বন্যায় চট্টগ্রাম মৎস্যসম্পদের ক্ষতি ২ হাজার কোটি টাকা

দেবব্রত রায় I চট্টগ্রাম ব্যুরো

ফেনীর অনেক অঞ্চল থেকেই বন্যার পানি নেমে গেছে। যেসব জলাশয়ে মাছ চাষ করা হতো সবই ভেসে গেছে। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে কিছু জলাশয় ছবি: নুর উল্লাহ কায়সার

সাম্প্রতিক বন্যায় চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি জেলায় বেশির ভাগ মাছ ঘের, পুকুর, দিঘি ডুবে গেছে। বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও অবকাঠমোগত ক্ষয়ক্ষতির কারণে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়ার আশঙ্কা করছেন খামারিরা। বিভাগীয় মৎস্য সম্পদ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, বিভাগটিতে বন্যায় মৎস্য খাতে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে হ্যাচারি মালিকদের দাবি, ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বিভাগের ১১ জেলায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। বিভাগের ৬৫৬টি ইউনিয়নের ১ লাখ ৯৫ হাজার ২৩৯টি পুকুর ও খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ৫৮১ হেক্টরের ১০৩টি ঘেরের পাশাপাশি, ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর ও দিঘির আয়তন ৩৯ হাজার ৫৮১ হেক্টর। প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার ২৯৩ টন মাছ, ৭১৩ টন চিংড়ি ও অন্যান্য প্রকল্পের পোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮৭৭ টন।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. ওমর ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও খামারিদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছি। তবে বন্যার পানি নেমে গেলে আমরা চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করব। এ অঞ্চলে এমন বন্যা আগে দেখা যায়নি। ভারি বর্ষণের কারণে আগে পানি উঠেছে, তবে মৎস্য চাষীরা এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হননি। মৎস্য অধিদপ্তরের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় পরবর্তী যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের সহায়তা করা হবে।’

জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বন্যায় মৎস্য খাতের বেশি ক্ষতি হয়েছে নোয়াখালীতে। সেখানে ৮৫ হাজার ৩৭৯টি পুকুর ও খামারের মাছ ভেসে গেছে। অর্থিক হিসাবে এ খাতে ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া কুমিল্লায় ২৭ হাজার ৬৬৫টি পুকুর, দিঘি ও খামারের ক্ষতি হয়েছে। জেলায় ৩৩ হাজার ৯৭২ টন মাছ ছাড়াও চিংড়ি ও পোনার ক্ষতি হয়েছে। অবকাঠামো, জাল ও মাছের ক্ষয়ক্ষতি ধরা হয়েছে ৫২৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। লক্ষ্মীপুরে ৩১ হাজার ২৯৮টি মৎস্য খামারের প্রায় ১০ হাজার ৬৯৩ টন মাছসহ ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২৪০ কোটি ৬ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম জেলায় ১৬ হাজার ৮৬৪টি পুকুর, দিঘি ও খামারের ১৬ হাজার ৬১০ টন মাছ ভেসে গেছে। জেলায় মাছ, অবকাঠামো, জালসহ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯০ কোটি ৪৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা। চাঁদপুরে ১১ হাজার ৭২১টি পুকুর ও দিঘির ৭ হাজার ২৮৩ টন মাছ ভেসে গেছে। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১৭৮ কোটি ৫২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ফেনীতে ১৮ হাজার ৭৬০টি পুকুর, দিঘি ও খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মোট আয়তন ২ হাজার ৩৮৪ দশমিক ৮ হেক্টর। জেলায় ১ হাজার ২৮২ টন মাছ ও ১১৫ টন চিংড়ির ক্ষতি হয়েছে। শুধু মৎস্য খাতের ক্ষতি ধরা হয়েছে ৭৪ কোটি ৯৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৮ কোটি ৫১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা, কক্সবাজারে ১২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, রাঙ্গামাটিতে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকা, খাগড়াছড়িতে ৬ কোটি ৫৪ লাখ ৯১ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার খামারি দোলোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার প্রায় ২০০ কানি জামিতে মাছ চাষ হতো। যেভাবে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে, তাতে কোনো মাছ ঘেরে আর নেই। সব অন্যত্র চলে গেছে। শুধু মাছেই আমার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আশপাশের চাষীদেরও একই অবস্থা।’

মুহুরী  প্রজেক্ট এলাকার মাছ ব্যবসায়ী মো. মোতলেব বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের প্রজেক্টে অনেক মাছ ছিল। বর্ষা মৌসুমের পরে সেগুলো বিক্রি করার কথা ছিল। কিন্তু যেভাবে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে, তাতে মাছ রক্ষা করা যায়নি। প্রায় ৩০-৪০ লাখ টাকার বিনিয়োগ পুরোটাই শেষ হয়ে গেছে। এ ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে উঠব, সেটা নিয়েই চিন্তায় রয়েছি।’

হ্যাচারি মালিকরা বলছেন, মিরসরাই ও ফেনী এলাকায় ফেনী নদীর ওপরে নির্মিত মুহুরী প্রজেক্টের মাছ ভেসে গেছে। যারা মুহুরী প্রজেক্টে যৌথভাবে মাছ চাষ করতেন, তারা সবাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লায় শত শত পুকুর, ঘের, দিঘিসহ বিভিন্ন খামারের মাছ ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া এসব মাছ বন্যার সময় প্রতি কেজি ১৫-২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। মৎস্য অধিদপ্তর যদিও ২ হাজার কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করেছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি।

নোয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নোয়াখালীতে বৃষ্টি ও হঠাৎ বন্যার কারণে মৎস্য খাতে ৬১৫ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। ৮৫ হাজারের বেশি পুকুর, ঘেরসহ অনান্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। যদিও আমরা এসব মাছ একেবারেই কম দামে তখন বিক্রি হতে দেখেছি। তবে বন্যায় মাছ চাষীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন