বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনা

সরকারি হিসাবের চেয়ে ২০১০ ও ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের মাত্রা বেশি ছিল

ইয়াহইয়া নকিব

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে দারিদ্র্যের গড় হার ২০১০ সালে হিসাব করেছিল সাড়ে ৩১ শতাংশ। ছয় বছরের মাথায় ২০১৬ সালে তা নেমে আসে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে। যদিও বিশ্বব্যাংক মনে করছে, সরকারি এ তথ্যের চেয়েও ওই দুই বছরে দেশে দারিদ্র্যের মাত্রা ছিল বেশি। সংস্থাটির এক সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় বলা হয়, ২০১০ সালে দেশে বিবিএসের তথ্যের সঙ্গে গড় দারিদ্র্যের প্রকৃত হারের পার্থক্য ছিল ৫ দশমিক ৫ থেকে ৫ দশমিক ৮ শতাংশীয় পয়েন্টের মধ্যে। সে সময় দেশে দারিদ্র্যের গড় হার ছিল বিবিএসের তথ্যের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। আর ২০১৬ সালে প্রকৃতের সঙ্গে ব্যুরোর তথ্যের ব্যবধান ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট থেকে ২ দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্টের মধ্যে। দারিদ্র্যের গড় হার ছিল প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি। 

দারিদ্র্যের হার নির্ধারণে বিবিএসের খানা আয়-ব্যয়-২০২২ জরিপের তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণে কারিগরি সহায়তা দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী সময়ের দারিদ্র্যের হার পুনরায় যাচাই করে চলতি মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘রিকনস্ট্রাক্টিং ২০১০-২০২২ ‌পভার্টি অ্যান্ড ইনইকুয়ালিটি ট্রেন্ডস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রকাশনায় বিশ্বব্যাংকের এ পর্যালোচনা উঠে আসে। 

এ পর্যালোচনা প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতি বিবিএসের তথ্যের তুলনায় আরো গভীর ও ব্যাপক। এ তথ্য নিয়ে অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনা সেখানে একটি বাড়তি তথ্যগত ভিত্তি দিয়েছে।

এ বিষয়ে বিবিএস-সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো দারিদ্র্য পরিমাপের পদ্ধতিগত পরিবর্তনের ফলে এমনটি হতে পারে। নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বৃহদায়তনের জরিপে পরিসংখ্যানগত কিছু ভুল হতে পারে। আর বিবিএস ও বিশ্বব্যাংকের তথ্যের পার্থক্য পরিসংখ্যান কার্যক্রমে সাধারণভাবে গৃহীত আদর্শ বিচ্যুতিমানের মধ্যেই রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের তিনজন অর্থনীতিবিদ প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন। ঈদের ছুটির পর তাদের কেউ এখনো দেশে না আসায় প্রতিবেদনটি সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদনে ২০১০ ও ২০১৬ সালের বিভাগভিত্তিক দারিদ্র্যের হারও তুলে ধরা হয়েছে। সেখানেও গড় দারিদ্র্যের হারের পরিবর্তন উঠে এসেছে।  

এ বিষয়ে বিবিএসের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে বিবিএসের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং উইংয়ের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. রফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বিশ্বব্যাংকের এমন প্রতিবেদন প্রকাশের বিষয়টি শুনেছি। তবে প্রতিবেদনটি পড়ে দেখা হয়নি। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’ 

বিষয়টি নিয়ে খানা আয়-ব্যয় জরিপ প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। পরে এ নিয়ে কথা বলার জন্য খানা আয়-ব্যয় প্রকল্পের পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বণিক বার্তা। একাধিকবার যোগাযোগ করে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হলেও এ বিষয়ে তার সাড়া পাওয়া যায়নি। 

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০১০ ও ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে দেখানো হলেও চরম দারিদ্র্যের হারের ক্ষেত্রে বেশি দেখানো হয়েছিল। সরকারি হিসাবের চেয়ে দুই মেয়াদেই চরম দারিদ্র্যের হার ৬ শতাংশ কম ছিল। 

বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌দারিদ্র্য পরিমাপের নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে হিসাবটা বদলে গেছে। এটা বাস্তবতার পরিবর্তন না। তবে দারিদ্র্যের হার হিসাবের ক্ষেত্রে এখন ‘উত্তম চর্চা’ প্রয়োগের ফলে এমন পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণের পদ্ধতিগত উন্নতির ফলে এমনটা হয়ে থাকতে পারে। আগে যেখানে খাতা-কলমে তথ্য নেয়া হতো, এখন সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। সামনে হয়তো প্রযুক্তির কল্যাণে আরো ভালো জরিপ পরিচালিত হবে। তখন ফলাফলগুলো আরো নিখুঁত হবে।’

বিবিএসের হিসাবে বলছে, ২০১০ সালে দেশে চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা নেমে আসে ১২ দশমিক ৯ শতাংশে। সর্বশেষ ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। 

২০২২ সালের জরিপে নগরের গৃহহীনদের শহর দরিদ্রের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত না করা এ তথ্যগত ব্যবধানে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে আসা এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘‌২০২২ সালে শহুরে দরিদ্রতার হিসাবে শহরের গৃহহীনদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বিষয়টি তারা আমাকে নিশ্চিত করেছে। ফলে শহুরে দারিদ্র্য অনেক কম দেখানো হয়েছে। কারণ শহরে দারিদ্র্য বৃদ্ধিতে এসব গৃহহীন অন্যতম ভূমিকা রাখছে।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু ভোগের ভিত্তিতে নয়, বহুমাত্রিক ও সমন্বিত পদ্ধতিতে দারিদ্র্যের হার পরিমাপ করতে হবে। এ ধরনের দুটি জরিপের মধ্যে সময়ের ব্যবধানও কমিয়ে আনা প্রয়োজন। এছাড়া বর্তমান পরিসংখ্যান পদ্ধতিতে দারিদ্র্যের হার হ্রাস-বৃদ্ধির কারণ নিয়ে পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা বা পর্যালোচনা পাওয়া যায় না।

‌বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন দেশের অর্থনীতিবিদদের নতুন করে আলোচনার সুযোগ করে দিয়েছে উল্লেখ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগে আমরা সরকারের দারিদ্র্যের হিসাবের সমালোচনা করতাম। এখন বিশ্বব্যাংক সেখানে একটি বাড়তি তথ্যগত ভিত্তি দিয়েছে। আর পাঁচ-ছয় বছর পরপর না করে এটা কয়েক বছর পরপর করতে হবে। এখানে আগের দারিদ্র্যের হার কমে আসার কারণ নিয়ে ব্যাখ্যা দেয়া নেই। তথ্যগত ভুল নাকি পদ্ধতিগত পরিবর্তনের কারণে এমনটা হয়েছে তা এক কথায় বলা মুশকিল।’ 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডাটার মান ও পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া উন্নত হচ্ছে। নতুন নতুন তত্ত্ব আসছে। তাই দারিদ্র্যের হার কম দেখানো হলেও এটা দোষের কিছু না। কারণ বড় আকারের জরিপ পরিচালনার ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ পর্যন্ত ভুল মেনে নেয়া হয়। তাই দুই তথ্যে ৫ শতাংশীয় পয়েন্টের ব্যবধান থাকলেও এটা স্বাভাবিক। বিশ্বব্যাংক এটা নজরে আনায় তাদের ধন্যবাদ দেয়া যায়। আর বিবিএস তাদের তখনকার সক্ষমতার আলোকে এটা করেছিল। এসব কাজ করার আগে বিবিএস টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে কাজ করে থাকে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও থাকেন। সুতরাং তথ্য সংগ্রহ ও তথ্য প্রদানের ত্রুটির কারণে ফলাফলের এমন পরিবর্তন হতেই পারে। আগামীতে ডাটার মান আরো উন্নত হবে।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন