প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন রুপান্তরের
পরামর্শ দিয়েছে ‘গণসাক্ষরতা অভিযান’। বুধবার
(২ অক্টোবর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার সব স্তরের
জন্য এ সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রেক্ষাপটে
‘বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষায় নিরবচ্ছিন্ন রুপান্তর: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শীর্ষক পলিসি
ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও এডুকেশন ওয়াচের সদস্য সচিব
রাশেদা কে চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস
অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদ, বিইউআইইডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইরাম মরিয়ম, নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপদেষ্টা জ্যোতি এফ গোমেজ, লালমাটিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আকমল হোসেন, বাংলাদেশ
প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি শাহিনুর আল আমিন, এডুকেশন ওয়াচের আহ্বায়ক ড. আহমদ মোশতাক
রাজা চৌধুরী প্রমুখ।
দুই বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে দুটো পরামর্শ দেয়া হয়। প্রথমত,
প্রাক-শৈশবকালীন এ শিক্ষাকে যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক এবং বাধ্যতামূলক করে একে একটি
স্বতন্ত্র কাঠামো হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি এবং এ লক্ষ্যে
শিক্ষকসহ প্রয়োজনীয় জনবল ও সমন্বিত নীতির আলোকে প্রাতিষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক যথাযথভাবে
প্রস্তুত করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, শিশুর জন্ম থেকে প্রারম্ভিক শৈশব বিকাশ কার্যক্রমের
সঙ্গে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ধারাবাহিকতা ও সংযোগ বজায় রাখতে হবে।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত একটি সামগ্রিক ও নিরবচ্ছিন্ন
রূপান্তরিত যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রস্তুতের কথা জানিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়ে
বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষাক্রমকে যোগ্যতার আধুনিক ধারণার ভিত্তিতে সাজাতে হবে।
যুগের প্রয়োজনে দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য সার্বিক প্রাথমিক
শিক্ষা কাঠামোয় রূপান্তর অপরিহার্য। শ্রেণীভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং স্কুলভিত্তিক
বার্ষিক পরীক্ষা সম্পাদনের জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রস্তুতি ও আনুষঙ্গিক প্রাতিষ্ঠানিক
ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কন্টেন্ট মুখস্থনির্ভরতা থেকে বের হয়ে সমস্যা-সমাধাননির্ভর
শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া এবং গাঠনিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্যতা পরিমাপ করা
সময়ের দাবি। ডিজিটাল সাক্ষরতা, মিডিয়া সাক্ষরতা, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন,
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার মতো দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাক্রম
প্রস্তুতির সময় জলবায়ু পরিবর্তন ও গ্রিন এডুকেশন, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন এবং শিক্ষায়
কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজনের মতো বিষয়াদি নিশ্চিত করতে হবে। আন্তঃবিষয়ক সমস্যা-সমাধান
এবং শ্রেণীকক্ষে প্রকল্পভিত্তিক শিখনের চর্চা করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। মূলধারার
শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো নমনীয় এবং শিক্ষার্থীবান্ধব করতে হবে।
উচ্চ মাধ্যমিকে বৈশ্বিক চাহিদাকে বিবেচনা করে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য
সুপারিশগুলো হলো, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যায়ে সব শিক্ষার্থীর
জন্য ‘ফাউন্ডেশনাল যোগ্যতা’ অর্জন করানোর নির্দেশক নির্ধারণ করা
হয়েছে। সে হিসেবে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ও নিরবচ্ছিন্ন
শিক্ষা রূপান্তর সময়ের দাবি। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন
শিক্ষা রূপান্তর নিশ্চিতে দুটি মন্ত্রণালয়ের বদলে একক মন্ত্রণালয়ের কাঠামো তৈরি করা
জরুরি। বিজ্ঞান শিক্ষাকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে সব বিদ্যালয়ে
যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষা অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। জীবিকা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সব শিক্ষার্থীর
জন্য নবম-দশম শ্রেণীতে বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাধ্যমিক শেষে যাতে ব্রিজিংয়ের মাধ্যমে
দক্ষতাভিত্তিক সার্টিফিকেট অর্জন করে শিক্ষার্থীরা যাতে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ বা পরবর্তী
দক্ষতা উন্নয়নের পর্যায়ে যেতে পারে সেজন্য আন্তঃবোর্ড সমন্বয় প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের
সঙ্গে সেবা, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, স্থানীয় সরকার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক
সর্ম্পক তৈরি করতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে একটি নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় এনে মূলধারার
শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
অনুষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার বিষয়ে বলা হয়, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের
প্রাথমিক কাজ হিসেবে ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। মুখস্থনির্ভর
লিখিত পরীক্ষার বদলে প্রবণতানির্ভর টেস্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও সক্ষমতা অনুযায়ী
উচ্চশিক্ষায় প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও গতানুগতিক কন্টেন্টনির্ভর কোর্সের
বদলে গবেষণানির্ভর, প্রয়োগমুখী, সমস্যা সমাধাননির্ভর আন্তঃবিষয়ক মাইক্রো-ক্রেডেন্সিয়াল
কোর্স চালু করা সময়ের দাবি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার মান
