‘আমি দৃষ্টিশক্তি হারালেও চলার পথ হারাইনি’

ছবি : বণিক বার্তা

রুমানা মনজুর, কানাডার সরকারি বিচার বিভাগের আইনজীবী। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ২০১১ সালে রুমানা উচ্চশিক্ষার জন্য কানাডায় ছিলেন। ওই বছরই তিনি ছুটিতে দেশে ফিরলে স্বামীর বর্বর আক্রমণের শিকার হয়ে দুই চোখের দৃষ্টি হারান রুমানা। কানাডার ভ্যাংকুভারের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া (ইউবিসি) তার চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়। সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইনে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন। রুমানা অদম্য সাহস আর দৃঢ় মনোবলের দৃষ্টান্ত আজ। পেয়েছেন ‘কারেজ টু কামব্যাক’ পুরস্কারও। রুমানা মনজুরের জীবনের অমসৃণ পথের গল্প ‍নিয়ে জীবনীমূলক বই Out of Darkness: Rumana Monzur’s Journey through Betrayal, Tyranny and Abuse প্রকাশ পেয়েছে। এ বই এবং জীবনের পথচলা নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবরিনা স্বর্ণা

এ বছর ২৩ এপ্রিল আপনার জীবনীমূলক বই Out of Darkness: Rumana Monzur’s Journey through Betrayal, Tyranny and Abuse প্রকাশ পেয়েছে। বইটি নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।

বইটি লিখেছেন ডেনিস চং (Denise Chong)। চং মূলত যেকোনো ঘটনাকে ওই দেশ বা সমাজের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করে থাকে। আমার ঘটনাও তাই বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতার আলোকে লেখার চেষ্টা করেছেন তিনি। আমার জীবন এবং বাংলাদেশ দুটোই এ লেখার মধ্যে তুলে  ধরা হয়েছে। এটি লেখার জন্য লেখক বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। তিনি খোঁজার চেষ্টা করেছেন কেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যে নির্যাতন, নিপীড়নের ঘটনাগুলো ঘটে। আমি ২০১১ সালে যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, সেগুলো আমি আমার দেশের মানুষকে জানাতে চেয়েছিলাম। বিশেষ করে আমার মেয়ে এবং বর্তমানের তরুণ প্রজন্মকে জানাতে চেয়েছি, আমি দৃষ্টিশক্তি হারালেও চলার পথ হারাইনি। তারা যেন জানে, যেন শিখতে পারে কোন বিষয়গুলো মেনে নিতে হয় না, সহ্য করতে হয় না এবং শেষমেশ সব মেনে নিলে কী পরিণতি হয়! আমার জন্য ওই ভয়াল স্মৃতির মধ্য দিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না, তবু সচেতনতা বৃদ্ধি ও শেখানোর প্রচেষ্টা থেকে আমার মনে হয়েছিল সেসব গল্প মানুষকে জানানো উচিত। এই বই পড়ে যদি একজন মানুষও নিজের জীবন নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবে, তাহলে আমি নিজেকে সফল মনে করব। এই উদ্দেশ্য নিয়েই বইটি লেখা হয়েছে। ওই সময় আমাকে আমার দেশের সর্বস্তরের মানুষ অনেক সহযোগিতা করেছে। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। 

বইটি আমরা কীভাবে পেতে পারি?

বইটি অ্যামাজনে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ থেকেও যাতে কপি পাওয়া যায় সে বিষয়েও কাজ করছি। প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন রেনডম হাউজ কানাডার আইনগত কিছু বিষয় ও প্রটোকল আছে। সেগুলো আমি এখনো জানি না। এসব নিয়ে তাদের সঙ্গে আরো কথা বলতে হবে। আমি অনুবাদের জন্যও চেষ্টা করে যাচ্ছি। তৃণমূল পর্যায়ে যারা সহিসংসতার মুখোমুখি হয়, তাদের জানার জন্য বাংলা ভাষায় লেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি চেষ্টা করব এটা যেন বাংলায় অনুবাদ হয়। অনুবাদের কাজটিও প্রকাশকের সাহায্যে করতে চাচ্ছি। আবার বাংলাদেশের একজন স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি এখনো আইনগত ও কপিরাইটের বিষয়গুলো খুব একটা বুঝি না। তাই প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তারপর হয়তো আমি বুঝতে পারব। দেশে ইংরেজি ভার্সনকে সহজলভ্য করা এক ধরনের বিষয়। আবার এটাকে বাংলায় অনুবাদ করা আলাদা একটি কাজ। এই দুটো বিষয় নিয়ে প্রকাশকের সঙ্গে আমাকে কথা বলতে হবে। 

এ বইয়ের পেছনে শ্রম কতদিনের?

শুরুটা যখন হয়েছিল, তখন আমি বেশ ‍বিরূপ পরিস্থিতিতে যাচ্ছিলাম। আমার মেয়েটাও অনেক ছোট ছিল। আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল। সেসব হয়তো আমি নিজেও ভুলে যাব। এজন্য আমার মনে হয়েছিল, ডকুমেন্ট করে রাখতে চাই। এ উদ্দেশ্য নিয়ে লেখার কথাটি মাথায় আসে। একে একে কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপর আমরা বই লেখা শুরু করি। প্রায় সাত-আট বছর লেগে গেছে। কভিড ও কিছু স্বাস্থ্যগত বিষয় ছিল। সবকিছু মোকাবেলা করে অবশেষে বের হচ্ছে। আমরা খুবই আনন্দিত। এখন মানুষ কীভাবে গ্রহণ করে সেটাই দেখার বিষয়। 

বইয়ের কোন অংশটি আপনার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?

বইটিতে ডমিস্টিক ভায়োলেন্স একটি অংশ। এ অংশটি বইটিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এজন্য বইটির নাম আউট অব ডার্কনেস। এই প্রক্রিয়ায় আমার সঙ্গে ছিল বিশেষ করে আমার কমিউনিটি, পরিবার ও বন্ধুরা সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছে। এটা একদিনে হয়নি। ২০১১ সালে যখন এসেছিলাম তখন সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়েছিলাম। তখন আমি জানতাম না আমার কি করা উচিত। এ সময়ে আমাকে আত্মবিশ্বাস দেয়া—সম্ভব হয়েছে আমার পরিবার, বন্ধু ও কমিউনিটির জন্য। এছাড়া আমি কোনোভাবেই নিজেকে পুনরায় আবিষ্কার করতে পারতাম না। এজন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ। এই প্রক্রিয়াটি বইয়ের শেষের দিকে উঠে এসেছে। লসকোসহ সবার নাম উঠে এসেছে। আমি নিজেকে খুবই লাকি মনে করি। শুধু বাংলাদেশের মানুষ না। আমাকে এখানকার মানুষও এমনভাবেও সহযোগিতা করেছে, একজন মানুষের জন্য এর থেকে বড় পাওয়া আর কিছু নেই। সব কিছুর বিরুদ্ধে একজন মানুষকে যুদ্ধ করা আসলেই ভিন্ন বিষয়। আমি আশা করি, মেসেজ ভালোভাবে সবার কাছে পৌঁছবে। যারা বিভিন্ন কারণে ডিভোর্স নিচ্ছে, নারীর প্রতি বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা পরিবর্তন করবে। 

শিক্ষকতা থেকে আইনজীবী হওয়ার অনুপ্রেরণা কী ছিল? 

শিক্ষকতা থেকে আইন পেশা আমার কাছে ভালো মনে হয়নি। আমি শিক্ষকতাকে খুবই উপভোগ করতাম। আমি শিক্ষক ও ছাত্রদের কাছ থেকে সবসময় অনেক ইতিবাচক শক্তি পেয়েছি। তরুণদের শক্তিটা সবসময় উপভোগ করেছি। দৃষ্টিশক্তি হারানোর পরে আমি এটা কোর্টে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছি। আমার বিরোধী পক্ষের লোকরা আমার বিপক্ষে অনেক নিন্দনীয় কথা বলেছে, তখন মনে হয়েছিল আমি যদি আরো দিক উপস্থাপন করতে পারতাম তাহলে ভালো হতো। কিন্তু আমার আইন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ছিল না। তখন থেকে আইন পেশাটির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। তারপর আমি এখানে (কানাডায়) এসে মাস্টার্স শেষ করি এবং পরবর্তী সময়ে আমি ’ল স্কুলে আবেদন করি। ভাগ্যক্রমে সেখানে অফার পেলাম। ভর্তি হই। পুরো প্রক্রিয়ায় আমার পরিবার তো ছিলই। বন্ধু ও কমিউনিটি সবসময় একটি বিরাট সাপোর্ট হিসেবে কাজ করেছে। এটা আমার পেশা পরিবর্তন করতে সাহায্য করেছে। পরে আমি বুঝতে পেরেছি, শিক্ষকতা পেশাকে আর উপভোগ করছি না। পুরো জীবন আমার কাছে কঠিন হয়ে গিয়েছে। সে সময় কোনটা সহজ হবে কিংবা কঠিন হবে সেই বিষয়ে চিন্তা করারও খুব একটা সুযোগ ছিল না। কিন্তু আমি আইন পেশায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করি। 

আমরা প্রায় বলে থাকি পারিবারিক সহিংসতা থেকে মুক্তি পেতে আর্থিকভাবে সাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আর্থিক সক্ষমতা থাকলেও আপনিও এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর্থিক সক্ষমতার পাশাপাশি আর কী প্রয়োজন এ নির্যাতন থেকে নারীদের রেহাই পেতে? 

আমাদের সমাজে যখন ডিভোর্স হয়, যেকোনো কারণেই হোক না কেন, দোষটা এসে পড়ে মেয়েদের ওপর। মেয়েদের বলা হয় মানিয়ে চলতে। এ বিষয়টি আমার মধ্যেও ঢুকেছিল। এ কারণে এবং সমাজের ভয়ে আমিও বেরিয়ে আসতে পারিনি। যদিও  সমাজে আমার একটা নিজস্ব অবস্থান ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হয়েছিলাম। নারীবাদ, লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে আমি পড়িয়েছি কিন্তু নিজের জীবনে সেসব শিক্ষার প্রয়োগ করতে পারিনি। ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের কারণে ট্রমা তৈরি হয়, আত্মবিশ্বাস ভেঙে যায়। এগুলো আমি পরে পড়াশোনা করে জেনেছি যে আমার মধ্যে এসব লক্ষণ ছিল। আমার আত্মবিশ্বাস ভেঙে যাওয়ায় আমি সব মেনে নিয়েই দিন যাপন করেছি। আর আমার আশপাশেও তখন কেউ ছিল না যারা এগুলো চিহ্নিত করতে পারত। আবার আমিও কখনো কারোর সঙ্গে আমার সঙ্গে হওয়া নির্যাতন প্রসঙ্গে কথা বলতে পারিনি। ফলে কেউ কখনো বুঝতেও পারেনি। সুতরাং অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার পরও যদি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিতত না হয় তাহলে মেয়েরা ভোগান্তির শিকার হতেই থাকবে। আর যারা নির্যাতনকারী, সমাজে তাদের ক্ষমতা বাড়তেই থাকবে।

নারীরা কীভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে?

বাংলাদেশে তো অনেক রিসোর্স আছে। নারীদের রক্ষা করতে কঠোর আইন আছে দেশে। কিন্তু প্রয়োগ নেই। প্রয়োগ করতেও প্রয়োজন সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন। ‍কারণ সমাজের চাপে, সাপোর্ট ছাড়া নারী আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবে না। এরপর আবার মেনে নিয়ে, সহ্য করে সেই জীবনে ফিরে যাবে এবং নির্যাতনের শিকার হবে। আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে আইনের প্রয়োগ কঠিন। আইন প্রয়োগ করতে প্রথমে অভিযোগ করতে হয়। অভিযোগ ছাড়া চার্জশিট তৈরি হবে না। অভিযোগ করতেই নিরুৎসাহিত করা হয় বাংলাদেশের নারীদের। এখন যদি অভিযোগই না করা হয়, তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু করার থাকে না। মোটাদাগে বলতে গেলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন খুব বেশি প্রয়োজন এ ধরনের সহিংসতা দূর করতে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন