আন্দোলনে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা

আন্দোলনের দিনগুলোয় ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা

ছবি : বণিক বার্তা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরবর্তী সময়ে এ আন্দোলন বাংলাদেশের সব ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসের আন্দোলনকে দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সবসময় সচেষ্ট ছিলেন ক্যাম্পাসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করা সাংবাদিকরা। পেশাগত কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকরা ছাত্রলীগ ও পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। মার খেতে হয়েছে অনেককে। বাধা সত্ত্বেও ক্যাম্পাসের প্রতি মুহূর্তের ঘটনা মানুষের কাছে তুলে ধরে আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছেন ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা। বিভিন্ন ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন রুদ্র ইকবাল

‌সাংবাদিকতার কৌশল ছিল শিক্ষার্থী বনে যাওয়া

ছিদ্দিক ফারুক 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, আজকের পত্রিকা

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে, পরেরদিন রাতে রোকেয়া হলে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বের করে দেয়া হয়। আস্তে আস্তে সব হলে সেটা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করেছি৷ ইন্টারনেট না থাকা অবস্থায় এসএমএস করে নিউজ পাঠিয়েছি। সমন্বয়কদের একটা অংশ যখন ডিবি অফিসে ছিল তখন সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা চ্যালেঞ্জও ছিল। তবে পূর্বপরিচিত হওয়ায় একটা ভরসা রেখেছে আমার প্রতি। সেই সময় তাকে বলেছিলাম,  এ নয় দফা তো আছে এক দফা। শহীদ মিনারে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করা হয়। লাশের পর লাশে মাড়িয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যায়। সফল হয় ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান। যতদিন মাঠপর্যায়ে আন্দোলন কাভার করেছি আইডি কার্ড গলায় ঝোলানো ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। মানুষের মাঝে সাংবাদিকের ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্য ছিল মাঠে মাঠে। কানে আসত এসব কথাও। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আন্দোলন কাভার করার সময় সাধারণ শিক্ষার্থী হয়ে থাকব। তবে পুলিশের সামনে এলেই দেখাতাম কার্ড। হয়ে যেতাম সাংবাদিক। আর বাকি সময় থাকতাম শিক্ষার্থী।

আমাদের কলম ছিল শিক্ষার্থীদের পক্ষে

আহমেদ জুনাইদ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, জাগো নিউজ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মূল শহর থেকে দূরে হওয়ায় কাজের চাপ ছিল বেশি। শহর ক্যাম্পাস উভয় জায়গায় নিউজের জন্য যেতে হতো। ১৬ জুলাই ছিল চট্টগ্রামে সাংবাদিকতায় অন্যতম স্মরণীয় দিন। সেদিন মুরাদপুরে দফায় দফায় আওয়ামী লীগ শিক্ষার্থীদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। নিহত হন তিনজন। চোখের সামনে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছি। এদিন চবি সাংবাদিকরা সাহসিকতার পরিচয় দেন। বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে ইট-পাটকেল, টিয়ার গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট গুলির মুখে নিউজ কাভার করেন। ইটের আঘাতে আহত হন মানবজমিন পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সুমন বায়েজিদ। ১৯ জুলাই দুজনকে শিবির সন্দেহে পুলিশ বক্সে নেয়া হয়েছে, এমন খবর পেয়ে ছুটে যান আমাদের সহকর্মী শাহ রিয়াজ। তখন তার মুখে কাপড় পেঁচিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করে ছাত্রলীগ। তাৎক্ষণিক প্রক্টরকে জানানো হলে তিনি জানান, এক হাতে তালি বাজে না। প্রশাসনের অসহযোগিতা, ছাত্রলীগের হুমকি সত্ত্বেও আমরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যাইনি। আগস্ট নিউমার্কেট মোড়ে আওয়ামী লীগ-পুলিশ শিক্ষার্থীদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। সেদিন টিয়ার গ্যাসের কারণে লাইভ করতে অনেক কষ্ট হয় আমার। আমাকে আমার সহকর্মী শাহ রিয়াজকে শিক্ষার্থী সন্দেহে ধরে ফেলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মোবাইল ছিনিয়ে নেয়, হুমকি দেয়। পরে পরিচয় দিয়ে তাদের থেকে নিস্তার পাওয়া যায়।

আমরা ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করেছি

ইমরান হিমু

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, যুগান্তর

জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি করা হয়। ১৫ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাক্ষী হয় এক কালরাত্রির। চোখের সামনেই পুলিশের ছররা গুলি খেয়ে তিনজন সহকর্মীকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলাম। আমার ওপরও ছাত্রলীগের কর্মীরা আক্রমণ চালায়। গুলিবিদ্ধ সহকর্মী মেহেদী মামুনকে ঘাড়ে করে নিরাপদে নিয়ে গেলাম। তারপর পরিস্থিতি একটু ঠাণ্ডা হলে তাদের গাড়িতে তুলে হাসপাতালে পাঠালাম। পরের দিন সাবেক ভিসি ফারজানা ইসলামের নীতি অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিল। হলগুলোর কারেন্ট-পানি বন্ধ করে দিল। কয়েকদিন সমিতির রুমে থাকলাম। একের পর এক হুমকি-ধমকি আসছিল, তবে আমরা যদি ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাই ক্যাম্পাস দেখবে কে? আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের খবর পত্রিকায় আসবে না। নির্যাতন কেউ জানবে না। থমথমে পরিবেশে থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের খবর তুলে ধরেছি। আমরাও তো শিক্ষার্থী। আমাদের ভাই-বোনদের খবর মিডিয়ার কাছে তুলে ধরেছি যাতে দেশের মানুষ অন্যায় সম্পর্কে জানতে পারে।

নীরবে গভীর ভূমিকা রেখেছেন ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা

আলকামা রমিন

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, কালবেলা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গভীর নীরবভাবে ভূমিকা পালন করেছেন ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা। আন্দোলনে ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের যেমন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। ঠিক তেমনিভাবে তাদের লেখনী ভিডিও চিত্রে আন্দোলনের চিত্র উঠে এসেছে। আন্দোলনকে ছাত্ররা ভূমিকম্প আকারে তৈরি করেছেন আর ভূমিকম্পকে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা। একজন ক্যাম্পাস সাংবাদিক একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাংবাদিক। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের সময় নানা বেগ পোহাতে হয়েছে সাংবাদিকদের কিন্তু সত্যকে সত্য হিসেবে লিখতে কখনো আপস করিনি। আমরা ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা ছিলাম আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী প্রকৃত কলমযোদ্ধা। রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, সব ধরনের প্রতিকূলতা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি। কখনো বসে, কখনো ছুটতে ছুটতে আবার কখনোবা কাঁদানে গ্যাসের ঝাঁজালো ধোঁয়ায় চোখ মুছতে মুছতে নিউজ তৈরি করেছি। কখনো মনে হয়নি পালিয়ে যাই। এমন সব সংঘাতময় পরিস্থিতিতেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছি। জুলাইয়ের ক্যাম্পাস পাতাগুলো প্রমাণ করে কতটা নিবেদিত ছিলেন ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা।

সত্য তুলে ধরেছি দেশের প্রয়োজনে

সাঈদ হাসান

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, মানবজমিন

আন্দোলনে ১১ জুলাই প্রথম রক্তাক্ত হন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেদিন শিক্ষার্থীদের দমনের পাশাপাশি পুলিশের টার্গেট ছিল সংবাদকর্মী। এর পরও আমরা লাইভ করেই যাচ্ছিলাম। লাইভ দেখার কিছুক্ষণ পর দেখা যায় প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার শিক্ষার্থী চলে আসে এবং পুলিশি বাধা পেরিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ব্লক করে রাখে ঘণ্টা। সেসব চিত্র সারা দেশে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তখন কয়েকজন পুলিশ সরাসরি গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এর পরও আমরা দেশের প্রয়োজনে থেমে থাকিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ এলাকার লোকজন বিভিন্নভাবে হুমকি দেন, যাতে আমরা আর আন্দোলন কাভার না করি। আমি নিজেই ভিডিও করতে গিয়ে আগস্ট কুমিল্লা কান্দিরপাড়ে আওয়ামী লীগের হাতে মারধরের শিকার হই। মারধরের বিচার চাওয়ার মতো পরিস্থিতি তখন দেশে ছিল না। ক্যাম্পাস সাংবাদিক হিসেবে আমার চাওয়া স্বাধীন সাংবাদিকতার পক্ষে যেন রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক দল হস্তক্ষেপ না করে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন