ভারতীয় উপমহাদেশে কোন বংশের শাসনামলে ইসলামের প্রসার সবচেয়ে বেশি হয়েছে সে প্রশ্ন করলে মোগল বংশের কথাই আসবে। শাসকরা মুসলিম ছিলেন বলেই কেবল নয়, তাদের শাসনকাল দীর্ঘ হওয়ার কারণেও ইসলামের প্রসার হয়েছে। সেই সঙ্গে মোগল শাসকরা জাঁকজমক পছন্দ করতেন বলে ধর্মীয় উৎসবেও হতো নানা আয়োজন। স্বাভাবিকভাবেই রোজা ও ঈদ উৎসবের ক্ষেত্রেও তা হতো।
চাঁদ দেখার সময় হতেই শুরু হতো আসলে ঈদের প্রস্তুতি। একালের মতো সেকালে চাঁদ দেখা কমিটি না থাকলেও ছিল বাদশাহর দরবারের বিশেষ কিছু অমাত্য। তারা হিসাব-নিকাশ করতেন এবং খবরও জানাতেন। মোগল আমলে দিল্লি, আগ্রায় রোজা পালিত হতো সেকালের নিয়ম অনুসারে। উচ্চবিত্তরা নিজেদের মতো আয়োজন করতেন আর নিম্নবিত্তরা তাদের সামর্থ্য অনুসারে। মসজিদে আগে থেকেই তারাবির প্রস্তুতি নেয়া হতো। মুসলিমরা চেষ্টা করতেন অন্যান্য কাজ সন্ধ্যার আগেই সেরে ফেলার।
বাংলায় রোজা ও ঈদ কী প্রকারে পালন হতো তার একটি উদাহরণ পাওয়া যায় মীর্জা নাথানের লেখায়। ‘বাহারিস্তান-ই গায়েবি’তে তিনি লিখেছেন, ‘কামান থেকে তোপ ছুড়ে ও বন্দুকের গুলিবর্ষণ করে রমজান মাসের আগমনি ঘোষণা করা হয়।’ নাথান বাংলায় এসেছিলেন মোগল নওয়ারার সঙ্গে। ইসলাম খানের আমলের কথা হচ্ছে এখানে। মূলত তার আমলেই ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে ইসলাম আরো প্রসারিত হয়। তিনি ছিলেন সুন্নি মতাবলম্বী। সীমার মধ্যে থেকেই উৎসব পালন করা ছিল রীতি। এরপর ঢাকা ও বাংলা অন্য অনেক সুবাদার ও শাসকের অধীনে ছিল। এ সময়ের মধ্যে পার্থক্য দেখা গেছে রোজা ও ঈদ পালনে।
গত শতকের রমজান
সম্পর্কে লিখতে গিয়ে হেকিম
হাবীবুর রহমান তার ঢাকা
পাচাশ বারাস পাহলেতে লিখেছেন,
‘বড়কাটরা, আহসান মঞ্জিল, হোসেনি দালান, ছোটকাটরার
উঁচু ইমারতের ছাদের ওপর
লোক সময়ের অনেক আগেই
পৌঁছে যেত এবং অধিক
উৎসাহীরা নৌকাসহযোগে নদীর
মাঝখানে গিয়ে চাঁদ দেখত। বিশেষত, বৃদ্ধরা তাদের দৃষ্টিশক্তি
পরীক্ষার জন্য অবশ্যই পৌঁছাত। অতঃপর এ চেষ্টা
চলত যে আমিই সর্বপ্রথম
চাঁদ দেখব। অবশেষে
চাঁদ দেখা গেল।
খুশির একটি হল্লা উঠল। পটকা, বন্দুক ও তোপধ্বনি
চলল এবং এমন আওয়াজ
হলো যে যারা কানে
শোনে না, তারাও শুনে
নিল যে চাঁদ উঠে
গেছে।’
গত শতক যদিও ‘মোগল
আমল;
না,
তবু এ প্রসঙ্গ এসেছে
বড়কাটরা, আহসান মঞ্জিল, হোসেনি দালান
নামগুলোর কারণে। হোসেনি
দালান নির্মিত হয়েছিল শাহ্
জাহানের পুত্র শাহ্ সুজার
আমলে। তার নৌ
সেনাপতি মীর মুরাদ এটি
তৈরি করেন। সেই
সময়ে রোজা ও ঈদ
উদযাপনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল
হোসেনি দালান। এছাড়া
ইসলাম খাঁ, শাহ্ সুজা, শায়েস্তা
খাঁর আমলে বহু মসজিদ, ঈদগাহ
তৈরি হয়েছিল। রোজার
সময় সেসব মসজিদে খতমে
তারাবি, ইফতার ও
বিশেষ দোয়ার আয়োজন হতো, অনেকটা
এখনকারই মতো। তবে
তখন গাওয়া হতো কাসিদা, গজল
ইত্যাদি।
বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে
ঢাকার মতো আড়ম্বরে রোজা
পালিত হতো না।
অন্যতম কারণ ছিল দারিদ্র্য। রোজা নিয়ে আলাদা
করে পরিকল্পনা করার
মতো অর্থবিত্ত মানুষের
ছিল না। বাহারি
ইফতার আয়োজন তারা করতেন
না। একথা এল
কেননা রোজা নিয়ে লিখতে
গেলে একালের লেখকরাও নানা
ধরনের খাবারের বর্ণনা দিতে
শুরু করেন। কিন্তু
রোজা একালে যেমন ইফতারিকেন্দ্রিক, সেকালে তেমন
ছিল না। বাস্তবিক
রোজা ইফতারিকেন্দ্রিক
নয় কিন্তু একালে সে
প্রকারই করা হয়েছে।
তাই রোজা নিয়ে লিখতে
বসলে অনেকেই ইফতারির বাহারি বর্ণনা দিয়ে
থাকেন। একথা সত্য
যে চকবাজারের ইফতারি এ দেশের ঐতিহ্য
কিন্তু তা মোগল আমলে
রোজা বা মোগল আমলে
সমগ্র বাংলার রোজার চিত্র
প্রকাশ করে না।
তাছাড়া চকবাজার ও পুরান
ঢাকার ইফতারির
বৈচিত্র্য একদিনে তৈরি হয়নি, এতে
সময় লেগেছিল বহু দিন। তবে এ-ও সত্য, চকবাজারের
ইফতারিতে আছে
দিল্লি, আগ্রা তথা
মোগল প্রভাব।
সেদিকেও একটু যাওয়া
যাক কেননা লেখার বিষয়
তো মোগল আমলের রোজা
ও ঈদ।
দিল্লি, আগ্রার
রোজার সময় কাজের চাপ
কমিয়ে আনা হতো।
কখনো রোজা হতো তীব্র
গরমে। সে সময়
মানুষ চেষ্টা করত ঘরেই
থাকতে। কিন্তু ইফতারের
সময় তারা একত্র হতেন
দিল্লির জামা মসজিদ, কখনো নিজামুদ্দিন
আউলিয়ার দরগায়। সেখানেই
আয়োজন হতো ইফতারের।
কালের পরিক্রমায় ইফতারের
আয়োজন ও খাবারে পরিবর্তন
এসেছে কিন্তু ওই নির্দিষ্ট
স্থানগুলোতে এখনো রমজানে বিশেষ
আয়োজন হয়।
মোগল বাদশাহরা
রোজা ও ঈদ নিয়ে
অবশ্যই আগ্রহী ছিলেন।
তাদের ওয়াকিয়ানবিশ (ক্রনিকলার) ও ইতিহাস
লেখকদের লেখায় তার প্রমাণ
আছে। তাদের
মধ্যে আবদুল হামিদ লাহোরির
লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যায়। শাহ্ জাহানের সময়কার
এ স্থপতি লিখেছেন, ‘রমজানের প্রতি
বিকালে সদর
মুসাভি খান বাদশাহর
উপস্থিতিতে দরিদ্র মানুষদের জন্য
একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন
করতেন।’ সদর
ছিলেন বাদশাহর
একজন কর্মকর্তা।
তিনি ধর্মীয় নানা বিষয়
দেখাশোনা করতেন। লাহোরি
আরো জানিয়েছেন, ১০৩৭ হিজরির
৩০ রমজান অর্থাৎ ৩
জুন ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দের বিকালে ৩০ হাজার রুপি
দরিদ্রদের মধ্যে দান করেছিলেন
শাহ্ জাহান। এছাড়া
দৈনিক ভাতা ও কিছু
জমিও দান করেছিলেন তিনি।
আবদুল হামিদ লাহোরি
জানিয়েছেন, ঈদের চাঁদ
উঠলে বাদ্য বাজানো হয়েছিল। অর্থাৎ সেকালে ঈদের
আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতো বাদ্য
বাজিয়ে, উৎসবের মধ্য দিয়ে। আর হ্যাঁ, রাজকীয় ক্ষেত্রে
বিষয়টি আনুষ্ঠানিকতা। কেননা একালের মতো
সেকালেও ঈদ উপলক্ষে
বাদশাহর তথা শাসকের
অমাত্যরা তাকে শুভেচ্ছা জানাতে
যেতেন। মোগল আমলে
তা অনুষ্ঠিত হতো ‘দিওয়ান-ই-আম’-এ।
বাদশাহ প্রধান ঈদগাহে
নামাজ আদায় করতেন।
বাদশাহর মতোই মোগল
সাম্রাজ্যের ভেতরে থাকা অন্যান্য
সুবার সুবাদাররা নিজ
নিজ অঞ্চলের প্রধান ঈদগাহ
বা মসজিদে নামাজ আদায়
করতেন। বাদশাহ নামাজে
যেতেন শোভাযাত্রা করে। আশপাশে মানুষ দাঁড়িয়ে
থাকত, বাদশাহ করতেন
দান-খয়রাত।
লাহোরি জানিয়েছেন,
১০৩৭ হিজরির ঈদের সকালে
শোভাযাত্রা করে নামাজে যাওয়ার
সময় বাদশাহ অকাতরে স্বর্ণমুদ্রা
বিলিয়েছেন।
এদিকে আরেক অমাত্য
ছিলেন চন্দ্রভান ব্রাহ্মণ। তিনি লিখেছেন, ‘রাজপ্রাসাদ থেকে
ঈদগাহের উদ্দেশে বাদশাহর যাত্রা ছিল জাঁকজমকপূর্ণ।
গোটা শহরই যেন এ
উদ্দেশ্যে নতুন সজ্জায় সেজে
উঠেছিল। ঘরবাড়ি, হাটবাজার সবকিছু
কারুকাজ করা নানা রঙের
রেশমি কাপড়ে সাজানো হয়। আশপাশের শহর ও
গ্রাম থেকে হাজার হাজার
লোক আগ্রায় জড়ো হয়, সবার উদ্দেশ্য একটাই—বাদশাহকে এক নজর দেখা। রাজকীয় আচার-অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা মীর-ই-তুজুকের তত্ত্বাবধানে শোভাযাত্রার
পথ এবং আশপাশের সব
এলাকা সাজানো হয়।
নানা রঙের পোশাক পরা
অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যের
কুচকাওয়াজে সৃষ্টি হয় উৎসবমুখর
এক পরিবেশের।’
মোগলদের পূর্বপুরুষ ছিলেন
তৈমুর ও চেঙ্গিস খান। মোগলরা চেঙ্গিসের পরিচয়
দিতেন না, নিজেদের বলতেন
তৈমুরের উত্তরাধিকারী।
রোজা ও ঈদ প্রসঙ্গে
তৈমুর প্রাসঙ্গিক।
কেননা সমরখন্দের এ
শাসক তার শহরটিকে রোজার
সময় বিশেষ প্রকারে সাজাতে
পছন্দ করতেন। তৈমুর
একজন বিজেতা হওয়ার পাশাপাশি
ছিলেন নগর নির্মাতা।
সমরখন্দে তিনি প্রচুর ইমারত
ও মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। রোজার সময় সেই
মসজিদ ও শহরকে সাজানোর
বিশেষ নির্দেশনা থাকত
তার পক্ষ থেকে।
তার উত্তর পুরুষ ভারতীয়
উপমহাদেশে সে প্রকারেই রোজায়
নানা আয়োজন করতেন।
পরবর্তীকালেও এ দস্তুর
ছিল। শাহ্ জাহানের
পর আওরঙ্গজেব।
তবে তিনি কিছুটা কমিয়ে
এনেছিলেন জাঁকজমক। এসেছিল
গাম্ভীর্য। তবে বাদশাহী
শান,
শোভাযাত্রা ছিল শাসনের শেষ
পর্যন্ত। বাদশাহরা
ঈদের সকালে বিশাল বহর
নিয়ে ঈদগাহে গমন করতেন। আগের মতোই দুইপাশে
অপেক্ষা করত জনতা (ছবিতে বাদশাহ
দ্বিতীয় আকবরের সময়কালের একটি
ঈদগাহ যাত্রা দেখা যাচ্ছে) এবং
তা পালিত হতো সাম্রাজ্যের
কোণে কোণে। এর
বাইরে সাধারণ মানুষ নিজ
নিজ সামর্থ্য অনুসারে পালন
করতেন রোজা ও ঈদ। তবে সাধারণ দিনগুলোর
চেয়ে বিশেষভাবেই পালন
করা হতো রোজা।
আর ঈদ সব সময়েই
পালিত হয়ে এসেছে মুসলমানদের
প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে।
লেখক: মোগলনামা (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)