জিপিএইচ এগিয়ে বিশ্বসেরা প্রযুক্তি নিয়ে

রাশেদ এইচ চৌধুরী

ছবি : সংগৃহীত

দেশের ইস্পাত শিল্পে জিপিএইচ ইস্পাতের নেতৃত্ব সারিতে আসার গল্পটি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। মূলত সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জিপিএইচ ইস্পাত বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের স্টিল ইন্ডাস্ট্রিকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। জিপিএইচ ইস্পাত চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরায় এশিয়ায় প্রথম কোয়ান্টাম ইএএফ টেকনোলজি সমৃদ্ধ কারখানা স্থাপন করে। আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত কোয়ান্টাম ইএএফ অর্থাৎ কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস পৃথিবীতে ইস্পাত শিল্পের সর্বাধুনিক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। পরিবেশবান্ধব এ প্রযুক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যে জিপিএইচ ইস্পাত অস্ট্রিয়ার প্রাইমেটালস টেকনোলজিসের সঙ্গে ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি চুক্তি করেছিল। এরপর ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বসানো হয় নতুন প্রযুক্তির প্লান্ট। রডের পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয় ২০২১ সালে। কোম্পানির বার্ষিক রড উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ টনে। জিপিএইচ কারখানায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুরনো লোহা থেকে বিলেট তৈরি হয়ে সরাসরি রড ও রডজাতীয় পণ্য তৈরি হয়।

প্রি-হিটিং, স্ল্যাগ ফ্রি ট্যাপিং ও সর্বোচ্চ পরিশোধন নিশ্চিত করে একমাত্র জিপিএইচ নিখাদ স্টিল তৈরি করে

প্রি-হিটিং চেম্বারে থার্মাল ট্রিটমেন্ট করে কাঁচামালের গায়ে লেগে থাকা যাবতীয় ময়লা, জং, কোটিংসহ সব অপদ্রব্য দূর করা হয়। মেলটিংয়ের সঙ্গে অক্সিজেন ল্যান্সিং, ফ্ল্যাক্সিং, পারজিং ও সাইফনিক ট্যাপিংয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় নিখাদ বা পরিশোধিত ইস্পাত। ফলে প্রস্তুতকৃত রডের গুণগত মান অন্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আলাদা। স্বয়ংক্রিয় এ কারখানার রডে তৈরি ঘরবাড়ি কিংবা বড় স্থাপনা হয় টেকসই, মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় বলে এতে সর্বোচ্চ মাত্রায় পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।

জিপিএইচ গ্রপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমাদের প্রতিশ্রুতি ও প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বমানের সম্পূর্ণ গ্রিন ও ডিজিটাল এ ইস্পাত ফ্যাক্টরি। আমরা বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে এমন একটা প্রযুক্তি এনেছি, যেখানে অক্সিজেন ব্যবহারের মাধ্যমে স্ন্যাগ ফেলে দিয়ে নিখাদ স্টিল তৈরি করা হয়। বায়ুদূষণ কমাতেও এ প্রযুক্তি খুবই কার্যকর। প্রচলিত প্রযুক্তির বিভিন্ন কারখানার তুলনায় জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় প্রাকৃতিক গ্যাসের সাশ্রয় হচ্ছে।জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের জ্বালানির অপচয় রোধ করতে হবে। আমদের পদক্ষেপগুলো এমন হওয়া উচিত, যেন ২০৪১-এর আগে আমরা উন্নত দেশে রূপান্তর হতে পারি।’

বাজারে এনেছে ভূমিকম্পসহনীয় কাঠামো নির্মাণের উপযোগী উচ্চ শক্তির ৬০০ গ্রেডের রড

উন্নত দেশের স্থাপনায় ৬০০, ৭০০ এমনকি ৮০০ গ্রেডের উচ্চশক্তির রড ব্যবহার করা হয়। স্ট্রেংথ বেশি হওয়ায় সেসব দেশে অবকাঠামো নির্মাণে রড তুলনামূলক কম লাগে। ইস্পাত খাতে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আসায় বাংলাদেশে একমাত্র জিপিএইচ ইস্পাত ৬০০ গ্রেডের এমন উচ্চশক্তির রড তৈরিতে সক্ষম হয়। কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে তৈরি এ রডের দুটি গ্রেড সর্বপ্রথম বাংলাদেশে উৎপাদন করেছে জিপিএইচ। এর নাম দেয়া হয়েছে “GPH QUANTUM B600D-R” ও “GPH QUANTUM B600C-R”। এ রডের বিশেষত্ব হলো এ রড ব্যবহার করে নির্মাণে ৫০০ গ্রেডের তুলনায় সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ এবং ৪২০ গ্রেডের তুলনায় সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ রডের পরিমাণ কমানো সম্ভব। গবেষণায় দেখা যায় যে ভূমিকম্পসহনীয় কাঠামোয় এ রড ব্যবহার অধিক নিরাপদ। ভবনের কলাম ও সেকশনের আকার কমে যায়, যা মেঝের জায়গা বাড়াতে সাহায্য করে। রডের ব্যবহার কমানো হলে কংক্রিট দেয়ার জায়গাও বাড়ে। ফলে নির্মাণের গুণগত মান হয় ভালো। কারখানায় এছাড়া ৫০০ গ্রেডের টিমটিবার ও বিভিন্ন গ্রেডের রডের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে স্কয়ার বার, অ্যাঙ্গেল, চ্যানেল, এইচ বিম, আই বিমসহ প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড বিল্ডিং নির্মাণের নানা উপকরণ।

রড নির্মাণে মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা

রড উৎপাদনের মধ্যবর্তী কাঁচামাল হলো বিলেট। মূলত এ বিলেট উত্তপ্ত করে রোলিং মিলে রোল করে তৈরি করা হয় রড। রডের উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি রড তৈরির মধ্যবর্তী এ কাঁচামালের উৎপাদনক্ষমতা বাড়িয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত। নিজেদের মেল্টিং কারখানায়ই চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করছে বিলেট, আর সরে এসেছে সরাসরি বিলেটের আমদানিনির্ভরতা হতে। এতে বিলেট তৈরির জন্য প্রাথমিক কাঁচামাল (পুরনো লোহা) আমদানি বাড়াতে হয়েছে।

রফতানিতেও তৈরি করেছে উদাহরণ

বাংলাদেশ থেকে প্রথম বিলেট রফতানির উদাহরণটিও তৈরি করেছিল জিপিএইচ ইস্পাত ২০০৮ সালে। সে সময় শ্রীলংকায় আড়াই হাজার টনের ছোট চালান রফতানি করে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তী সময়েও বিলেটের বড় বড় চালান রফতানি হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। চীনের বাজারে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো বিলেট রফতানির কৃতিত্বও জিপিএইচ ইস্পাতের। ইস্পাত উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষস্থানে থাকা চীনে এ বিলেট রফতানি করেছিল ২৫ হাজার টন, যার মূল্য ১ কোটি ১ লাখ ৭৫ হাজার ডলার। বাংলাদেশ থেকে একসঙ্গে এত বড় চালান কখনো রফতানি হয়নি।

বিশেষ গুরুত্ব পায় দূষণ প্রতিরোধ

ইস্পাত কারখানা এলাকায় বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ হয় ও ক্ষদ্র বস্তুকণা ছড়িয়ে যায়। শিল্পের ধরন, অবকাঠামোর মান, ব্যবহৃত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতার ওপর দূষণের মাত্রা নির্ভর করে। জিপিএইচ ইস্পাতের কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তিতে এ ক্ষতির মাত্রা খুবই কম। এতে ব্যয় বেড়ে গেলেও নতুন কারখানার কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ৮০ শতাংশ কমে গেছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ক্ষতিকর কণা থাকছে বড়জোর ১০ মিলিগ্রাম, যা বিশ্বব্যাংকের গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড থেকে প্রায় ৮০ শতাংশ কম। কারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোনো ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয় না। পানি শোধনাগার প্লান্ট শূন্য ডিসচার্জ সিস্টেমের সঙ্গে ডিজাইন করা হয়েছে, যা ব্যবহৃত পানির শতভাগ পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করে।

পানির দক্ষ ব্যবহারেও এগিয়ে জিপিএইচ

মাটির নিচে অনেক গভীরে গিয়েও পানি না পাওয়ার অভিযোগ সীতাকুণ্ডে কারখানা স্থাপনকারী উদ্যোক্তাদের। এক্ষেত্রেও উদাহরণ তৈরি করেছে জিপিএইচ ইস্পাত। সীতাকুণ্ড জিপিএইচ কারখানায় তৈরি করা হয়েছে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ও মাল্টিপারপাস ইউসেজ রিসার্চ প্রজেক্ট। গড়ে এক হাজার টন রড উৎপাদন করতে প্রয়োজন প্রায় ১৪ লাখ লিটার পানি। প্রতিষ্ঠানটি পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা বৃষ্টির পানি বাঁধ দিয়ে সংরক্ষণ করে রড উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করছে। আবার ইস্পাত উৎপাদনে ব্যবহৃত পানি অপচয় না করে তা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা হচ্ছে। তাতে কারখানাটির পানির অপচয়ের মাত্রাও কম। এদিকে ভূগর্ভের পানি ব্যবহার না করায় চাপ কমছে পরিবেশের ওপরও।

দেশের সংকটকালে কাজে লেগেছে জিপিএইচের অক্সিজেন প্লান্ট

জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় আছে দৈনিক ৩০০ টন উৎপাদন সক্ষমতার দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ও বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এয়ার সেপারেশন প্লান্ট, যেটি অক্সিজেন প্লান্ট নামেই বেশি পরিচিত। এ প্লান্টে প্রতিদিন ২২০ টন বায়বীয় অক্সিজেন, প্রায় ২৫ টন তরল অক্সিজেন উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নিজেদের ইস্পাত পরিশোধনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ প্লান্টে প্রতিদিনই বায়বীয় নাইট্রোজেন, তরল নাইট্রোজেন ও তরল আর্গন গ্যাস তৈরি হচ্ছে। করোনাভাইরাস মহামারীর সময় প্রতিদিন দেশের অক্সিজেন চাহিদার বিপুল একটি অংশ সরবরাহ করছে জিপিএইচ ইস্পাত। করোনাকালে আক্রান্ত রোগীদের পাশে দাঁড়াতে প্রতিষ্ঠানটি ‘‌জীবন সঞ্জীবনী অক্সিজেন’ —স্লোগান নিয়ে নতুন এয়ার সেপারেশন ইউনিট স্থাপন করে। দেশের প্রত্যন্ত উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, ফিল্ড হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অক্সিজেন বিতরণ করেছে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন