১৯ লাখ শিক্ষার্থীর অধিকাংশই বেকার

কর্মসংস্থান তৈরি ও কর্মমুখী শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া দরকার

ছবি : বণিক বার্তা

দেশে সরকারি-বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। এছাড়া দেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে। দেশের বৃহৎ শিল্পগুলো তাদের কারখানা বড় করেছে। এসব শিল্পে সেই অনুপাতে তৈরি হচ্ছে না কর্মসংস্থান। ফলে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকারী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকেই থাকতে হচ্ছে কর্মহীন। বিগত বছরগুলোয় এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। আবার কর্মসংস্থান সংকটের কারণে অনেকেই কম যোগ্যতার চাকরিতেও আবেদন করতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশের বেকারের সংখ্যা বাড়লেও শিল্প-কারখানার মালিকরা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কর্মী পান না। চাহিদা অনুসারে কর্মী গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের নেই তেমন ব্যবস্থা। আবার শিল্প-কারখানার চাহিদা অনুসারে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পাঠ্যক্রম তৈরিতেও কোনো গুরুত্ব দেয় না। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে যথাযথ পাঠ্যক্রম না থাকায় ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীকে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশই তরুণ। এসব তরুণকে অর্থনৈতিক শক্তি বোঝাতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যদিও তরুণদের এ আধিক্য সবসময় থাকে না। অনেক দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময়কাল বড় ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের হাতে আছে মাত্র একটি দশক। সরকারের সঠিক নীতি-পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর অনেকেই চাকরি না পেয়ে রাষ্ট্রের জন্য বড় বোঝা তৈরি হচ্ছে। বেকারত্ব নিরসনে দরকার দ্রুত কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষার বিকাশ। 

দেশে বেকার আছে কি নেই বা কর্মসংস্থানের বাস্তব অবস্থা কী—সেটা এখন বিতর্কের বিষয় নয়। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরির বিপরীতে আবেদনপত্রের সংখ্যা হিসাব করলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি পদের বিপরীতে অনেক প্রার্থীকে আবেদন করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, গত বছরের শেষ তিন মাস অর্থাৎ অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৩ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ১৫ লাখ ৭০ হাজার আর নারী বেকারের সংখ্যা ৭ লাখ ৮০ হাজার। ২০২২ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ১০ হাজার। এক বছরের ব্যবধানে সেই সংখ্যা বেড়েছে ৪০ হাজার। 

আনুষ্ঠানিক খাতে উপযুক্ত নতুন কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের শহরে বসবাস কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে তাদের শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। একসময় আর্থিক সংকট কাটাতে মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসত। সময়ের পরিক্রমায় পাল্টে যাচ্ছে এ দৃশ্যপট। দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় অনেকেই বিদেশমুখী হচ্ছেন। এটি দেশের টেকসই অর্থনীতির জন্য মোটেই ভালো দিক নয়।  বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে ১৩ দশমিক ৮ জন। আগের বছর এ হার ছিল ১০ দশমিক ৯। ২০২১ সালে প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে ৫ দশমিক ৯ জন। ২০২০ সালে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৪। ২০১৯ সালে প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে একজনেরও কম বা দশমিক ৭ জন।  অন্যদিকে গত বছর প্রতি হাজারে বিদেশে গেছে ৮ দশমিক ৭৮ জন। ২০২২ সালে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৬১। আগের বছর প্রতি হাজারে বিদেশে গেছে ৩ দশমিক শূন্য ৪ জন। ২০২০ সালে এ হার ছিল ১ দশমিক ৫৯ ও ২০১৯ সালে ছিল ২ দশমিক ৯৪।

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল পেতে হলে শ্রম ও বুদ্ধি দিয়ে কাজ করার পাশাপাশি কৌশল অবলম্বন করতে হবে বাংলাদেশকে। আর এটি আপনা-আপনি আসবে না। সেজন্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার দরকার। এখন শিক্ষা কমিশন গঠনের পরিবর্তে অ্যাকশন প্ল্যান এক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা হতে পারে। অ্যাকশন প্ল্যানের মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষাকে ভিন্ন ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। মানবসম্পদ তৈরির কথা যখন বলা হচ্ছে তখন শিক্ষার বিস্তার ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি সমার্থক নয়—এটা বাংলাদেশে খুব ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন খাতে এখনো বহু বিদেশী কাজ করছে। তরুণদের মেধা নেই, ব্যাপারটা তা নয়। বাংলাদেশের তরুণরা বিদেশে গিয়ে তারা খুব ভালো করছে। অর্থাৎ বিষয়টি মেধার অনুপস্থিতি নয়, বরং দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পদ্ধতির ঘাটতি। কেননা শিক্ষাকে আমরা কেতাবি ও সার্টিফিকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। এভাবে চলছে অকার্যকর শিক্ষা দান। এত কিছুর মধ্যে স্বদক্ষ হওয়ার অর্থাৎ নিজে নিজে শেখার প্রক্রিয়া পাশাপাশি চলছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। 

শিক্ষার মানোন্নয়ন বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এখান থেকে শ্রমবাজারে যাওয়ার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। কারণ এখনো আমাদের সেই সস্তা শ্রমের প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগোতে হচ্ছে। এগুলোয় আমরা কোনো পরিবর্তন আনতে পারিনি। তাই শিক্ষা বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সাহসী সংস্কারের চিন্তা করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমলাতান্ত্রিক ধারণা ফাইলবন্দি করে ফেলেছে। এর জন্য আমলারা দায়ী, বিষয়টি তা নয়। সমস্যা আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা। 

বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরে এমপিওভুক্তি ব্যবস্থা প্রথম শুরু হয়েছিল আশির দশকে। এটি একটি স্বল্পকালীন উদ্যোগ ছিল। এখন এটাই মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। ফলে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, তবে মানের অবনমন হয়েছে। এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও শিক্ষার মানের ঘাটতি লক্ষ করা যায়। এমপিওভুক্তি মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। এমপিওভুক্তির মাধ্যমে শিক্ষায় এক ধরনের রাজনৈতিকীকরণ ঘটেছে। স্কুল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে রাজনৈতিকীকরণের প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করেছে। ফলে শিক্ষার মানোন্নয়নের চেয়ে সরকারকে খুশি রাখতে ব্যস্ত থাকে শিক্ষক ও স্কুল কমিটি। এটি শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আবার এমপিওভুক্ত হতে সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হয়। তারা কোনো ধরনের জবাবদিহির ক্ষেত্র তৈরি করতে পারছে না। তাই এমপিও ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো গেলেও মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে এর সূত্র ধরে স্কুল পরিচালনায় আমলাতান্ত্রিকীকরণ ঘটেছে। এখানে শিক্ষকরা চালকের আসনে নেই, বরং শিক্ষা প্রশাসক চালকের আসনে বসেছেন। জাতীয়ভাবে কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষার যেসব চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। এটা করা না হলে তরুণ সমাজকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করা যাবে না। 

দেশের ভয়াবহ আরেকটি সমস্যা হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশে মানসম্পন্ন শিক্ষক নেই। আছে পরিচালনায় দুর্বলতা, ফলে একটা ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। সার্টিফিকেটসর্বস্ব ডিগ্রিধারী বেড়েছে। কিন্তু মানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজের বিষয়টি নিয়েও পুনঃচিন্তার দরকার রয়েছে। আরো গভীর বিষয় হচ্ছে, আমাদের পাঠদানের ধরনে পরিবর্তন প্রয়োজন। এখানে শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা চলছে। এ পরীক্ষামূলক কাজ সবসময় আমলাতান্ত্রিক। নতুন শিক্ষা কার্যক্রমকে কার্যকর করার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষক প্রশিক্ষণ। এখন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে নামকাওয়াস্তে। শিক্ষকদের দোষ দেয়া যাবে না। প্রশিক্ষণ প্রদানে ত্রুটি রয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন নতুন যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে, প্রশিক্ষণ ঘাটতির জন্য সেটিও শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। আগামীতে পর্যাপ্ত ও কার্যকর শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিষয়টিকে মহাপ্রকল্প হিসেবে নেয়া জরুরি। সেটি বাস্তবায়নে সার্বিক শক্তি নিয়ে নামা দরকার। সমাজের যেখানে যেখানে সক্ষমতা আছে—সেটা যদি বেসরকারি খাতেরও থাকে— তাদের কাজে লাগানো উচিত।

এছাড়া দেশে বর্তমানে উচ্চ বেতন দিয়ে বেসরকারি উদ্যোগে ভালো শিক্ষা দেয়া ও পাওয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। যেমন ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা। এর মাধ্যমে শিক্ষাকে বিভাজিত করা হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে সবার জন্য একই শিক্ষা পদ্ধতি চালু করতে হবে। যাতে সমাজে কোনো বৈষম্য তৈরি না হয়। একসময় সরকারি জিলা স্কুলগুলো মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। সেগুলোর মানোন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে।  

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠক্রমও দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুপাতে প্রণীত হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েও চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। একটিকে বাদ দিয়ে বা পেছনে ফেলে অন্যগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বেকারত্বের বিষয়টিকে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিরিখে বিবেচনা করতে হবে। 

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল পেতে হলে আগামী এক দশক বাংলাদেশের জন্য ভিন্ন ধরনের দশক হতে হবে। এক্ষেত্রে আরো কয়েকটি জায়গায় জোর দিতে হবে। প্রথমত, তরুণদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং তাদের সম্পৃক্ততার নতুন জোয়ার তৈরি করতে হবে। এ জোয়ার শুধু ঢাকার মধ্যে হলে হবে না, সারা দেশে করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তরুণদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি, তাদের জন্য সুযোগ তৈরি এবং তাদের চালকের আসনে বসার পথগুলো খুলে দেয়া। আর এগুলোকে নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষাকে একটা নতুন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সর্বোপরি, কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষার বিকাশে সরকার, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিতভাবে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন