্কের সমস্যার পাশাপাশি ডাটা সেবার মানও নিম্নগামী হয়েছে।

অ্যামটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম ফরহাদ (অব.)  বলেন, হঠাৎ করে দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী শহর থেকে গ্রামে চলে যাওয়ায় মোবাইল নেটওয়ার্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। অপারেটররা গ্রাহকদের কথা বিবেচনা করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেটার মূল্য কমিয়ে বেশি ডেটা দেয়ায় এর ব্যবহার বেড়ে যায়। এছাড়া গ্রাহকরা অফিস, ব্যবসা, শিক্ষা, বিনোদন এবং অন্যান্য অনেক কাজ ঘরে বসে অনলাইনে করছেন, যে কারণে ইন্টারনেটের ওপর চাপ বাড়ছে। আমরা জানি, বাংলাদেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মোবাইলের ওপর নির্ভর করে, যার জন্য পর্যাপ্ত ব্যান্ডউইডথ প্রয়োজন। তবে ইচ্ছা প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত দামের কারণে অপারেটররা স্পেকট্রাম বরাদ্দ নিতে পারেনি। সামগ্রিকভাবে উপরোক্ত কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইন্টারনেটের গতি হ্রাস পাচ্ছে।

এদিকে গ্রাহকের তুলনায় তরঙ্গও তুলনামূলকভাবে কম শীর্ষ তিন অপারেটরের। গ্রামীণফোনের প্রতি মেগাহার্টজ তরঙ্গের বিপরীতে সাড়ে ২০ লাখ, রবির সাড়ে ১৩ লাখ বাংলালিংকের সাড়ে ১১ লাখ গ্রাহককে সেবা দিতে হচ্ছে। যদিও গ্রাহককে মানসম্পন্ন সেবা দিতে এটি - লাখ হওয়ার কথা বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার সংকটকালীন পরিস্থিতিতে তিন মাসের জন্য বিনা মূল্যে তরঙ্গ দিতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে আবেদন করেছে তিন অপারেটর। এদিকে অপারেটররা দাবি করছে, এক বছরের বেশি সময় ধরে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের সুযোগ পায়নি তারা। নিরীক্ষা আপত্তির কারণে দুই শীর্ষ অপারেটরের অনাপত্তি বন্ধ ছিল সময়জুড়ে।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় গ্রাহকসংখ্যা বিবেচনায় সেবার মান অক্ষুণ্ন রাখতে অপারেটরদের জন্য পর্যাপ্ত তরঙ্গ বরাদ্দের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলমও। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রাহক সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে অনুরোধ করে আসছি যেন তরঙ্গের মূল্য কমানো হয়, যাতে আমরা প্রয়োজনীয় তরঙ্গ কিনতে পারি। পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর সরকার বিটিআরসির কাছে আমরা আবেদন করেছি, যাতে মূল্য ছাড় দিয়ে আমাদের বাড়তি তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়। আবেদন এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এখানে একটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে, অনুরোধটি করা হয়েছিল স্বাভাবিক সময়ে।

বর্তমান করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে আবেদন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে উল্লেখ করে শাহেদ আলম বলেন, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে মুহূর্তে বেশি মাত্রায় গ্রাহকরা ডিজিটাল জীবনধারা অনুসরণ করে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করছেন। লকডাউন পরিস্থিতিতে আমাদের নেটওয়ার্কে ডাটা ট্রাফিক বৃদ্ধি পেয়েছে ২০-২৫ শতাংশের মতো। পরিস্থিতিতে বাড়তি স্পেকট্রাম ছাড়া গ্রাহকদের জন্য মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বৃহত্তর স্বার্থে তাই আমরা সরকারের কাছে তিন মাসের জন্য বিনা মূল্যে বাড়তি তরঙ্গ বরাদ্দের অনুরোধ জানিয়েছি। তরঙ্গ বরাদ্দ পেলে আগামী সাতদিনের মধ্যে সেবার মান আমরা বাড়াতে পারব। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার আমাদের আবেদনে ইতিবাচক সাড়া দেবেন বলে আমরা আশাবাদী।

হংকংভিত্তিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান ওপেন সিগন্যালের তথ্য বলছে, ২৭ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে ফোর-জি ইন্টারনেট সেবার গড় ডাউনলোড গতি ছিল মেগা বিটস পার সেকেন্ড (এমবিপিএস) মার্চের পর থেকে গতি কমতে থাকে। মার্চ শেষে গড় ডাউনলোড গতি দশমিক এমবিপিএসে এসে দাঁড়িয়েছে।

বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি আংকিত সুরেকা বলেন, গ্রাহকপ্রতি সর্বোচ্চ তরঙ্গ রয়েছে বাংলালিংকের। আর তাই মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিতে আমরা এগিয়ে। বাংলালিংকের গ্রাহকদের সেবার মান নিয়ে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।

বিটিআরসির তথ্যমতে, গত ফেব্রুয়ারি শেষে দেশে সেলফোন সংযোগসংখ্যা ১৬ কোটি ৬১ লাখ ছাড়িয়েছে। আর ইন্টারনেট সেবার সংযোগ রয়েছে কোটি ৯৯ লাখ ৮৪ হাজার। এর মধ্যে সেলফোন অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবার আওতায় থাকা সংযোগই কোটি ৪২ লাখ ৩৬ হাজার।

ডাক টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বণিক বার্তাকে বলেন, অবস্থা যে এখনকার, তা নয়। সেবার মান নিয়ে কখনই গুরুত্ব দেয়নি অপারেটররা। ন্যূনতম প্রস্তুতিও ছিল না তাদের। থাকলে এখন অবস্থা তৈরি হতো না। তরঙ্গ কেনার বিষয়ে অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। মূলত মুনাফার বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দেয়ার কারণে তরঙ্গ কেনার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেনি তারা। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনা মূল্যে দেয়ার প্রশ্নই আসে না। কভিড-১৯ সংকট শেষে শিগগিরই অব্যবহূত তরঙ্গের পাশাপাশি ফাইভজি তরঙ্গের নিলাম হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন