চীনা নববর্ষ শুরুর ঠিক পাঁচদিন আগে বেইজিং কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত উহান থেকে উদ্ভূত করোনাভাইরাসকে মহামারী হিসেবে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
কারণ উহানের পৌর সরকার প্রাথমিকভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার তথ্য প্রকাশ না করার পাশাপাশি এটির বিস্তার রোধে ব্যর্থ হয়।
এদিকে গত ২৩ জানুয়ারি উহানকে সরকারিভাবে বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ ঘোষণার আগেই শহরটির বাসিন্দা ও অস্থায়ী কর্মী মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোক লুনার নববর্ষের ছুটি কাটাতে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
ফলে চীন ও চীনের বাইরে বিভিন্ন স্থানে খুব দ্রুত ভাইরাসটি বিস্তার লাভ করে, যা বর্তমানে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা ডেকে এনেছে।
স্বাভাবিকভাবেই চীনের অর্থনীতি ধীরগতির সম্মুখীন।
দেশটির জিডিপিতে খুচরা ব্যবসা, পর্যটন, হোটেল ও পরিবহনের মতো পরিষেবা খাতগুলোর অংশগ্রহণ অর্ধেকের বেশি হলেও বর্তমানে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে।
খাতগুলোয় এমন অবস্থা বজায় থাকলে অচিরেই তা উৎপাদনকে প্রভাবিত করবে।
তাছাড়া ভাইরাসটির ক্রমবর্ধমান ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি ঘিরে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাণিজ্যের ওপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষের চলাচলও সীমিত করেছে।
এখন মূল প্রশ্নটি হচ্ছে, আমরা কি বিশ্বাস করি যে ভাইরাসটি আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে?
আমার জবাব হচ্ছে, না। করোনাভাইরাস মহামারীর স্থায়িত্ব বেশি দিন হবে না। বিভিন্ন সমস্যা সত্ত্বেও যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে নিজেদের সর্বশক্তিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে জড়ো করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে চীনের। উদাহরণস্বরূপ, গত দুই সপ্তাহ জনসাধারণের আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বোচ্চ সরকারি প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। দেশব্যাপী চিকিৎসাকর্মী ও সংস্থাগুলোকে (সামরিক বাহিনীসহ) একত্র করার আদেশ দেয়ার পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার জন্য বড় বড় হাসপাতালের দক্ষতা মূল্যায়ন করে চলেছে। অরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, গত ২০ জানুয়ারি ঘোষিত জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ অভিযানের অংশ হিসেবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় উহানে যাতায়াতকারী নাগরিকদের কর্মকর্তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও শনাক্ত করছেন।
এরই মধ্যে শহর ও গ্রামীণ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অপ্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও চলাফেরা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অস্থায়ী রেশন ব্যবস্থার অধীনে ফেসমাস্ক বিতরণ করা হচ্ছে ব্যক্তি ও পরিবারগুলোর মধ্যে।
ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, বন্ধ রয়েছে স্কুলগুলো।
করোনাভাইরাস মহামারী যেহেতু মানুষের সংস্পর্শে ছড়ায়, তাই ওই পদক্ষেপগুলো ভাইরাসটির বিস্তার রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।
আসছে সপ্তাহে জোর সম্ভাবনা রয়েছে সংক্রমণের পরিমাণ অনেকটাই কমে আসার।
তাছাড়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রভাব পরিমাপের জন্য এখনো সঠিক সময় আসেনি।
যা-ই
হোক, এখানে মূল বিষয়টি কিন্তু মহামারীর পরিধি বা প্রবলতা নয়, বরং এর সময়কাল।
মহামারীটি যত তাড়াতাড়ি শেষ হবে, চীনের অর্থনীতি তত দ্রুতই পুনরুজ্জীবিত হবে; বৃদ্ধি পাবে প্রবৃদ্ধির প্রবণতাও।
যদিও কঠোর নিয়ন্ত্রণ বর্তমান অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে দুর্বল করবে, তবে এটি মহামারীর প্রকোপ থামাতে সাহায্য করতে পারে।
তত্ত্বগত ও অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বলতে পারি মহামারী কেবল স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দার কারণ হতে পারে।
তাছাড়া বলা যায়, বাহ্যিক অভিঘাতগুলো চীনের অর্থনীতি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি প্রবণতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে না।
করোনাভাইরাসের ঝড়ো প্রাদুর্ভাব থেমে গেলে অর্থনীতির গতি ফিরে আসবে এবং প্রবৃদ্ধি আগের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করবে।
আমরা যদি ২০০৩ সালের কথা মনে করি, তাহলে দেখতে পাই বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ ও গবেষক অনুমান করেছিলেন যে সার্সের প্রাদুর্ভাবে চীনের দ্বিতীয় প্রান্তিকের জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় এক-পঞ্চমাংশে হ্রাস পাবে।
তবে সার্স সংক্রমিত সীমিতসংখ্যক অঞ্চল ও খাতগুলোয় ওই পূর্বাভাসের প্রতিফলন ঘটলেও ভাইরাসটির স্থায়িত্ব তিন মাসের বেশি হয়নি।
সার্সের প্রভাবে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রত্যাশার চেয়ে ২ শতাংশ কম হয়।
সে
সময় চীনের অর্থনীতি বার্ষিক প্রায় ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্সের প্রভাবের বিপরীতে পরবর্তীতে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দ্রুত ভারসাম্য স্থাপন সম্ভব হয়।
তাই ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল হিসাব করে চীনের যে প্রবৃদ্ধির গ্রাফ তৈরি করা হয়, সেখানে সার্সের প্রভাব তেমন চোখে পড়ে না।
করোনাভাইরাসের মাত্রা সার্সের ভয়াবহতাকে ছাড়িয়ে গেলেও মূল বিষয় হচ্ছে এর স্থায়িত্ব।
ভাইরাসটি চীনা অর্থনীতিকে কতটা কাবু করতে সমর্থ হবে, তা নির্ভর করে এটি কতদিন ধরে বিস্তার লাভ করবে তার ওপর।
বর্তমান তথ্যগুলো তুলে ধরে, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে করোনাভাইরাসটি শেষ সীমায় পৌঁছে যাবে।
যার মানে, প্রথম তিন মাসের মধ্যেই করোনাভাইরাসকে বশে আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা ২০২০ সালের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির ওপর ভাইরাসটির প্রভাব হ্রাসের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এটা ঠিক, গত কয়েক বছর চীনের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের কিছু বেশি; যা সার্স প্রাদুর্ভাবের সময়কালীন প্রবৃদ্ধির তুলনায়ও কম।
তবে চীন সরকারের আর্থিক ও মুদ্রানীতির সমন্বয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পাশাপাশি পরিষেবা খাতগুলোকে করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বলিষ্ঠ পুনরুদ্ধারের নিশ্চয়তা দেয়।
আমার প্রাথমিক অনুমান অনুসারে, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি যদি তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে তৃতীয় বা অর্ধেকে হ্রাস করবে, যা ২০১৯ সালের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ২ থেকে ৩ শতাংশ কম।
তবে দ্বিতীয় প্রান্তিকে যদি বিষয়গুলোর অনুসন্ধান শুরু হয়, আসন্ন অভিঘাতটি আংশিকভাবে পতনের সমতাবিধান করবে এবং প্রয়োজনীয় সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির সমন্বয়ের মাধ্যমে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গতি যোগ হবে।
এক্ষেত্রে চীনের অর্থনীতির ওপর আর যদি কোনো ধরনের বাহ্যিক ধাক্কা না আসে, তাহলে অব্যাহত নীতি শিথিলকরণে পুরো বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৫ থেকে বড়জোর ১ শতাংশ হ্রাস পাবে।
যা
২০২০ সালে বছরজুড়ে ৫ থেকে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের ইঙ্গিত প্রকাশ করে, এটি এখনো চীনের প্রবৃদ্ধি প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তবে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয় যে, করোনাভাইরাসের মহামারী মোকাবেলায় ব্যস্ত চীন সরকার সে অনুযায়ী এ বছরের জন্য তাদের জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস করবে কিনা।
[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]
ঝাং জুন: ফুডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল অব ইকোনমিকসের ডিন, চীন সেন্টারে ইকোনমিক স্টাডিজের পরিচালক ও সাংহাইভিত্তিক চিন্তাবিদ
ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস