৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা মরুতে সহনীয়, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে প্রাণঘাতী

মো. সাইফুল ইসলাম

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও পাবনায় গতকাল তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রির বেশি। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে রাজধানী ঢাকায়ও। তীব্র তাপপ্রবাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিট স্ট্রোকে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে। তাপমাত্রা আরো পাঁচ-সাতদিন একই রকম থাকবে পূর্বাভাস দিচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা। দীর্ঘ এ তাপপ্রবাহ এখন শঙ্কিত করে তুলছে জনস্বাস্থ্যবিদদের। তাদের ভাষ্যমতে, সাধারণ মানুষের কাছে মরুর শুষ্ক আবহাওয়ায় ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা সহনীয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশের ক্ষেত্রে তা মোটেও সহনীয় পর্যায়ের নয়। আর্দ্র আবহাওয়ায় এ তাপপ্রবাহ দীর্ঘ সময়জুড়ে চলমান থাকলে দেখা দিতে পারে সংক্রামক-অসংক্রামক নানা ব্যাধি। এমনকি মানবমৃত্যুরও কারণ হয়ে উঠতে পারে ৪০ ডিগ্রির ওপরের তাপমাত্রা। 

আর্দ্রতার কারণে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোর আবহাওয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির চাপ অনুভূত হয় তুলনামূলক বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে মানবদেহে তাপমাত্রার নেতিবাচক প্রভাবগুলোকে বাড়িয়ে দেয় আর্দ্রতা, বিকিরণ ও বাতাসের গতিপ্রকৃতি। প্রচণ্ড গরমে মানবদেহকে ঠাণ্ডা করার একটি শরীরবৃত্তীয় পদ্ধতি হলো ঘাম নিঃসরণ। মরুভূমির আবহাওয়ায় মানুষ ঘামলেও স্বাভাবিক অবস্থায় তা সাধারণত বোঝা যায় না। কারণ আর্দ্রতা না থাকায় এ ঘাম খুব দ্রুত বাষ্পীভূত হয়ে যায়। কিন্তু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি পুরোপুরি ভিন্ন। গোটা বিশ্বের মধ্যে বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোয়। এ আর্দ্রতার কারণে ঘাম বাষ্পীভূত হতে সময় নেয় তুলনামূলক অনেক বেশি। বিশেষ করে ঘরের বাইরে ছায়াহীন উত্তপ্ত পরিবেশে এ আর্দ্রতার কারণে শরীরের ঘাম নিঃসরণের মাধ্যমে নিজেকে ঠাণ্ডা করার প্রক্রিয়াটি ব্যাপক মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হয়। এ প্রক্রিয়া যত ব্যাহত হয়, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতাও তত কমতে থাকে। এক পর্যায়ে প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়লে তা হয়ে ওঠে হিট স্ট্রোকের কারণ। এমনকি সুস্থ-সবল মানুষও হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন। এক্ষেত্রে রোগীর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা না গেলে তা হয়ে উঠতে পারে স্থায়ী বিকলাঙ্গতা বা মৃত্যুর কারণ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোয় হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর প্রবণতাও বিশ্বের অন্যান্য অংশের চেয়ে বেশি দেখা যায়। 

মানবদেহে প্রতিবেশের তাপমাত্রাজনিত অভিঘাত (হিট স্ট্রেস) পরিমাপের একটি একক হলো ওয়েট বাল্ব গ্লোব টেম্পারেচার (ডব্লিউবিজিটি), যা পূর্ণ সূর্যালোকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৫০ শতাংশ আর্দ্রতাযুক্ত বাতাসের সমপরিমাণ। তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতা ডব্লিউবিজিটিকে যত অতিক্রম করে যায় হিট স্ট্রোক বা উচ্চ তাপপ্রবাহজনিত রোগবালাইয়ের ঝুঁকিও তত বেড়ে যায়। 

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এরই মধ্যে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি অতিক্রম করে গেছে। অধিকাংশ স্থানে বাতাসের আর্দ্রতাও ৫০ শতাংশের বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে গতকাল সকালে বাতাসের আর্দ্রতা সবচেয়ে বেশি ছিল খুলনায় ৮৬ শতাংশ। যদিও তা সন্ধ্যায় ৪৮ শতাংশে নেমে আসে। চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগে সকালে ছিল ৮০ শতাংশ। সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে আর্দ্রতার মাত্রা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ শতাংশে। ময়মনসিংহে তা নেমে আসে ৫৭ শতাংশে। আর্দ্রতার দিক থেকে এর পরের অবস্থানে ছিল যথাক্রমে সিলেট (সকালে ৭৮ ও সন্ধ্যায় ৭৫ শতাংশ), রংপুর (সকালে ৭৩ ও সন্ধ্যায় ৬৭ শতাংশ) এবং বরিশাল (সকাল ও সন্ধ্যায় ৭০ শতাংশ)। রাজধানী ঢাকায় সকাল ও সন্ধ্যায় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল যথাক্রমে ৬৬ ও ৪৪ শতাংশ। রাজশাহীতেও সকাল ও সন্ধ্যায় আর্দ্রতা ছিল সমান ৪২ শতাংশ। 

এ তাপপ্রবাহ কতদিন বজায় থাকবে জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমান যে পরিস্থিতি রয়েছে, তাতে আগামী সাতদিন পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজ করতে পারে। এপ্রিল হলো বছরের সবচেয়ে উষ্ণ মাস। গত বছরের ১৭ এপ্রিল তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৩ ডিগ্রিতে। এ সময়টা হলো বর্ষার আগের সময়। এ সময় আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে।’

তিনি আরো বলেন, ‘গোটা বিশ্বেই উষ্ণতা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে বিশেষ করে ঢাকাসহ নগর অঞ্চলগুলোয় গাছপালা কমে যাচ্ছে। এসির সংখ্যা বেড়েছে। একদিকে বৃক্ষ কমছে, অন্যদিকে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে। ফলে আমাদের এখানে গরমের তীব্রতাও অনেক বেড়েছে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেশকিছু গবেষণায় উঠে এসেছে, তীব্র তাপপ্রবাহজনিত হিট স্ট্রেস জনস্বাস্থ্যে বেশকিছু ঝুঁকি বাড়ায়। এগুলো হলো কিডনি ও হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে পড়া, নিউমোনিয়া, সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়া, শরীরের তাপপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি। এছাড়া তা বয়স্ক ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের শারীরিক অবস্থারও অবনতি ঘটাতে পারে। এর পাশাপাশি উচ্চ তাপপ্রবাহ পরিবেশ ও পেশাগত নানা ঝুঁকি বাড়ায় বলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের (এনএলএম) তথ্যে উঠে এসেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী অ্যানুয়াল রিভিউতে প্রকাশিত ‘পাবলিক হেলথ প্রিপেয়ার্ডনেস ফর এক্সট্রিম হিট ইভেন্টস’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, তীব্র তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। এর ফলে অসুস্থতা ও দুরারোগ্য ব্যাধির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি গর্ভকালীন নানা জটিলতাও দেখা দিতে পারে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাসির উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগে গরমে ৩০-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দেখা গেলেও এখন তা ৪০-৪২ ডিগ্রি বা কোথাও কোথাও সেটিও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতে আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত রোগব্যাধিও বাড়ছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ হওয়ায় আমাদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব বেশি। দীর্ঘমেয়াদি রোগের প্রকোপ বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা ঝুঁকিতে পড়ছে। বর্তমানে যে আবহাওয়া বিরাজ করছে তাতে কেউ স্বস্তিতে নেই। এ অস্বস্তি শারীরিক জটিলতা বাড়ায়। এ মুহূর্তে কোনোভাবেই রোদে যাওয়া যাবে না। যাদের যেতে হবে তারা যেন শরীর ও মাথা ঢেকে যায়। স্বাভাবিক পানি পান বাড়াতে হবে। পানিতে এক চিমটি লবণ দিয়ে পান করতে হবে। লেবু বা ফলের শরবত পান করতে হবে। ঘরের তাপমাত্রা যেন ভ্যাপসা বা অতি গরম না থাকে, সেদিকে নজর দিতে হবে। বাসি-পচা খাবার খাওয়া যাবে না। বাইরের তৈরি শরবত এড়িয়ে চলতে হবে।’

তার মতে, ‘‌দেশের বসতবাড়িগুলো বিশেষ করে শহরের বাড়িগুলো এত ঘেঁষাঘেঁষি করে নির্মাণ করা হয় যে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকে না। ফলে বাইরের চেয়ে ঘরের মধ্যে গরম বেশি থাকে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। উত্তর আমেরিকার মতো কোনো সিদ্ধান্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা যাবে না। সম্পদের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। শুধু জনস্বাস্থ্যবিদরা বা জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এককভাবে কোনো কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারবে না। গরমে গণপরিবহন, চিকিৎসা, বাজার থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে সমন্বিতভাবে নিতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন