বেসিক ব্যাংক বন্ধের হুঁশিয়ারি অর্থমন্ত্রীর : পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারে না অর্থ মন্ত্রণালয়ও

বেসিক ব্যাংক আয়োজিত এক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বেশ কড়া ভাষায় বক্তব্য প্রদান করেছেন। তিনি লোকসানি শাখা বন্ধ করে দেয়াসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কমিয়ে আনার কথাও বলেছেন। শতভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক একসময় ছিল লাভজনক। কিন্তু হঠাৎ করে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মতো এটিও লোকসানি হয়ে পড়ে। কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো, তা কারো অজানা নয়। নামে-বেনামে দলীয় বিবেচনায় ঋণ প্রদান করে ব্যাংকটি আজ খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত। বলা বাহুল্য, বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতি সম্পর্কে গণমাধ্যমে কয়েক বছর ধরে লেখালেখি হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে শুধু বেসিক ব্যাংক নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিটি ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠান অর্থ লোপাটের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। ব্যাংকটি পুনর্গঠনের চিন্তা করা হয়েছিল ২০১৪ সালে। এর মধ্যে পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো উন্নতি হয়নি, বরং খারাপ হয়েছে। যদিও অন্যান্য ব্যাংকের চেয়ে সুযোগ-সুবিধা ও বেতন কাঠামো দ্বিগুণ। এটি কমিয়ে আনার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বড় কর্মকর্তাদের গাফিলতির দায় কেন কর্মচারীরা বহন করবেন? অর্থ মন্ত্রণালয়ই তো এর চেয়ারম্যানকে নিয়োগ দিয়েছিল, যার নির্দেশে আইন অমান্য করে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ফলে বেসিক ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারে না অর্থ মন্ত্রণালয়ও। 

বেসিক ব্যাংকের অর্থ লুটপাটের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ভুয়া ডকুমেন্ট দিয়ে ঋণগ্রহীতা সবাইকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে কেবল বেসিক ব্যাংক নয়, সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা ও কৃষি ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং ঋণখেলাপিদেরও বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক, অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার চেয়েও ছাড় দেয়ার মানসিকতাই আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইন ও বিধি অনুযায়ী কোনো অভিযোগ অনুসন্ধান করতে হয় ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে। আর মামলা দায়েরের পর তদন্ত শেষ করতে হয় মোট ১৮০ দিনে। কিন্তু বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির তদন্ত সাত বছরেও শেষ করতে পারেনি দুদক। এতে অপরাধীরা আরো উৎসাহিত হচ্ছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া, উচ্চ আদালতে রিট, সর্বোপরি বিচার না হওয়ার কারণেই শেয়ারবাজার, হলমার্ক, যুবক ও ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানে বড় বড় অর্থ আত্মসাৎ ও ঋণখেলাপির ঘটনা ঘটেছে। এমনকি নিয়ন্ত্রক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বলতা, রাঘববোয়ালদের বাঁচাতে উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ এবং তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় আর্থিক খাতের লুটেরারা উৎসাহিত হচ্ছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া অর্থ আত্মসাৎ সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজপত্র ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে মোটা অংকের ঋণ দেয়াই এর প্রমাণ। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সম্পদ জব্দ করে জনগণের শ্রম-ঘামের আমানত উদ্ধার করতে হবে। শাখা বা ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া কোনো সমাধান নয়, এতে আমানতকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। লাভবান হবেন ঋণখেলাপিরা। ফলে অর্থমন্ত্রীর প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।

বেসিক ব্যাংকের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঋণ কেলেঙ্কারি, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংকের নজরকাড়া অনিয়ম, এনআরবিসি ব্যাংকের দৃশ্যমান অনিয়মসহ যাবতীয় বিপর্যয় ব্যাংকিং খাতকে অস্থির করে তুলেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এর কোনোটিরই তদন্ত হয়নি, বিচার হয়নি। বরং পুরনো ঋণখেলাপিদের শাস্তি না দিয়ে বিরামহীনভাবে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। যেন ঋণখেলাপি হওয়ার জন্যই এ পুরস্কার! খেলাপি ঋণ কম দেখাতে প্রতিনিয়ত পুনঃতফসিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে ব্যাংকগুলো। ঋণখেলাপিদের বাঁচাতে যারা একের পর এক ছাড় দেয়ার আত্মঘাতী নীতি গ্রহণ করেছে, তাদের সঙ্গে খেলাপিদের যোগসাজশের সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। অন্যদিকে যাদের টাকায় ব্যাংক চলে, সেই সাধারণ গ্রাহকরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছেন।

সরকারের উচিত ব্যাংকগুলোকে সঠিক আইন ও নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা। ব্যাংকিং খাতকে সঠিক লক্ষ্যে পরিচালিত করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ক্ষমতায়িত ও দক্ষ করতে হবে। ব্যাংকগুলোয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। এ খাতের নিয়ন্ত্রণ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশনের অধীনে না রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনস্থ করতে হবে। ঋণ প্রদান, পাওনা আদায়, সুদ আরোপ, গ্রাহকের শর্ত পালন না করা ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ও বিধি অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থঋণ মামলা যথাযথভাবে তদারক ও নিরবচ্ছিন্নভাবে অনুসরণ করতে হবে। খেলাপি ঋণসহ অন্য যেসব অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে, তার রাশ টেনে ধরতে হবে। যেসব উদ্যোক্তা ও পরিচালক দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব কাম্য নয়। আমরা আশা করব, ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং তা তদারকির জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে অতি দ্রুত একটি নিয়ন্ত্রক কমিশন গঠন করা হবে এবং সমস্যা নিরসনে ওই কমিশনকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেয়া হবে।

আমরা মনে করি, খেলাপি ঋণের ভয়াবহ বৃদ্ধির কারণ শুধু ব্যাংকের দুর্বলতা নয় অথবা খেলাপি ঋণ আদায়ে বড় বাধা আইনি দুর্বলতা নয়। খেলাপি ঋণের অবাধ বৃদ্ধি এবং ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের শক্তিশালী অবস্থান ও বৃদ্ধির আরো কারণ হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিছু নীতি, পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত ও ব্যাংকিং ডিভিশনের অবস্থান; ঋণখেলাপিদের অব্যাহতভাবে সুবিধার পর সুবিধা দেয়া। একসঙ্গে এবং সমন্বিতভাবে এসব কারণ দূর করা না হলে খেলাপি ঋণের দুষ্টচক্র থেকে ব্যাংক খাত বের হতে পারবে না। এজন্য সরকারকে পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন