৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া রোগীরা তীব্র প্রাণঘাতী রক্তস্বল্পতায় ভোগে। ফলে রোগীদের শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য বেশকিছু মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হয়, চিকিৎসা না করা হলে যা থেকে অকালমৃত্যু ঘটতে পারে। এজন্য রোগীর জীবনভর রক্ত পরিসঞ্চালন, আয়রন নিষ্কাশন ওষুধ এবং মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেবার মাধ্যমে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। পর্যাপ্ত সহায়ক চিকিৎসা নিয়ে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা অনেকটা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারে।বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের ছোট দেশ হলেও এটি ঘনবসতিপূর্ণ কারণ এখানে প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে আনুমানিক ৬০-৭০ হাজার রোগী ভুগছে মরণঘাতী থ্যালাসেমিয়া রোগে এবং দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহকের সংখ্যা আনুমানিক এক-দুই কোটি, হিসাবে যা মোট জনসংখ্যার ৬-১২ শতাংশ। বাহকেরা নিজেরা সুস্থ হলেও বংশগতির মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগের বিস্তার ঘটাতে পারে, যদি একজন বাহকের সঙ্গে অন্য একজন বাহকের বিয়ে হয়।
থ্যালাসেমিয়ার প্রধান চিকিৎসা হলো নিয়মিত পরিমিত রক্ত গ্রহণ, কিন্তু প্রতি মাসে নিরাপদ রক্ত সংগ্রহ করা রোগীর পরিবারের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ (৬৭ শতাংশ) থ্যালাসেমিয়া রোগী রক্তনির্ভর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত এবং এদের মধ্যে ৪২ শতাংশ রোগীর প্রতি মাসে এক থেকে চার ব্যাগ রক্ত লাগে। বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানকারী ডোনার পাওয়া এক দুষ্কর ব্যাপার। দেশে সংগৃহীত রক্তের ৩১ শতাংশ স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় এবং বাকিটা রোগীর আত্মীয় ও বন্ধুদের কাছ থেকে নিতে হয়। স্বেচ্ছায় রক্তদানের এ হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন থাইল্যান্ড, ভারত ও শ্রীলংকার তুলনায় অনেক কম। থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকা শতভাগ স্বেচ্ছায় রক্তদান নিশ্চিত করেছে এবং ভারতে এ হার এখন ৮৪ শতাংশ। অন্যদিকে সংগৃহীত রক্তের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অপর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা, অব্যবস্থাপনা এবং রক্তের সীমিত শেলফ-লাইফের কারণে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। জেলা পর্যায়ে প্রায় ৪১ শতাংশ রক্ত কেন্দ্রে রক্তের জোগান অপ্রতুল থাকে। নিয়মিত রক্ত জোগাড় করতে অনেক সময়ই বেশ হিমশিম খেতে হয় থ্যালাসেমিয়া রোগী ও তার স্বজনদের। ডোনার পেতে ও রক্ত নিতে দেরি হওয়ার কারণে রোগীর হিমোগ্লোবিন কমে গিয়ে মারাত্মক শারীরিক অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে, যা এ রোগীদের জীবনযাত্রার মানকেও প্রভাবিত করে। অপর্যাপ্ত চিকিৎসার পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ যেমন দুর্বলতা, শারীরিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া, প্লীহার আকার বড় হয়ে যাওয়া, হাড়ের বিকৃতি, এমনকি অকালমৃত্যু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, বাংলাদেশের ১৮৫টি ব্লাডব্যাংকের মধ্যে ১১৬টিই ঢাকা জেলায় এবং বাকি ৬৯টি বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় অবস্থিত। ঢাকা জেলায় ৬৬৬টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থাকলেও ঢাকার বাইরে প্রতি জেলায় গড়ে মাত্র ৬৮টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে। এ তথ্য থেকেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরের চিকিৎসাসেবায় অসাম্য অনুধাবন করা যায়। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য প্রয়োজন ফিল্টারকৃত লোহিত রক্তকণিকা, কিন্তু তা ঢাকায় গুটিকয়েক জায়গা ছাড়া কোথাও সহজলভ্য নয়। শরীরের রক্তের চাহিদা মেটানোর জন্য অধিকাংশ থ্যালাসেমিয়া রোগী এখনো এমন রক্ত (লোহিত কণিকা) গ্রহণ করছে, যা পর্যাপ্ত ও সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত নয়। ফিল্টারকৃত লোহিত রক্তকণিকার পরিবর্তে বারবার হোল ব্লাড (অপ্রক্রিয়াজাত সম্পূর্ণ রক্ত) গ্রহণের কারণে সৃষ্টি হয় নানা শারীরিক সমস্যা ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি। সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থার পাশাপাশি সংগৃহীত রক্ত নিরাপদ কিনা তা যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত স্ক্রিনিং। নিয়মিত রক্ত গ্রহণের কারণে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীরা বিভিন্ন রক্তবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতালের রোগীদের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসা নিতে আসা থ্যালাসেমিয়া রোগীদের মধ্যে হেপাটাইটিস সি ও হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৫ ও ৩ দশমিক ৪ শতাংশ রোগী। যাদের বেশি ঘন ঘন রক্ত লাগে তাদের মধ্যে এসব সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার হারও বেশি।
ঢাকায় উল্লেখযোগ্য থ্যালাসেমিয়া
চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন,
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি
হাসপাতাল, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল
থ্যালাসেমিয়া সেন্টার, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া
ও ক্যান্সার হাসপাতাল, ল্যাব ওয়ান
ফাউন্ডেশন অব থ্যালাসেমিয়া এবং
থ্যালাসেমিয়া সেন্টার বিএসএমএমইউ।
চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে সদস্য রোগীদের
জন্য রয়েছে দিবাকালীন রক্তসঞ্চালন
সেবা, কম মূল্যে ওষুধ
ও টেস্ট। তবে
প্রয়োজনের তুলনায় এসব সুযোগ
খুব সীমিত এবং রাজধানীর
বাইরে এসব সুযোগ নেই
বললেই চলে। শুধু ঢাকা
ও চট্টগ্রামের থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতেই সংগঠিত চিকিৎসা পাওয়া
যায়। সাম্প্রতিক জনশুমারির
তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৮.৩
শতাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস
করে,
তাদের পক্ষে নিয়মিত শহরে
বা রাজধানীতে এসে
চিকিৎসা নেয়া এক দুরূহ
ব্যাপার।
থ্যালাসেমিয়ার আরেকটি
পরিণতি হচ্ছে দেহে অতিরিক্ত
আয়রন জমে যাওয়া, যার কারণে
দেহ থেকে নিয়মিত ও
পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন চিলেশন (নিষ্কাশন)
করা প্রয়োজন। অতিরিক্ত
আয়রন জমে যাওয়ায় দেখা
দিতে পারে যকৃৎ বা
হৃৎপিণ্ডের সমস্যা, যা রোগটিকে
আরো কঠিন করে তোলে। রোগীদের সুস্থতা ও
এর জটিলতাগুলো পর্যবেক্ষণ
ও মূল্যায়নের জন্য বিভিন্ন
মেডিকেল ও সায়েন্টিফিক বিভাগের
সমন্বয়ে মাল্টিডিসিপ্লিনারি চিকিৎসার
প্রয়োজন হয় যেমন শিশু
বিশেষজ্ঞ, রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন, হৃদরোগ
বিশেষজ্ঞ, হরমোনজনিত রোগ বিশেষজ্ঞ,
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, পুষ্টিবিদ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ,
দন্ত চিকিৎসক এবং একটি
শক্তিশালী ব্লাডব্যাংক অবকাঠামো। থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশনের
হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের মাত্র
১০ শতাংশেরও কম রোগী
এ ধরনের সুবিধা ভোগ
করতে পারে। বাংলাদেশের
মতো উন্নয়নশীল দেশে
এ মাল্টিডিসিপ্লিনারি দক্ষতা ও
সুবিধাগুলো সাধারণত বেশির
ভাগ সরকারি
হাসপাতাল এবং বেসরকারি ক্লিনিকে পাওয়া যায় না।
উপরন্তু বাংলাদেশের সাধারণ
জনগণের মধ্যে সামগ্রিক স্বাস্থ্য
সচেতনতা খুবই কম এবং
রোগীদের রেফারেল করার কোনো
ব্যবস্থা নেই। ইউনিভার্সাল
হেলথ কভারেজ না থাকায়
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয়
রোগীরা আরো বেশি এসব অসুবিধার
সম্মুখীন হয়।
আয়রন নিষ্কাশনের
তিন ধরনের ওষুধ রয়েছে
ডেফিরক্সামাইন ইনজেকশন, ডেফেরিপ্রন ক্যাপসুল/ট্যাবলেট
এবং ডেফিরাসিরক্স ট্যাবলেট। এই তিন ধরনের
ওষুধই বাংলাদেশে পাওয়া
যায়, তবে এগুলো বিনামূল্যে
দেয়া হয় না এবং
সব জায়গায় সহজলভ্যও নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে
নিবন্ধিত রোগীদের জন্য সরকারি
হাসপাতালে এ ওষুধগুলো বিনামূল্যে
বিতরণ করা হয়।
ক্রনিক (দীর্ঘস্থায়ী) রোগের রোগী
হিসেবে আলজেরিয়ায় থ্যালাসেমিয়া
রোগীরা ‘শিফা’ কার্ড পায়, এ
কার্ডের মাধ্যমে ফার্মেসি থেকে
তারা বিনামূল্যে ওষুধ
পেতে পারে। পাকিস্তানে
‘সেহাত’ কার্ডের মাধ্যমে দেশের
সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে
স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়, বলা
যায় এটি সমাজের দরিদ্রতম
ও আর্থিকভাবে দুর্বল জনগণের
জন্য এক ধরনের স্বাস্থ্যবীমা। বাংলাদেশে এ ধরনের
কোনো জাতীয় নীতি বা
স্বাস্থ্যবীমা সুবিধা নেই।
জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যবীমার সুবিধা
না থাকায় বেশির
ভাগ রোগী
অপর্যাপ্ত চিকিৎসা নিয়ে ধুঁকে
ধুঁকে বেঁচে থাকে।
সঠিকভাবে আয়রন নিষ্কাশনের চিকিৎসা
নিতে না পারায় রোগীরা আরো নানা শারীরিক জটিলতার সম্মুখীন হয়, যেমন হৃৎপিণ্ড
ও যকৃৎ সংক্রান্ত সমস্যা অথবা হরমোনগত সমস্যা। নিয়মিত
রক্ত গ্রহণ ও লোহিত রক্তকণিকা
ভেঙে যাওয়ার কারণে থ্যালাসেমিয়া
রোগীদের শরীরে অতিরিক্ত আয়রন
জমে যায়, যা শরীরের
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ
যেমন হৃৎপিণ্ড ও যকৃতে
জমে এগুলোকে ধীরে ধীরে
অকেজো করে দিতে পারে। এসব অঙ্গে কী
পরিমাণ আয়রন জমেছে তা
যাচাইয়ের জন্য যে পরীক্ষাগুলো
করা দরকার তা বাংলাদেশে
খুবই সীমিত আকারে শুধু
একটি বা দুটি চিকিৎসা কেন্দ্রে করা হয় এবং
এক একটি টেস্টের খরচ
প্রায় ৭ হাজার (হৃৎপিণ্ড) ও ১০
হাজার (যকৃৎ) টাকা পর্যন্ত (বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া
ফাউন্ডেশন)।
পর্যাপ্ত সহায়ক চিকিৎসা নিয়ে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা অনেকটা
স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারলেও চিকিৎসা না করালে, বিশেষ করে স্বল্প
আয়ের দেশগুলোয়, সাধারণত জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যেই মারা যায় থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত
শিশুরা। বর্তমানে বাংলাদেশে বেশির ভাগ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু শৈশবেই মারা যায়
রোগ নির্ণয় না হওয়ায় বা অপর্যাপ্ত চিকিৎসার কারণে রক্তস্বল্পতায়। চিকিৎসকদের
জন্য সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
২০১৯ সালে থ্যালাসেমিয়া-বিষয়ক জাতীয়
গাইডলাইন প্রকাশ করে, এটি প্রশংসার
দাবিদার, কিন্তু এটির যথাযথ
প্রয়োগ প্রয়োজন।
রক্ত গ্রহণ ও আয়রন নিষ্কাশন
থ্যালাসেমিয়ার সহায়ক চিকিৎসামাত্র, প্রতিকার নয়। এখন পর্যন্ত থ্যালাসেমিয়ার
একমাত্র প্রচলিত প্রতিকার হলো
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন, যা অত্যন্ত
ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ার
জন্য অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন
এখনো অঙ্কুরেই রয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,
এভারকেয়ার হাসপাতাল ও ঢাকা
কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে ক্যান্সার
রোগীদের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের
পাশাপাশি অতি নগণ্য সংখ্যক
কিছু থ্যালাসেমিয়া রোগীর
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা
হয়েছে এবং এতে ১৪
লাখ টাকার মতো খরচ
হয়। অস্থিমজ্জার জন্য
ম্যাচিং ডোনার খুঁজে বের
করতে হয়, প্রায় ৮০
শতাংশ ক্ষেত্রে তা ভাই-বোন
বা আত্মীয়ের সঙ্গে ম্যাচ
করে। অন্যথায় ম্যাচিং
ডোনার খুঁজে পাওয়া বেশ
দুঃসাধ্য ও খরচেরও ব্যাপার,
কারণ জাতীয় পর্যায়ে কোনো
ডোনার রেজিস্ট্রি নেই। গড়ে এ পদ্ধতিতে মৃত্যুঝুঁকি
রয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ, অন্যদিকে
সাফল্যের হার অর্থাৎ থ্যালাসেমিয়ামুক্ত জীবন পাওয়ার হার
মাত্র ৮৩ শতাংশ।
মোটা দাগে, বোনম্যারো
প্রতিস্থাপনের সফলতা নির্ভর করে রোগীর বয়স, বোনম্যারো ম্যাচিং হওয়া ও রোগীর
শারীরিক অবস্থার ওপর।
বর্তমানে জিন থেরাপি নামে
আরেকটি পদ্ধতি জিনগত রোগ
সারানোর ব্যাপারে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যাপক
আলোচিত হচ্ছে এবং থ্যালাসেমিয়ার
ক্ষেত্রে এটি আশার আলো
জোগাচ্ছে। এটি সম্প্রতি
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অনুমোদন পেয়েছে। তবে উন্নত দেশের
এ ব্যয়বহুল পদ্ধতি দক্ষিণ
এশিয়ার রোগীদের হাতের নাগালে
আসতে অনেক দেরি, কারণ বাংলাদেশী
টাকায় এর বর্তমান খরচ
৩০ কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া প্রতিকারজনিত কিছু
ওষুধ রয়েছে তবে সেগুলোর
ব্যবহার নিয়ে আরো গবেষণা
প্রয়োজন। সম্প্রতি অনুমোদিত
আধুনিক একটি ইনজেকশন লুসপ্যাটারসেপ্ট রক্তের হিমোগ্লোবিন ধরে
রাখতে সক্ষম। ভারতে
এটির ২৫ মিলিগ্রাম ওষুধের
দাম বর্তমানে প্রায় ৪১
হাজার টাকা। ইনজেকশনটি
তিন সপ্তাহ পর পর
নিতে হয়, অর্থাৎ ৫০
কেজি ওজনের একজন রোগীর
প্রতি মাসে অন্তত ৯২
হাজার টাকার ইনজেকশন লাগতে
পারে। তাই সব
মিলিয়ে বলতেই হয় যে
থ্যালাসেমিয়ার প্রতিকার ব্যবস্থা অপ্রতুল, কাজেই
প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই।
আউট অব
পকেট হেলথ
এক্সপেন্ডিচারের দিক থেকে
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য
দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে
আছে। রোগীদের এবং
তাদের পরিবারের ওপর থ্যালাসেমিয়ার
আর্থিক প্রভাব অপরিসীম, কারণ
এ দেশে রোগীদের চিকিৎসা, ওষুধ
ও বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা
খরচের একটি বড় অংশ (৭৪
শতাংশ) নিজের পকেট থেকে
বহন করতে হয়।
কিন্তু ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও
শ্রীলংকায় এ হার ৪৫
থেকে ৫৫ শতাংশের মধ্যে।
ন্যূনতম আদর্শ
চিকিৎসা নেয়ার জন্য একজন
থ্যালাসেমিয়া রোগীর মাসে প্রায়
২০ হাজার টাকা খরচ
হওয়ার কথা। বেশির ভাগ
থ্যালাসেমিয়া রোগীর পরিবার নিম্ন
ও মধ্যবিত্ত, যাদের পক্ষে
প্রতি মাসে রোগীর পেছনে
প্রায় ২০ হাজার টাকা
খরচ করা বেশ কষ্টসাধ্য। কারণ থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা ব্যয়
নিম্ন বা মধ্যম আয়ের
পরিবারগুলোর আয়ের একটি বড়
অংশ এবং গড়ে পরিবারের
আয়ের তুলনায় বেশি।
ফলে থ্যালাসেমিয়ার কারণে
একটি পরিবার অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু
হয়ে যেতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৃতপক্ষে একজন
থ্যালাসেমিয়া রোগী চিকিৎসার পেছনে
মাসে গড়ে মাত্র ২
হাজার টাকা খরচ করতে
পারে। আনুমানিক খরচ
ও প্রকৃত খরচের মধ্যে
এ বিশাল ফারাকের ফলাফল
হলো অপর্যাপ্ত চিকিৎসা।
২০১৯ সাল
থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তর ক্যান্সার,
কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড,
জন্মগত হৃদরোগ এবং থ্যালাসেমিয়ায়
আক্রান্ত রোগীদের বছরে এককালীন
জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা হারে
বাজেট প্রাপ্তি সাপেক্ষে আবেদনকারী
দুস্থ রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা
প্রদান করে। এ
অনুদান সর্বজনীন নয়, আবেদনপত্র
যাচাই, প্রার্থীর যোগ্যতা ও
বাজেটের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে
অনুমোদন সাপেক্ষ। যেহেতু
দেশে বিনামূল্যে থ্যালাসেমিয়ার
ওষুধ বা টেস্টের কোনো
সুবিধা নেই, কাজেই দেশের
বিপুল পরিমাণ থ্যালাসেমিয়া রোগীর
সংখ্যা ও চিকিৎসা খরচের
তুলনায় এ বাজেট অপ্রতুল। ভারত, কানাডা ও অন্যান্য
কিছু দেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের
প্রতিবন্ধী সংজ্ঞার মধ্যে গণ্য
করা হলেও বাংলাদেশে আইন
অনুযায়ী এখন পর্যন্ত থ্যালাসেমিয়া
রোগীদের প্রতিবন্ধী হিসেবে
সংজ্ঞায়িত করা হয়নি, যে কারণে
রোগীরা প্রতিবন্ধীদের জন্য
নির্ধারিত সুযোগ-সুবিধা যেমন
প্রতিবন্ধী ভাতা, উপবৃত্তি, চাকরিতে কোটা, বিনাসুদে
ঋণ,
কিংবা যানবাহনে সংরক্ষিত আসন
ভোগ করতে পারছে না।
সমাজ গ্রহণ
করবে না বা সামাজিকভাবে
বৈষম্যের শিকার হতে হবে
এ ভয়ে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা
তাদের রোগের কথা সহজে
প্রকাশ করতে চায় না। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের পরিবার
সামাজিক অনুষ্ঠানে কম
অংশগ্রহণ করে এবং সামাজিকভাবে
তারা একা বোধ করে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অবর্ণনীয়
চাওয়া হলো একটি আদর্শ
সমাজ, যেখানে অসুস্থ ব্যক্তিদের
প্রতি সমাজ ও পরিবারের
দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে এবং তারা
সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিক
সহায়তায় সুন্দরভাবে বেঁচে
থাকতে পারবে।
শারীরিক প্রতিকূলতা
রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও
প্রভাব ফেলে। কিন্তু রোগটিকে
নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যস্ত থাকায়
মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি
অবহেলিতই থেকে যায়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে
প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর সংখ্যা বাড়ার
সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে তাদের জীবনযাত্রার
মান ও মানসিক স্বাস্থ্য
নিয়ে শঙ্কা। আর বয়স
বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগ-সংক্রান্ত জটিলতাও
বাড়তে থাকে। নিয়মিত
রক্ত জোগাড় করতে হিমশিম
খাওয়া, শারীরিক গঠনের কারণে
বুলিংয়ের শিকার হওয়া, চিকিৎসা খরচের
বোঝা, নিজেকে ভালোবাসতে না
পারা, চাকরিতে বৈষম্যের শিকার
হওয়া, পরিবার গঠনের ইচ্ছা
কিন্তু অনিশ্চয়তা—এসব মিলিয়ে
এ যেন আজীবনের এক
যুদ্ধ। প্রাপ্তবয়স্ক রোগীরা
এক পর্যায়ে বুঝতে পারছে
যে পর্যাপ্ত ও নিয়মিত
সঠিক চিকিৎসা বজায় রাখার
মাধ্যমেই আরো বেশিদিন ভালোভাবে
বেঁচে থাকা সম্ভব।
বর্তমানে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন,
খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড,
শিক্ষা এবং কর্মজীবনে অংশগ্রহণে
উৎসাহিত হচ্ছে। অনেক
রোগী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ
করছে, চাকুরি করছে, বিয়ে করে
সন্তান নিয়ে পরিবারও গঠন
করছে। যদিও বাংলাদেশের
রোগীরা এক্ষেত্রে পিছিয়ে
রয়েছে। বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্রে সংগঠিত উপায়ে পর্যাপ্ত
চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা
হলে রোগীদের জীবনে এ
বিষয়গুলো সহজ করা সম্ভব।
ফারহিন ইসলাম: গবেষণা সহযোগী, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)