‘সেনাপ্রধান হিসেবে মইন ইউ আহমেদের নেতৃত্ব ছিল অপরিপক্ব ও নতজানু’

মেজর জেনারেল (অব.) ইমামুজ্জামান ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

মেজর জেনারেল (অব.) ইমামুজ্জামান বীর বিক্রম। ১৯৯৫ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালকের (ডিজি) দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে ঢাকা রক্ষায় নিয়োজিত নবম পদাতিক ডিভিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। এ দায়িত্ব পালনকালে ১৯৯৬ সালের মে মাসে তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমের এক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা রুখে দেন তিনি। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের চেয়ার‍ম্যান হিসেবে আলোচিত ২০০৪ সালের দশ ট্রাক অস্ত্র মামলারও অন্যতম সাক্ষী ছিলেন তিনি। শেখ হাসিনার সরকারের শাসনামলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ও বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিকা মাহজাবিন

সম্প্রতি সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ একটি বক্তব্য রেখেছেন। সেনাপ্রধান হিসেবে মইন ইউ আহমেদকে আপনি কেমন মূল্যায়ন করেন? 

সেনাপ্রধান হিসেবে বিডিআর বিদ্রোহে মইন ইউ আহমেদের ভূমিকা সঠিক ছিল না। সে সময় তিনি নতজানু নীতি অনুসরণ করেছেন। উনার কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দরকার ছিল। সবকিছুর জন্য তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। উনার আদেশ-নির্দেশ পালন করেছেন। ওই ঘটনার সময় সেনাবাহিনীর সবাই উনার সঙ্গে ছিল। সুতরাং উনার একটা ভূমিকা রাখার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনি যা করলেন, তা খুব অপরিপক্ব কাজ। 

ডিজি বিডিআরেরও ব্যর্থতা রয়েছে। কেননা উনি আগের দিন জানা সত্ত্বেও কোনো পদক্ষেপ নেননি। সে সময় উনি বলেছিলেন, ‘‌অনুষ্ঠানটি শেষ হয়ে যাক, এরপর দেখব।’ কিন্তু অনুষ্ঠানের মধ্যেই তো ঘটনা ঘটে গেল। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আগে থেকে পর্যবেক্ষণ করা উচিত ছিল। বিদ্রোহীরা পরিকল্পনা করছে, লিফলেট ছাপাচ্ছে কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খুব একটা তৎপর ছিল না। প্রধানমন্ত্রী আসবেন সেই আনুষ্ঠানিকতা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।

শেখ হাসিনার শাসনামলে সেনাবাহিনী বিতর্কিত হলো কেন? 

শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সেনাবাহিনীকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। গাড়ি কেনার জন্য ঋণ দিয়েছে। বেতন বৃদ্ধি করেছে। বেতন আমাদের সময়ের চেয়ে প্রায় তিন-চার গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেখানে আমাদের সময়ে ছিল ২০-২৫ হাজার টাকা। কিন্তু উনাদের সময়ে তা বেড়ে সব ধরনের ভাতাসহ লক্ষাধিকের ওপরে চলে গেছে। ২০০৯ সালের পরই এটি শুরু করে। বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। নিজের পছন্দমতো লোকজনকে পদোন্নতি দিয়ে দিয়ে ওপরে উঠিয়েছে। এমন নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অনেক অফিসারকে কিনে নিয়েছে।

সেনাবাহিনীকে নানা ব্যবসা দেয়া হয়েছে। নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এটিকে বিরাজনৈতিকীকরণ করে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে।

সেনাবাহিনীর মূল কাজই হলো দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা এবং যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে ভূমিকা রাখা। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলো নিয়ে তার কোনো প্রোগ্রাম ছিল না। ভারত যে আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে সেই ধারণাকে পাল্টে দিয়ে শেখ হাসিনা ভারতকে বন্ধু বানিয়ে দিলেন, যাতে প্রয়োজনের সময়ও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে না হয়। 

এছাড়া বিরোধী অফিসারদের নামে বিভিন্ন ধরনের মামলা দিয়ে জেল জরিমানা করে সেনাবাহিনী থেকে বের করে দেয়া হয়। এমনকি আয়নাঘরেও ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ করলে যে ‘‌তোমরা যদি বিরোধিতা করো তাহলে তোমাদেরও এ অবস্থা হবে।’ 

যার জন্য সবাই ভয় পেয়ে গেল। বিডিআর বিদ্রোহের পরে যে দরবার হয়েছিল, সেখানে যারা উচ্চবাচ্য করেছিল তাদের অনেককেই চাকরি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।

দীর্ঘ দেড় দশক শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকার পেছনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো ধরনের ভূমিকা ছিল কি?

এর বড় কারণ হলো বিগত নির্বাচনসহ নানা সময় সেনাবাহিনীর নেয়া নানা পদক্ষেপ। শেখ হাসিনার পুরো শাসনামলে সেনাবাহিনী নীরব ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তৎকালীন সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া একটু সাপোর্ট না দিলে তারা হয়তো নির্বাচন করতে পারত না। ইকবাল করিম ভূঁইয়া সরে গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিতে বাধ্য হতো। তিনি একা সরে গেলে হয়তো তার জায়গায় অন্য কেউ আসত। কিন্তু বাহিনীর সব পর্যায়ে আলোচনা করে তিনি সরে গেলে একটি পরিবর্তন হতেও পারত। কিন্তু উনারাও সরকারের প্রতি অতি উৎসাহী ছিলেন। অনুগত ছিলেন। সরকারকে সমর্থন দিয়েই গেছেন। সব সেনাপ্রধানই একই রকম ভূমিকা পালন করে গেছেন। 

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুরোপুরি আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত ছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষেই কাজ করেছে। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী। তারা বিরোধী দলের ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন করেছে।  

আপনি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে ডিজিএফআইয়ের ডিজির দায়িত্বে ছিলেন। আপনার সময় ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪, ২০১৮ আর ২০২৪ সালের ডিজিএফআইয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই। 

শেখ হাসিনার প্রতি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অন্ধ সমর্থন ছিল। তারা অন্ধভাবে অনুগত ছিল। পদোন্নতি পেতে ও চাকরি রক্ষার্থে তারা শেখ হাসিনার প্রতি অত্যন্ত অনুগত ছিল। তারা ভাবতেন যে ‘‌প্রতিটি নির্বাচনে আমরা শেখ হাসিনাকে জয়ী করব’। এতে তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। 

আমরা ডিজিএফআইয়ে থাকাকালে শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকা সত্ত্বেও তার দাবিতে সমর্থন দিয়েছিলাম। যখন দেখলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে উঠেছে, তখন খালেদা জিয়াকে বুঝিয়ে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার এনে নির্বাচন দিয়েছিলাম। এতে দেশে শান্তি ফিরে এসেছিল। 

ডিজিএফআই থেকে শুরু করে সব সংস্থাই কি শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি নতজানু ছিল?

সব সংস্থাই নতজানু ছিল। শেখ হাসিনা তো একনাগাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। ফলে সংস্থাগুলোর লোকজন ভেবেছিলেন যে শেখ হাসিনা আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন। সুতরাং আমরা সাপোর্ট করে যাই। এটি করতে গিয়ে তারা শেখ হাসিনার ন্যায়-অন্যায় সবকিছুই সমর্থন করে গেছেন। 

ভারতের প্রতি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মনোভাব বন্ধুভাবাপন্ন করার শুরুটা নিয়ে জানতে চাই। 

যেকোনো দেশের সেনাবাহিনী তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি বৈরী না হলেও মাঝারি আকারের একটি প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। আমাদের এখানেও অতীতে ভারতকে বন্ধুও না শত্রুও না এমন নিরপেক্ষ জায়গা থেকে দেখা হতো। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ বা এ জাতীয় কিছু ঘটলে সেজন্য কিছুটা যুদ্ধের প্রস্তুতিও আমাদের নেয়া ছিল। 

এ ধরনের মনোভাব প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়েও ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার আমলে সেটি পাল্টে দেয়া হয়। ২০০৯ সালের পর এ কৌশল থেকে সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ভারত যে আমাদের শত্রু হতে পারে, তাদের সে চিন্তাধারাকে পাল্টে দেয়া হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যৌথ অনুশীলন শুরু হয়েছিল। তবে এটি আমাদের খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। 

১৯৯৫ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আপনি ডিজিএফআইয়ের ডিজি হিসেবে ছিলেন। আপনার কাছে আয়নাঘর নিয়ে জানতে চাই। 

আমাদের সময় আয়নাঘর বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল নামে একটি সেল ছিল। এখানে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও গুপ্তচরদের এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। এক-দুই মাস পরপর এখানে একেকজন আসামি আসত। তথ্য পাওয়ার জন্য যতটুকু চাপ দেয়া দরকার, ততটুকুই দেয়া হতো। তবে সে সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোনো ধরনের টর্চার করা হতো না। ভয়ভীতি দেখানো হতো। আর জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য পেলেই ছেড়ে দেয়া হতো। পুরো বছরজুড়ে এটি খোলাও থাকত না। আমি ডিজিএফআইয়ের ডিজি থাকাকালে কাউকে এখানে আনা হয়নি। এজন্য আমাকে এগারো মাস পরই ডিজিএফআই থেকে চলে আসতে হয়। কারণ আমি নীরব ছিলাম। ডিজি ডিজিএফআই হিসেবে অতি উৎসাহী ছিলাম না। 

শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর আয়নাঘর চালু হয়। এটি পুরোপুরি একটি টর্চার সেল। একটি বিষয় হলো সরকার যতটুকু বলে তার চেয়েও বেশি উৎসাহী হয় নিম্নস্তরে থাকা কর্মচারীরা। অতি উৎসাহী হয়ে নির্যাতন চালাতে থাকে। ব্রিগেডিয়ার আজমীকে তো গুপ্তচরবৃত্তির জন্য আটকানো হয়। সে গোলাম আযমের ছেলে, তাই তাকে শায়েস্তা করার জন্যই আয়নাঘরে নিয়ে যায়। 

২০১৩-এর মে মাসে শাপলা চত্বরে হেফাজতের আন্দোলনকে শেখ হাসিনা সরকার কীভাবে দমন করেছিল?

এ আন্দোলন দমন করার জন্য সরকার পুলিশকে ব্যবহার করেছিল। পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছে, এতে অনেক লোক মেরেছে। তাই তারা শাপলা চত্বর থেকে উৎখাত করতে পেরেছে। পুলিশই অতি উৎসাহী হয়ে জনগণের ওপর সবচেয়ে বেশি অত্যাচার করেছে। বিজিবি, র‍্যাব ও আর্মি এত করেনি। 

আপনি ডিজিএফআইয়ের ডিজি থাকাকালীন এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সরিয়ে নেয়ার কারণ কী?  

১৯৯৬ সালের পটপরিবর্তনের আগে বিএনপি সরকার চেয়েছিল শক্তিশালী কাউকে নবম পদাতিক ডিভিশনে দেয়ার জন্য। সেজন্য ডিজি ডিজিএফআই থেকে সরিয়ে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমাকে নবম পদাতিক ডিভিশনে দেয়া হলো। ১৯৯৬ সালের তৎকালীন সেনাপ্রধান নাসিম সাহেব ক্যু করতে চেয়েছিলেন। বোধ হয় খালেদা জিয়া আগে থেকেই সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন কিছু ঘটবে আঁচ করেছিলেন। আমরা ঠিকই ওই পরিস্থিতি মোকাবেলা করলাম। কিন্তু ১৯৯৬ সালের জুনে যে নির্বাচন হলো সেখানেও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছিলাম, যার জন্য শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেন। বিএনপির লোকেরা যদি পক্ষপাতিত্ব করত তাহলে আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায় আসতে পারত না। 

বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে জানতে চাই। 

বিডিআর বিদ্রোহ একদিনের ফসল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, মুক্তিবাহিনী থেকে যত বিডিআর সৈন্যরা গিয়েছিল তাদের বিডিআর গঠন করা হবে না। এখানে বর্ডারে কোনো গার্ড দরকার নেই। বাংলাদেশ ভারত আমরা বন্ধু দেশ। বরং এখানে ন্যাশনাল মিলিশিয়া গঠন করা হবে। কিন্তু বিডিআর সৈন্যরা তা মেনে নেয়নি। বরং তারা ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বিদ্রোহ করে, গোলাগুলি করে। সে সময় তারা মূলত আকাশে গুলি ছুড়েছিল। কিন্তু কোনো ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তখন ডিজি হিসেবে মেজর জেনারেল সিআর দত্তকে নিয়ে এসে তাদের শান্ত করলেন এবং বিডিআর হবে বলে ঘোষণা দিলেন। এর পাশাপাশি তাদের দ্বিতীয় দাবি হলো বিডিআর হলে তাদের নিজস্ব অফিসার হবে। অর্থাৎ সেনাবাহিনী থেকে কোনো অফিসার ডেপুটেশনে বিডিআরে আসতে পারবে না। তারপর সিআর দত্ত শেখ সাহেবকে বোঝালেন সেনাবাহিনী থেকে অফিসার না হলে বিডিআর শক্তিশালী হবে না। তখন আর্মি অফিসারদের বিডিআরে নিয়ে আসা শুরু হলো। এ নিয়ে অসন্তোষ ছিল। 

পরে এরশাদের পতনের এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯০ সালে আরেকটি বিদ্রোহ হলো। তখনো কোনো প্রাণহানি হয়নি। সে সময় তাদের দাবি ছিল আর্মি অফিসার চাই না। বিডিআরের নিজস্ব অফিসার থাকবে। তখনো তাদের এ দাবি মানা হলো না। বহু বছর ধরে তাদের মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষ ছিল।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কিছু কিছু বিডিআর সৈনিক আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের নিজস্ব দাবি-দাওয়া পেশ করতে থাকল। বিডিআরের নিজস্ব অফিসার থাকার দাবিটি ছিল। তখন শোনা যায়, শেখ ফজলে নুর তাপস, প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক ও সরকারদলীয় নেতা মির্জা আজম বিডিআর সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিডিআর সৈন্যরা তাদের বলে আমরা কিছু একটা করতে চাই। উনারা নীরব সম্মতি দিলেন মনে হয়। এরপর বিডিআর সপ্তাহে ২৫ আর ২৬ ফেব্রুয়ারি তারা এটি ঘটায়। ফলে বলা যায়, আওয়ামী লীগের দুই-তিনজন সংসদ সদস্য এটি জানতেন। তাদের সম্মতি নিয়েই বিদ্রোহটি করা হয়েছে। কিন্তু এটি যে এত তীব্র হবে, যেখানে ৫৭ জন অফিসার মেরে ফেলা হবে, সেটি কেউ ভাবতে পারেনি। 

সৈনিকরাই মূলত বিদ্রোহটি করেছে। আর বাইরের থেকে উসকানি দেয়ার মতো তেমন উল্লেখযোগ্য কেউ ছিল না। ২৫ তারিখেই ডিজিসহ বাকি অফিসারদের মেরে ফেলে। এভাবেই ২৬ তারিখে নিজ গতিতে থেমে যায়। শেখ হাসিনা এর মধ্যে বিডিআর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে তাদের সব দাবি মেনে নেয়া হবে বলে আশ্বাস দেন। ২৬ তারিখের পর আর্মি গিয়ে বিডিআর বিদ্রোহকে নিয়ন্ত্রণে আনে। 

রাজনীতিবিদরা জানা সত্ত্বেও কেন বিদ্রোহটি ৫৭ জন অফিসারসহ ৭৪ জনের প্রাণহানির ঘটার মতো অবস্থায় গিয়েছিল?

বাইরের কোনো শক্তি হয়তো উসকানি দিয়েছিল। কোনো চক্রান্ত থাকতে পারে। 

একটি নতুন সরকার শপথ নেয়ার দুই মাসের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটার কারণ কী? 

এটি গোয়েন্দা ব্যর্থতা। গোয়েন্দা বাহিনী ঠিকমতো আঁচ করতে পারেনি, পূর্বাভাসও দিতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী বিডিআর সপ্তাহ উদ্বোধন করতে যাবেন, সে অনুষ্ঠান নিয়েই তারা ব্যস্ত ছিল। ভেতরে ভেতরে সৈনিকরা এমন পরিকল্পনা করছে, সেটিতে লক্ষ করেনি কেউ।

প্রধানমন্ত্রী কি বুঝতে পেরেছিলেন যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে?

২৫ ফেব্রুয়ারির আগের দিন রাতে প্রধানমন্ত্রী বিডিআরের একটি অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল কিন্তু আসেননি। এটি থেকেই তো প্রমাণ হয় যে উনি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। 

২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ শুরুর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে কোনো নির্দেশ না দেয়ার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

তিনি হয়তো চাননি সংঘর্ষ হোক। দুই বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হলে প্রাণহানি আরো হবে। তাই উনি চেয়েছিলেন আলোচনার মাধ্যমে, বোঝাপড়ার মাধ্যমে এটিকে সমাধান করতে। এজন্য তাদের ডেকে, বিদ্রোহীদের ডেকে আলোচনা করেছেন। 

এত হালকাভাবে নেয়ার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

সরকারের সম্পূর্ণ মদদ ছিল, সেটি বলা যায় না। তবে সরকারের কয়েকজন এ ব্যাপারে অবহিত ছিলেন। বাস্তবে বিডিআর অফিসারের বিরুদ্ধে বিডিআর সৈনিকরা বিদ্রোহ করেছে। এর মাঝামাঝি কেউ ছিল না। সৈনিকরাই মূলত বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে। আমি এভাবেই দেখি।

অনেকে বলে আওয়ামী লীগ পরিকল্পনা করে করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোক তো মুজিব কোট পরে এসে মারেনি। এটা বলা যায় যে আওয়ামী লীগের কয়েকজনের নীরব সম্মতি ছিল। তাদের সম্মতি এমন ছিল যে ‘তোমরা যদি করতে পারো করো। আমরা দেখব’। এ রকম বলা যায়। শেখ ফজলে নূর তাপসরা হয়তো এ রকমই বলেছে।

অনেকেই বলে থাকেন সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার জন্য এমনটি করা হয়ে থাকতে পারে।

এটি অতিরঞ্জিত কথা। আমার মনে হয় না। সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার হলে তো সেনাবাহিনীর ভেতরেও মারত। তাহলে শুধু বিডিআরের মধ্যে মারবে কেন? বিডিআরের অফিসাররা সেনাবাহিনীর অফিসার হলেও তখন তো বিডিআরে কর্মরত। সুতরাং বলা যায় বিডিআরকে দুর্বল করার জন্য করেছে। আর প্রতিবেশী দেশের ইন্ধন হয়তো থাকতে পারে। কিন্তু সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল না। 

সম্প্রতি ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং দেশটির সামরিক বাহিনীকে বাংলাদেশের ওপর নজরদারি বাড়ানোর কথা বললেন। এটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

উনারা ভাবছেন সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের উগ্রপন্থীরা যদি ভারতে আসে, তাহলে ভারতে অসন্তোষ বাড়তে পারে। তবে বাংলাদেশ আক্রমণ করে ভারত নিয়ে নেবে এমন সক্ষমতা ভারতের নেই। তাদের সাহসও হবে না। তারা পুনরায় শেখ হাসিনাকে সাপোর্ট দিয়ে বসানো যায় কিনা, সেজন্য হয়তো এটি করছেন। কিন্তু ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে টিকতে পারবে বলে মনে হয় না। অর্থাৎ জুজুর ভয় দেখিয়েছেন। 

শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেয়ার প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী পরিমাণ পড়বে?

কিছু তো পড়বেই। অন্য দেশে চলে গেলে এ প্রভাবটা থাকত না। সব দেশই উনাকে বোঝা মনে করছে। কেউ তো নিচ্ছে না।

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে কোনো ধরনের অভ্যুত্থান হয়নি। কিন্তু আমাদের ক্ষমতার শূন্যতায় সবসময় ক্যু হয়ে থাকে। এবারের এ ব্যতিক্রমের কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

আওয়ামী লীগের শাসনামলে সবসময়ই বলা হতো যে অসাংবিধানিক উপায়ে কোনো সরকার পরিবর্তন যেন না হয়। বিগত ১৫ বছরের প্রশিক্ষণে সেনাবাহিনীকে যে চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে গড়া হয়েছে তারা ওই চিন্তাধারার ওপর নির্ভর করেই ক্ষমতা নিতে সাহস করেনি। মানসিকভাবে অগণতান্ত্রিক উপায়ে যাতে ক্ষমতা পরিবর্তন না হয় তারা সেদিকে সচেতন ছিল। সত্তর আর আশির দশকে এ মনোভাব ছিল। তার পর থেকে এটি চলে গেছে। 

আর বর্তমান সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান নিজেও একজন নিরপেক্ষ মানুষ। অতি উৎসাহী হলে হয়তো ক্ষমতা নেয়ার চেষ্টা করতেন। আর উনি একা ক্ষমতা নিলে বাকি সবাই সমর্থন নাও দিতে পারে। তখন তো ব্যাপারটি রিস্কি হয়ে যায়। এছাড়া আইনিভাবে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা না নেয়ার ব্যাপারে সংবিধানেও বলা রয়েছে। 

দশ ট্রাক অস্ত্রের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাই।

পাকিস্তান শাসনামলে উত্তর-পূর্ব ভারতে পাকিস্তান সরকার অস্ত্র সরবরাহ করত পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে। ১৯৭৫ সালে সেটি বন্ধ হয়। গোয়েন্দারা সবসময় অস্ত্র পাচারের পথ হিসেবে চট্টগ্রাম-সিলেট এ পথটি চালু রাখত। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য অস্ত্র সরবরাহের কথাটি সঠিক না। কিন্তু বিএনপির আমলে এ কাজটি হয়। ধরাও পড়ে যায়। ধরা পড়াতে বিষয়টি সবার মাঝে জানাজানি হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে মইন ইউ আহমেদের সময়ে উনি যখন ভারতে গেলেন তখন দেশটির সরকার উনাকে পুনরায় তদন্ত করতে বলল। পুনরায় তদন্ত করতে গিয়ে ধরা পড়ল যে এটি আসামের উলফার জন্য নেয়া হচ্ছিল। সেভাবে বিচারকার্য হয়ে শাস্তি হয়ে নিষ্পত্তি হলো। যদিও বিএনপির আমলে এ নিয়ে তদন্ত হয়েছিল। কিন্তু ভারতের চাপে সেটি বাতিল করে আবার নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তদন্তটি শেষ করে। 

এ ঘটনায় তৎকালীন বিএনপি সরকার কি জড়িত ছিল?

সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে জানত কিনা জানি না। কিন্তু গোয়েন্দারা অতি উৎসাহী হয়ে এটি করেছে। আমি তো বলেছি, অনেক কিছু প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীরা জানতেনও না। কিন্তু মধ্যপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা অতি উৎসাহী হয়ে এসব করেছেন।

দশ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনার সময় আপনি বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের চেয়ার‍ম্যান ছিলেন। এ ঘটনার পর পরই আপনি চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসরে যান। এক্ষেত্রে দশ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনাটি কি কোনো ধরনের প্রভাব ফেলেছিল?

আমার অবসরের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তখন আমি বিসিআইসির চেয়ারম্যান ছিলাম। সেজন্য আমাকে সাক্ষী দিতে হয়েছে। বিসিআইসির একটি কারখানার ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের সামনে এটি জাহাজ থেকে নামিয়েছিল। সুতরাং একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমি সাক্ষী হিসেবে ছিলাম। তখনকার শিল্প সচিব যিনি ছিলেন তিনিও সাক্ষী হিসেবে ছিলেন।   

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন