২০ মাস ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বাংলাদেশ

অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষত তৈরি করতে পারে

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের অর্থনীতিতে তিন দশকে আর কখনই এত দীর্ঘ সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি স্থায়ী হতে দেখা যায়নি। দেশে ২০ মাস ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান। সরকার কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরেই বাজারে অস্থিতিশীলতা চলছে। সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়ায় এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ অতি কষ্টে জীবনযাপন করছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সুদহার বাড়ানোয় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমবে। বেকারত্ব বাড়বে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে ক্ষত তৈরি করতে পারে। 

বণিক বার্তার প্রতিবেদন অনুসারে, সার্বিক মূল্যস্ফীতি গত অর্থবছরের পুরো সময়ে ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসেও এ ঊর্ধ্বমুখিতা বজায় থাকতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে টানা ২০ মাস ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। নব্বইয়ের দশকে কখনো কখনো মূল্যস্ফীতি বাড়লেও তা খুব বেশি সময় স্থায়ী হয়নি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন উদ্যোগ দেরিতে হওয়ায় এখন কোনো উদ্যোগই তা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে না।  বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সুদের হার বৃদ্ধি করা হলে ভোগের চাহিদা হয়তো কিছুটা সীমিত হবে। তবে এক্ষেত্রে বিনিয়োগও কমে যাবে। আর বিনিয়োগ কমে গেলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমবে,  ফলে দেশে বেকারত্ব বাড়বে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আশানুরূপ হারে বৃদ্ধি পাবে না। ফলে দেশের বেসরকারি খাত নিরুৎসাহিত হবে এবং বিনিয়োগ সীমিত হয়ে আসবে। বিনিয়োগ কমে গেলে আমাদের সরবরাহে ভাটা পড়বে। এভাবে সরবরাহ কমতে থাকলে এমনিতেই মূল্যস্ফীতি বাড়বে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল। বিনিয়োগ বাড়লে সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান অর্থনীতিনির্ভর নয়, এখানকার অর্থনীতি শক্তিশালী করতে বিনিয়োগের ওপর জোর দিতে হবে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের সুদের হার কমিয়ে রাখা উচিত। এখন সুদের হার না কমিয়ে বৃদ্ধি করা হলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, আর উৎপাদন ব্যয় বাড়লে এমনিতেই পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে তো মূল্যস্ফীতিটা থেকেই যাচ্ছে। 

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। এতে কষ্টে দিনাতিপাত করছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। এ রকম দুর্বিষহ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে ২৯টি নিত্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কিন্তু তার কোনো প্রভাব বাজারে পড়ছে না। এতে সাধারণ মানুষের মনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দেশের সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ কাম্য। এছাড়া দ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ও দরকার। 

বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির পেছনে স্থানীয় কারণের চেয়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে বেশি দায়ী করছে সরকার। বলা হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা ও ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। ওই সময় প্রায় একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। ফলে সারা বিশ্ব এক ধরনের সংকটে পড়ে যায়। ব্যাপক মূল্যস্ফীতি শুরু হয়। বাংলাদেশও তার বাইরে থাকেনি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম ক্রমাগতভাবে কমতে থাকলেও বাংলাদেশে দাম সেভাবে কমছে না। বরং উল্টোটাই ঘটছে, দাম আরো বেড়ে যাচ্ছে। কখনো ডিম, কখনো পেঁয়াজ, আলু, সবজি কিংবা কখনো মাছ-মুরগির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাচ্ছে। আর সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। 

যদিও রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত মূল্যস্ফীতির ওপর প্রাথমিক প্রভাব ফেলেছিল, এত দীর্ঘ সময়ের পর এটি একটি বৈধ অজুহাত নয়। অন্যান্য কারণ, যেমন এ সময়ের মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির দুই দফাও মূল্যস্ফীতিতে অবদান রেখেছে। যেহেতু জ্বালানি তেল অর্থনীতির প্রায় সব খাতের জন্য অপরিহার্য, তাই এর দাম বাড়া বেশির ভাগ পণ্য ও পরিষেবা ব্যয়কে প্রভাবিত করে। 

কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশই তাদের মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে শ্রীলংকা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের সংকটকালে দেশটির মূল্যস্ফীতি ৪৯ শতাংশের বেশি ছিল। সর্বশেষ উপাত্তে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটানে আগের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কমেছে। 

দেশে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা এবং বাজার পর্যবেক্ষণ দুর্বলভাবে পরিচালিত। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে সর্বত্রই বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করে সংকটকে কাজে লাগিয়ে কোনো যুক্তি ছাড়াই পণ্যের মূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করে। বাজারে এ ধরনের কারসাজি রোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায়নি। 

সরকারও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়ে মূল্যস্ফীতিতে অবদান রেখেছে, যা বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়িয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ডলারের বিনিময় হারকে কৃত্রিমভাবে বেঁধে রাখা হিতে বিপরীত হয়েছে। টাকার অবমূল্যায়নও মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। কারণ এটি দেশীয় বাজারে আমদানি করা পণ্যের দাম যথেষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ছিল অনুপযুক্ত ও অপর্যাপ্ত। 

বাজারে চাহিদার সঙ্গে জোগানের অসামঞ্জস্য, উৎসমুখ থেকে বাড়তি দামে পণ্য কেনার কারণে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ মুদ্রাস্ফীতির কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে। মোকাম থেকে বাড়তি মূল্যে কেনার কারণে চাইলেও সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না। পণ্যের বাজার তদারকি করে সরকারের ১১টি সংস্থা। দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে কিংবা রোজার সময় সংস্থাগুলো যে যার মতো উদ্যোগ নেয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন তাদের সমন্বিত উদ্যোগ। সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া গেলে বাজারে প্রভাব পড়বে বলে আশা করা যায়। 

বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েই প্রশ্ন আছে। কেউ কেউ বলছেন, ব্যাংক খাতকে বাঁচিয়ে রাখতেই এ আয়োজন। 

মোদ্দা কথা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সরকারের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এটিও সত্য যে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সবসময় ব্যবসায়ীদের চাপে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা যাবে না। এতে সাধারণ জনগণের অপরিসীম ভোগান্তি হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তা ভাঙতে তৎপরতা প্রয়োজন। এটি না করে শুধু অভিযান পরিচালনা করে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর তৎপরতা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ করছি। এদের সিন্ডিকেট দমন না করে দাম নির্ধারণ করলে যে কোনো সুফল পাওয়া যায় না, নিকট অতীতেও সেটি ফুটে উঠেছে। তাই এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এজন্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনে আমদানিকারকের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। এছাড়া নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকেও (টিসিবি) আরো সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। দেশে বাজার তদারকির যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যেন বাজারকে অস্থির করতে না পারে সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন