জগাখিচুড়ি একসময় আহার্যই ছিল, কিন্তু শিক্ষিতজনের পাল্লায় পড়ে জগাখিচুড়ি তার আহার্যগুণ হারিয়ে এক ধরনের বাজে শব্দালংকারে পরিণত হয়েছে। পুরী শহরে জগন্নাথ দেবের মন্দিরে হররোজ ভুখানাঙ্গা ভক্তদের মধ্যে যে খিচুড়ি বিতরণ হতো, এখনো হয় কারো কারো মতে, এটাই জগাখিচুড়ি। আবার জনৈক জগাই ব্রাহ্মণের রান্না করা চাল-ডালে মেশানো কমদামি খাবারটিই জগাখিচুড়ি।
জগ মানে হাতলওয়ালা গাড়। গাড় মানে নলযুক্ত পাত্রবিশেষ। তার মানে হাতলওয়ালা নলযুক্ত পাত্রবিশেষ। পানির জগ, তা হলে তো এটা ইংরেজি। এর সঙ্গে জগা কিংবা জগাইয়ের সম্পর্ক থাকার কথা নয়।
জগ-এর ভিন্ন মানে হচ্ছে জগৎ, ভুবন, বিশ্ব। এর সঙ্গে জগন্নাথের অবশ্যই সুসম্পর্ক রয়েছে বলেই জগন্নাথ মানে পৃথিবীর প্রভু, পরমেশ্বর, বিষ্ণু, শ্রীকৃষ্ণ ইত্যাদি। জগদ্দল মানে পৃথিবী দলন করতে পারে, এমন। এত ভারী যে নড়ানো যায় না, এমন কিছু।
জগা মানে তাহলে কী? জগতে যা কিছু আছে সব? সংসদ বাংলা অভিধানে জগাখিচুড়ির দুটি মানে: বিবিধ শাকসবজি দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি কিংবা বিভিন্ন প্রকার বস্তুর সংমিশ্রণ; বাংলা একাডেমির অভিধানও তাই বলে; হাবিবুর রহমান যথাশব্দে যোগ করেছেন গোঁজামিল। বৃষ্টির দিন ভুনাখিচুড়ি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার কথা শুনেছি, কিন্তু খরাতেই হোক কি বর্ষণের দিনেই হোক জগাখিচুড়ি খেয়ে অফিসে এসেছেন, এমন শুনিনি।
রবীন্দ্রনাথের
খিচুড়ি
এটি ভোজ্য নয়, পাঠ্য। ক্ষুধিত
পাষাণ গল্পের লেখক এবং তার আত্মীয় পুজোর ছুটিতে দেশ ভ্রমণ করে যখন কলকাতায় ফিরছিলেন, তখন রেলে যে বাবুটির সঙ্গে দেখা, তাকে পশ্চিমাদেশীয় মুসলমান মনে হয়েছিল, এটা ছিল ভ্রম। তার সঙ্গে কথাবার্তায় তাদের ধাঁধা লেগে যায়।
পৃথিবীর সব বিষয়ই এমন করিয়া আলাপ করিতে লাগিলেন, যেন তাহার সহিত প্রথম পরামর্শ করিয়া বিশ্ববিধাতা সকল কাজ করিয়া থাকেন। বিশ্বসংসারের ভিতরে ভিতরে যে এমন সকল অশ্রুতপূর্ব নিগুঢ় ঘটনা ঘটিতেছিল, রুশিয়ানরা যে এতদূর অগ্রসর হইয়াছে, ইংরেজদের যে এমন সকল গোপন মতলব আছে, দেশীয় রাজাদের মধ্যে যে একটা খিচুড়ি পাকাইয়া উঠিয়াছে—এ সমস্ত কিছুই না জানিয়া আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হইয়া ছিলাম।
রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি উপন্যাস থেকে:
‘কোনদিন বাদলার একটু বিশেষ লক্ষণ দেখা দিলেই হেমনলিনীদের ঘরে প্রাতকালে রমেশের খিচুড়ি এবং অপরাহ্নে ভাজাভুজি খাইবার নিমন্ত্রণ জুটিত।’
চিত্র দেবের ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে অনেকবার খিচুড়ি প্রসঙ্গ উঠেছে, এটা ভোজ্য খিচুড়ি, উপমার জগাখিচুড়ি নয়।
সারদা
দেবীর খিচুড়িসেবা
সারদা দেবী পিতৃগৃহে ফিরে এলেন। ১৮৬৪-৬৫-এর করাল দুর্ভিক্ষের সময় রামচন্দ্র তার মরাই-এ জমানো ধান থেকে অন্নসত্র খুলেছিলেন। গরম খিচুড়ি ক্ষুধার্ত মানুষের পাতে ঢালা হলে সারদা পাখার বাতাস করে সেই খিচুড়ি ঠাণ্ডা করে দিতেন।
কাজী
নজরুলের খিচুড়ি
খিচুড়ি যে কাজী নজরুলের গানেও থাকবে, এটা যেন জানাই।
মালবশ্রী রাগে তার কাওয়ালি:
জন্তুর মধ্যে ভাই উট খিচুড়ি
মদ খেয়ে সৃজিয়াছে স্রষ্টা-শুঁড়ি
দো-তালার উঁচু আর তে-তালার ফাঁক
ঢিমে তে-তালার ফাঁক
অষ্টবিক্রীয় দশটা বাঁক
হামা দিয়ে যেন তড়কা খুড়ি \
জিরাফের গলা তার ঘোটকিনী মুখ
আগাগোড়া গোঁজামিল বাঁদুরে ভালুক,
গাড়িকে এ গাড়ি বাবা জুড়িকে জুড়ি \
লাগিয়াছে দেহে গজ-কচ্ছপ রণ
কচ্ছপি পিঠ আর গজ-নি চরণ
আরবের হাজি মিয়া-বাপরে থুড়ি।
সুকুমার
রায়ের খিচুড়ি
খিচুড়ি কাব্যে শ্রেষ্ঠ কাজটি সম্ভবত সুকুমার রায়েরই। আবোল
তাবোল গ্রন্থের ‘