ও শ্রমবাজারের দাবি অনুযায়ী শিক্ষার সংস্থান জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে
ঢেলে সাজানো প্রয়োজন যাতে তারা মনিটরিং, রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট এবং মার্কেট বেসিস
ডিগ্রি/কোর্স প্রণয়নে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারে।
শিক্ষা প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের বিষয়ে পাঁচটি সুপারিশ তুলে
ধরা হয়। এগুলো হলো শিক্ষায় রূপান্তরের কাজটি যেহেতু প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে প্রযোজ্য
ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্নভাবে করতে হবে এবং উচ্চশিক্ষার সঙ্গেও সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে,
তাই পুরো কাজের সমন্বিত চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা বিষয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের বদলে
একটি একক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব প্রয়োজন। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ও গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে
এবং বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় শিক্ষা রূপান্তর কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে
প্রয়োজন হলে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ
শিক্ষা পর্যন্ত একটি নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা তথ্য ব্যবস্থাপনা ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে, যা
দেশের পরিকল্পনায় সহযোগিতা প্রদানের জন্য বৃহৎ তথ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনে কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের সামর্থ্য অর্জন করতে পারে। মানসম্মত শিক্ষক ছাড়া শিক্ষায় কোনো
উন্নয়নই টেকসই হবে না। এজন্য একটি ‘সমন্বিত জাতীয় শিক্ষক উন্নয়ন রূপরেখা’ প্রয়োজন,
যার মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশার জন্য প্রস্তুতি, নিয়োগ, পদোন্নতি, ক্ষমতায়ন, বেতন কাঠামো,
মান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। একইভাবে একটি স্বায়ত্তশাসিত কাঠামোর মাধ্যমে দেশের চাহিদা
বিবেচনায় বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় এবং বহুমুখী উপায়ে
মানবসম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে শিক্ষকের মান নিয়ে যথেষ্ট
উদ্বিগ্নতা রয়েছে। কাজেই অনেক শিক্ষক শিক্ষাক্রমের যেকোনো রূপান্তর বাস্তবায়ন করার
জন্য প্রস্তুত নন। তাই বছরব্যাপী হাইব্রিড ট্রেনিংয়ের আয়োজন করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের
সামাজিক মর্যাদা এবং বেতন বৃদ্ধির ব্যবস্থা খুবই জরুরি, কারণ শিক্ষায় যেকোনো সংস্কার
বাস্তবায়নে শিক্ষকের মোটিভেশনের কোনো বিকল্প নেই।
এ সময় আরো বলা হয়, ডিজিটাল রূপান্তরের অংশ হিসেবে একটি সমন্বিত ই-মনিটরিং
ব্যবস্থা চালু করা অতীব জরুরি। শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সব স্তরেই
কন্টেন্ট মুখস্থ করার বদলে জীবনের সমস্যা সমাধানে প্রকল্পভিত্তিক, অভিজ্ঞতাভিত্তিক
শিখন চালু করতে হবে। শিক্ষাক্রমের নিরবচ্ছিন্ন রূপান্তরের কাজ করতে হলে এনসিটিবির মতো
বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন চর্চাকে যেমন নিশ্চিত করা জরুরি, তেমনি এ প্রতিষ্ঠানের
কাজ শুধুই বুদ্ধিবৃত্তিক ও একাডেমিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য এর বই প্রিন্টিংয়ের
কাজটি আলাদা করে সরকারের প্রকাশনার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রেসগুলোকে ন্যস্ত করা দরকার।
দেশের সব এলাকায় শিশুদের জন্য মানসম্মত বিদ্যালয়-শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সংস্থানের
জন্য বিকেন্দ্রায়িত শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে স্বায়ত্তশাসিত
জেলা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠান পাইলট প্রকল্প হিসেবে কিছু নির্বাচিত জেলায় শুরু
করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য শিক্ষকতায় যোগ দেয়ার পূর্বে প্রাক-প্রশিক্ষণ এবং নিরন্তর
উন্নয়নের জন্য চাকরিকালীন প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য
বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো কার্যকরী করে তুলতে হবে। শিখন শেখানো প্রক্রিয়ায় অভিভাবক,
এলাকার লোকজনের অংশগ্রহণ বাড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষাকে জীবনমুখী করা প্রয়োজন। এর ফলে শিক্ষায়
অংশগ্রহণ এবং জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার্থীকে আশেপাশের মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া
করে শিখতে হলে কভিডকালীন সময়ে যে ডিভাইসমুখিতা তৈরি হয়েছিল তা থেকে বের হবার সুযোগ
সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি কোচিং গাইডের খরচ কমবে এবং লো কস্ট নো কস্ট শিক্ষা উপকরণের ব্যবহারকে
উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষার যেকোনো রূপান্তর বাস্তবায়নে সবসময়ই সবচেয়ে অবহেলিত দল হলেন
অভিভাবকরা। তাদেরকে এ পরিবর্তন সম্পর্কে সময়মতো কোনো ধারণা দেয়া হয় না। এর ফলে তারা
অন্ধকারেই থাকেন এবং তাদের উদ্বিগ্নতা বাড়ে। শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এবং ভবিষ্যৎ
পৃথিবীর জন্য তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অভিভাবকদেরকে স্বচ্ছ ধারণা প্রদান এর সঠিক বাস্তবায়নের
জন্য অতি জরুরি। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো সব অংশীজনকে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে
একটি সঠিক ধারণা প্রদান করা। এ বিষয়ে শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে
থাকলে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার সাধন কঠিন হয়ে পড়ে। কাজেই যেকোনো নতুন পদ্ধতি সহজ,
স্পষ্ট এবং বোধগম্য উপায়ে বাস্তবায়ন দরকার। যেহেতু গাইড বই ও কোচিং নির্ভরতা দেখা গেছে,
তাই শুরু থেকেই এ শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাত থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের
দায়িত্ব। সর্বোপরি, শিক্ষায় রূপান্তর নিশ্চিত ও টেকসই করতে জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ
বিনিয়োগের জোর দাবি জানানো হয়।