বিশ্লেষণ

ভর্তুকি বা প্রণোদনা কখনো গতিশীল অর্থনীতির স্থায়ী বৈশিষ্ট্য নয়

আবু তাহের খান

ছবি : বণিক বার্তা

সম্প্রতি সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) বার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনে এক ব্যবসায়ী জানান যে তাদের প্রণোদনা কিংবা ভর্তুকির দরকার নেই। তারা চায় ব্যবসার খরচ যেন কমানো হয়। এ থেকে ধারণা করা যায় যে সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবসা করতে আগ্রহী বাংলাদেশের অন্যান্য উদ্যোক্তার প্রত্যাশাও তাই। বস্তুত ভর্তুকি বা প্রণোদনা কখনো একটি দক্ষ ও গতিশীল অর্থনীতির স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। অথচ সরকার বহু বছর ধরেই অর্থনীতিতে বিশেষত শিল্প ও ব্যবসা খাতে গতি সঞ্চার করা বা সঞ্চারিত গতিকে টিকিয়ে রাখার কথা বলে উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা, নগদ ভর্তুকি ও অন্য নানা উৎসাহ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, এসব সুবিধার একটি বড় অংশেরই যথেচ্ছ অপব্যবহার হচ্ছে এবং এসবকে ঘিরে অহর্নিশ বিভিন্ন লোপাট ও আত্মসাতের ঘটনা ঘটেই চলেছে। উদাহরণস্বরূপ আদৌ কোনো রফতানি না করেও আলু রফতানির ঘোষণা দিয়ে সম্প্রতি নগদ ভর্তুকি বাবদ ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় একটি করপোরেশন, যা নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। 

একইভাবে প্রায় কোনো রফতানি না করেই ‘পণ্য রফতানিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান’ রাখার জন্য বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (সিআইপি) কার্ড পান অনেকেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যেসব উপখাতে সরকার কর্তৃক নগদ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে, তার মধ্যকার অধিকাংশ উপখাতের আওতায় ভুয়া রফতানি চালানের মাধ্যমে নগদ ভর্তুকি গ্রহণ বাবদ কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে এবং একই ধারায় তা এখনো অব্যাহত আছে। 

আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা বা ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখন প্রায় সর্বজনবিদিত ঘটনা। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানির বিপরীতে ১ হাজার ১৯৯ কোটি ডলার অর্থাৎ মোট রফতানির ২২ শতাংশ অর্থই দেশে ফেরত আসেনি। এ-সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি হিসাবটিও একই রকম হতাশাব্যঞ্জক। ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) করা হিসাব অনুযায়ী ২০০৯-১৮ সময়কালে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। আর এ প্রসঙ্গে লক্ষ করা প্রয়োজন যে, বিষয়টি শুধু ওই পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এ পাচারের বাইরেও ওই রফতানিকারকরা এ বাবদ সরকারের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ ভর্তুকি ও অন্যান্য আর্থিক ও নীতিগত সহায়তা গ্রহণ করেছেন, ব্যাংক থেকে হ্রাসকৃত সুদে ঋণ নিয়েছেন (অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা আত্মসাৎ হয়েছে), শুল্ক-কর রেয়াত নিয়েছেন এবং হেন কোনো সুবিধা নেই যা তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে গ্রহণ করেননি।

পাচারকৃত অর্থ, নগদ ভর্তুকি, আত্মসাৎকৃত ব্যাংকঋণ, মওকুফকৃত কর-শুল্ক ও অন্যান্য সুবিধা মিলে ভুয়া রফতানিকারকদের পেছনে রাষ্ট্রের যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ব্যয় হচ্ছে, সে সম্পদমূল্য প্রকৃত রফতানি আয় থেকে বাদ দিলে এ খাতে নিট আয়ের পরিমাণ যা দাঁড়ায়, সেটি মোটেও উৎসাহব্যঞ্জক কিছু নয়; বরং সে প্রকৃত আয়ের পরিমাণ রফতানি উন্নয়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যয়িত সম্পদমূল্যের তুলনায় কখনো কখনো আরো কম হয়ে যায় কিনা সে ব্যাপারেও যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় বাস্তবের এ হতাশাব্যঞ্জক চিত্র ও আশঙ্কা এ অভিমতকেই জোরালো করে তোলে যে, এ ধরনের ভর্তুকি, প্রণোদনা ও অনুরূপ সুবিধাদি অব্যাহত রাখার ধারণা এখন আর সমর্থনযোগ্য নয়। তাছাড়া ওই প্রক্রিয়ায় উল্লিখিত দুর্বৃত্ত শ্রেণী কর্তৃক রাষ্ট্রের যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুণ্ঠিত হচ্ছে, তা যদি প্রতিরোধ করা যেত তাহলে ওই সম্পদকেই সীমিত সম্পদধারী এ রাষ্ট্রের অন্য নানা জরুরি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যয় বা বিনিয়োগ করা যেত; কিংবা ওই পরিমাণ অর্থ জনগণের কাছ থেকে রাজস্ব হিসেবে কম আদায় করলেও চলত এবং এর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিত্তহীন ও নিম্নবিত্তের মানুষ কিছুটা হলেও বাড়তি আর্থিক চাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারত।

কিন্তু সেটি না হয়ে ঘটছে তার উল্টোটি। অসমর্থ ও নিরুপায় সাধারণ জনগণের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের ওপরই চাপানো হচ্ছে একের পর এক নানা অযৌক্তিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বোঝা। আর সে করের অর্থে অসৎ উদ্যোক্তা ও অন্যান্য বিত্তবানের জন্য জোগানো হচ্ছে নানা আঙ্গিকের ভর্তুকি। অথচ সেটি না করে শিল্প ও ব্যবসা খাতের জন্য এমন অনেক কিছু করা যেত, যার ফলে অনুকূল ও আগ্রহোদ্দীপক বিনিয়োগ পরিবেশ তথা নির্ভরযোগ্য অবকাঠামো, অবিঘ্নিত যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাচ্ছন্দ্যময় আমদানি-রফতানি পদ্ধতি, হয়রানিমুক্ত বিধিবদ্ধ শর্তপূরণ প্রক্রিয়া, উদ্যোক্তাবান্ধব রাজস্ব পরিশোধ ব্যবস্থা ও আনুষঙ্গিক যৌক্তিক কাম্যতাগুলো নিশ্চিত হয়। মোটকথা, দেশে বিরাজমান বস্তুগত পরিস্থিতিকে আর যা-ই বলা যাক, ব্যবসাবান্ধব বলা যায় না কিছুতেই।

অতি উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা, ঘাটে ঘাটে চাঁদা পরিশোধ, দপ্তরে দপ্তরে খুশি করা, পদে পদে সময়ক্ষেপণ, ব্যাংকে ব্যাংকে ডলার না পাওয়া, বন্দরে বন্দরে হয়রানি ইত্যাদি মোকাবেলা করে এ দেশে ব্যবসা করা বস্তুতই যুদ্ধে অংশ নেয়ার মতো এক পরিস্থিতি বৈকি! আর এ অবস্থায় অস্ত্রনির্ভর যুদ্ধে যুদ্ধের ভয়াবহতার ফাঁক গলিয়ে কিছু মানুষ যেমন লুটপাটে অংশ নেয়, বাংলাদেশের ব্যবসায়িক যুদ্ধের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি অনেকটাই সে রকম। এখানে প্রকৃত উদ্যোক্তারা যখন নানা বৈরী পরিবেশ মোকাবেলা করে প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার পীড়নের মধ্যেও কোনোরকমে যুদ্ধটা চালিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই একদল ধূর্ত, অসৎ ও লুটেরা বণিক নানা চতুর কৌশলে প্রণোদনা, ভর্তুকি ও আর্থিক সহায়তার নামে কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ অবাধে লুটে নিচ্ছে। আর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রাজনীতিক ও আমলারা সে লুটেরা ব্যবস্থাকেই সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এ কারণে যে, এতে করে তাদের নিজ নিজ সম্পদও রাতারাতি স্ফীত হয়ে উঠার কাজটি অনেকাংশে সহজ হয়ে যায়।

এ অবস্থায় প্রকৃত উদ্যোক্তারা যতই বলুন না কেন যে তাদের ভর্তুকি বা প্রণোদনার দরকার নেই—ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু সে আকুতি ও আর্তনাদ রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কর্ণকুহরকে এতটুকুও স্পর্শ করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ নিজের, নিজ শ্রেণীর ও নিজ অনুগতদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে পরার্থে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো রাষ্ট্র ব্যবস্থা কি গত ৫২ বছরে আমরা গড়ে তুলতে পেরেছি? ফলে ‘সংখ্যালঘু’ প্রকৃত উদ্যোক্তারা যতই ভর্তুকি বা প্রণোদনা বাদ দিয়ে ব্যবসা-অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলুন না কেন, তস্কর ব্যবসায়ী শ্রেণী ও তাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকরা কিছুতেই তা হতে দেবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তার পরও যে ২০২৬ সাল থেকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হওয়ার আশায় সম্প্রতি ৪৩টি রফতানিপণ্যের ওপর থেকে আংশিক ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে, সেটি এরই মধ্যে অনেকটা মন খারাপের ঘটনায় রূপ নিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। ফলে ২০২৬ সাল নাগাদ প্রত্যাশা অনুযায়ী অনুরূপ বাদবাকি পণ্যের ওপর থেকে সমুদয় ভর্তুকি পূর্ণাঙ্গভাবে প্রত্যাহার করে নেয়া হবে কিনা সে ব্যাপার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

সব মিলিয়ে তাই বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এই যে: একদিকে নিষ্ঠাবান, সৎ ও প্রকৃত উদ্যোক্তারা কোনো ধরনের ভর্তুকি ও প্রণোদনা ছাড়াই নিজেদের দক্ষতা, পরিশ্রম ও যোগ্যতা দিয়ে ব্যবসা করে যেতে চান এবং সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কাছে তাদের প্রত্যাশা শুধু এটুকু যে ব্যবসা করার পথে অন্যায় ও অন্যায্য প্রতিবন্ধকতাটুকু যেন না থাকে। অন্যদিকে অসৎ, অদক্ষ ও তস্কর ব্যবসায়ীরা চান অনন্ত ভর্তুকি, যাতে ব্যবসা না করেও ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে তারা ভর্তুকির অর্থ যথেচ্ছ কায়দায় লুটপাট করতে পারেন এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে যে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র লোপাটকারীদেরই পক্ষে। তো যে রাষ্ট্র তস্করের পক্ষে, সে রাষ্ট্রে উদ্যোক্তাদের যদি ব্যবসা-বাণিজ্য করে টিকে থাকতেই হয়, তাহলে সেটি তাদের নিজ যোগ্যতা, পরিশ্রম ও মেধার ওপর নির্ভর করেই থাকতে হবে। বিশ্বাস করতে চাই যে নতুন প্রজন্মের সৎ, শিক্ষিত, সাহসী ও সৃজনশীল উদ্যোক্তারা সেটি পারবেন—তা সেখানে রাষ্ট্র যতই তস্করের পক্ষাবলম্বন করুন না কেন।

আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন