আলোকপাত

ঋণের সাগরে বাংলাদেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে পালালেন মুজিব কন্যা

ড. মইনুল ইসলাম

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান সাড়ে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে গেড়ে বসা নিকৃষ্ট অপশাসক শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে। ওইদিন দুপুরে স্বৈরশাসক হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বোন রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্য-সদস্যাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির জন্য ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষণসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে দেশের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন হাসিনার অপমানজনক ‘রাজাকার’ বক্তব্যের কারণে সরকার উৎখাতের এক দফা সংগ্রামে পর্যবসিত হয়েছিল গত ১৭ জুলাই। আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ অভিহিত করে হাসিনার একটি বালখিল্য উক্তি কোটা সংস্কার আন্দোলনকে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি-ছাত্রদলের সরকার উৎখাতের আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে সহায়তা করেছিল! ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে কারফিউ জারি করে সহিংস আন্দোলন দমানোর চেষ্টা চললেও ক্রমেই আন্দোলনটি অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল, যার পরিণতিতে প্রাণভয়ে পালাতে হলো হাসিনাকে। এটা অনস্বীকার্য যে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে বরবাদ করে দিয়ে হাসিনাই গণ-অভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতকে ডেকে এনেছেন। ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনকে অসম্ভব করে দেয়ার পরিণতি হয় গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার উৎখাত অথবা দেশে অরাজকতা ও নৈরাজ্যকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যেখানে সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে খারাপ পরিণতি হলো স্বৈরাচারী একনায়ককে হত্যা করা। গত সাড়ে ১৫ বছরে হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার একনায়কত্বকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়নি। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গতিশীল অর্থনীতিতে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও এ গণ-অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। ৫ আগস্ট বেলা আড়াইটায় যখন পলায়নরত হাসিনার হেলিকপ্টারটি ঢাকা থেকে উড়াল দেয় তখন লাখ লাখ মানুষের মিছিল ঢাকার বিভিন্ন রাজপথ ধরে শাহবাগ, গণভবন ও সংসদ ভবনের দিকে ধাবিত হয়। প্রায় কুড়ি লাখের মতো মানুষ ঢাকায় জড়ো হয়ে গণ-অভ্যুত্থানটিকে সফল করে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও পলায়ন উদযাপন করে। 

অর্থনৈতিক গতিশীলতা অর্জিত হলেও হাসিনা তার সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে নিকৃষ্টতম ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ মাধ্যমে তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে যে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন তার ভয়াবহ কাহিনী তার পতনের পর উদ্ঘাটিত হতে শুরু করেছে। গত ৭ আগস্ট দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের সহায়তায় কীভাবে এ সাড়ে ১৫ বছরে দেশের জনগণকে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা ঋণের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে হাসিনা দেশ থেকে ভেগে গেছেন বক্ষ্যমাণ কলামে তার বর্ণনা তুলে ধরছি। বণিক বার্তার রিপোর্টের দাবি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এর মানে এ দুই ঋণের স্থিতির অংকের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ওপরে উল্লিখিত ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা।

হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লাখ লাখ কোটি টাকা, যার ফলে এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দেশের এমন একটি প্রকল্পের নাম করা যাবে না যেটির খরচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি ছাড়া কম নয়। এভাবে লুটপাটের অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে হাসিনা বিশ্বের নিকৃষ্টতম ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ গড়ে তুলেছিলেন, যার প্রতিফলন ঘটেছে ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদনে। ওই রিপোর্টে ২০১২-১৭ পর্যায়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের প্রবৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লজ্জাজনক খবরটি প্রকাশ হয়েছিল। হাসিনার সরকার বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করেছে কিংবা বাস্তবায়ন করছে তার তালিকাটা দেখুন: পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা বিআরটি প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া উড়াল সড়ক, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক, মিরসরাই-ফেনীতে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙা-পায়রা-যশোর রেলপথ, যমুনা রেলসেতু, পতেঙ্গা নিউমুরিং টার্মিনাল, আখাউড়া-লাকসাম ডবল লাইন রেলপথ এবং চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। অস্বীকার করা যাবে না যে এ মেগা প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশকিছুটা গতি সঞ্চার করেছে। এগুলো ছাড়াও সারা দেশের গ্রাম ও শহরগুলোয় ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে গত সাড়ে ১৫ বছরে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন হয়েছে। এ সত্ত্বেও হাসিনা জনগণের বিশাল বৃহদাংশের মন জয় করতে পারেননি, তার সরকারকে উৎখাত করেছে গণ-অভ্যুত্থান। কারণ এ প্রকল্পগুলোকে জনগণ পুঁজি লুণ্ঠনের মেগা মওকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে হাসিনার আত্মীয়-স্বজন এবং তার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত দেশের কয়েকশ পুঁজি-লুটেরা পুঁজিপতির ধন-সম্পদের যে অভাবনীয় স্ফীতি জনগণ পর্যবেক্ষণ করেছে তার পেছনে মেগা প্রকল্পের এ পুঁজি লুণ্ঠন প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বলতে গেলে, গত সাড়ে ১৫ বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের মহোৎসব কাল। 

কয়েকটি নিকৃষ্ট প্রকল্পের উদাহরণ দেখুন: পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-মাওয়া-যশোর-পায়রা রেলপথ, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট প্রকল্প। এ প্রকল্পগুলোয় প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি অর্থ ব্যয়িত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম ‘সাপ্লায়ারস ক্রেডিট প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ার ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি আক্ষরিকভাবেই ‘সাদা হাতি প্রকল্প’। দুই ইউনিটের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় হবে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। এর দুটো ইউনিট থেকে নাকি ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে রাশিয়া। রাশিয়ার ঋণের সুদহার হবে ৪ শতাংশ, যা ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৮ বছরে বাংলাদেশকে সুদাসলে পরিশোধ করতে হবে। অনেকেরই জানা নেই যে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ভারতের তামিলনাড়ুর কুদান কুলামে দুই হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপন হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ আমাদের ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ প্লান্টের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিতে হচ্ছে কেন? উল্লিখিত মহলগুলোর পুঁজি লুণ্ঠন কি এর জন্য দায়ী নয়? সম্প্রতি একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প’ দাবি করেছে যে শেখ হাসিনা তার পুত্র জয় এবং শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপের মধ্যস্থতায় এবং একটি মালয়েশিয়ান ব্যাংকের সহায়তায় রূপপুর প্রকল্প থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছেন। (অবশ্য রাশিয়ান ঠিকাদারি সংস্থা রোসাটম এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে)। অতিসম্প্রতি হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রিমান্ডে স্বীকার করেছেন, এস আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি লুট করেছে তার অর্ধেকটাই দিতে হয়েছে জয় ও টিউলিপকে!

দৈনিক বণিক বার্তা ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর খবর প্রকাশ করেছিল যে ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। হাসিনা সরকারের কাছে সততা, জনপ্রিয়তা, জনমত ও জবাবদিহিতার যে কোনো মূল্য ছিল না তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ খামখেয়ালিভাবে গৃহীত নানা প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক, যার মাধ্যমে তিন বছরের মধ্যেই বিদেশী ঋণকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উল্লম্ফন করানো হয়েছে। আমার কলামে আমি গত ১৬ মার্চ সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলাম, ‘অর্থনীতি বিপদে পড়বে যখন ২০২৫ সাল থেকে এ খামখেয়ালিপনার খেসারত হিসেবে ঋণগুলোর সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে যাবে। দেশের প্রধান ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য ডেইলি স্টার’ জানিয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এ উচ্চ প্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আরো দুঃখজনক হলো, এসব ঋণের অর্থে চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হবে তখন প্রকল্পগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতি সামান্য অংশ পরিশোধ করা সম্ভব হবে। বাকি অর্থ জনগণের ওপর দীর্ঘমেয়াদি বোঝা হিসেবে চেপে বসবে’। ওই কলামে আমি আরো লিখেছিলাম, ‘আমাদের বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই এখন ‘সাপ্লায়ারস ক্রেডিট’। সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের অসুবিধা হলো, জোগানদাতারা প্রকল্পের প্লান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেয়ার সময় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দর ধরে ঋণের পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের সুদের হারও সফট লোনের সুদের হারের চেয়ে বেশি, ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম থাকে। আরো গুরুতর হলো, সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ব্যবসায়ী ও আমলাদের ‘মার্জিনের হার’ অনেক বেশি হয়ে থাকে। সেজন্য সাপ্লায়ারস ক্রেডিটকে লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বহুল-ব্যবহৃত মেকানিজম অভিহিত করা হয়। দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সাপ্লায়ারস ক্রেডিট শাসক মহলের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সবচেয়ে মারাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সেজন্য বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্টগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে যাচ্ছে, কারণ এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি লুণ্ঠন এখন শাসক দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের লোভনীয় ধান্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হলে যেহেতু তাদের অনেক কঠিন শর্তগুলো পরিপালনে শাসকরা জটিলতার সম্মুখীন হন তাই বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে সরকার প্রধানত সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছে। বিশেষত গত পাঁচ বছর বেলাগামভাবে অনেকগুলো অত্যন্ত বাজে প্রকল্পে ঋণ গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিকটু আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছে’। 

স্বল্প প্রয়োজনীয় প্রকল্পে যথাযথ ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া খামখেয়ালিভাবে বিনিয়োগের হিড়িকের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে এ ধরনের প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশও শ্রীলংকার মতো ‘মেল্টডাউনে’ পড়তে পারে বলায় ২০২২ সালে হাসিনা ব্যঙ্গ করে আমাকে ‘অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের মে মাসে জার্মান টিভি ডয়চে ভেলে আমাকে এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলায় আমি বলেছিলাম, ‘তিনি আমাকে অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ বলছেন! তা তিনি বলতেই পারেন, কিন্তু আমি আমার অবস্থান বদলাব না’। আরো দুঃখজনক হলো, লুটেরা পুঁজিপতিদের লুণ্ঠনকৃত এ বিপুল অর্থ বেশির ভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি হিসাব দিয়েছে যে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। ৫ আগস্ট হাসিনার সরকার উৎখাতের আগে-পরে দেশ থেকে লুটেরা ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ভেগে যেতে শুরু করেছে। গণ-অভ্যুত্থানে এরই মধ্যে তাদের এ দেশীয় ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা লুটতরাজ, ভাংচুর ও অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু তারা ভেগে যেতে পারলে পাচারকৃত অর্থসম্পদের সহায়তায় বিদেশে তারা আরাম-আয়েশেই জীবন কাটাতে থাকবে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রশমিত হলে আবার দেশে ফিরে এসে রাজনীতিতে জাঁকিয়ে বসার সুযোগও রয়েছে অনেকের। কিন্তু স্বৈরাচারী হাসিনা যে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে ডুবিয়ে দিয়ে পালালেন এ বিপুল ঋণ শোধ করতে গিয়ে অর্থনীতি যে গভীর গিরিখাদে পড়ে যাবে সে মহাবিপদ থেকে আগামী কত বছরে দেশ উদ্ধার পাবে তা বলা মুশকিল! 

ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন