অভিমত

প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশ কি পিছিয়ে থাকবে

পাপলু রহমান

ছবি : বণিক বার্তা

তেল ছাড়া যেমন গাড়ি চলে না, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ তেমন। বিশ্বের সব দেশের সরকার বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করে থাকে। বিনিয়োগপ্রাপ্তিতে নানা সুবিধা দেয়। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাজার এখন অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। বিনিয়োগ থেকে আসে কর্মসংস্থান, বাড়ে রাজস্ব, কমে দারিদ্র্য।

ইংরেজিতে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) তথা প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ হলো এক দেশ থেকে আরেক দেশে সরাসরি বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করা। বিদেশী কোম্পানিগুলো মূলধন হিসেবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি আনে। বিদ্যমান ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা আবার বিনিয়োগ করে। এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানি ঋণ (ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন) নিয়ে বা শেয়ার কিনে বিনিয়োগ করে, যা এফডিআই হিসেবে পরিচিত। 

এফডিআইবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে গ্রহণ করতে হয় নানা ধরনের নীতি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে কোনো কার্যকর বিনিয়োগ নীতিমালা নেই। বিনিয়োগ আকর্ষণে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিনিয়োগের চেয়ে সরকারকে ঋণের পেছনেই বেশি ছুটতে দেখা গেছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে সাড়ে ৫ শতাংশ। এফডিআই বাড়াতে দেশে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ৩৯টি হাই-টেক পার্ক তৈরি করা হয়েছে। নেয়া হয়েছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস ব্যবস্থা। তবু বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৩২৪ কোটি ৯৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার। আগের অর্থবছরে যা ছিল ৩৪৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এ হিসাবে নিট এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ইকুইটি ক্যাপিটাল প্রবাহ ছিল ১৩৪ কোটি ৬৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ইকুইটি ক্যাপিটাল প্রবাহ দাঁড়ায় ৭৯ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার ডলারে। এ হিসাবে নতুন বিদেশী মূলধনি বিনিয়োগ কমেছে ৪০ দশমিক ৯১ শতাংশ। ২০২১ সালের জুন শেষে দেশে ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টকের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৭০ কোটি ২৫ লাখ ১০ হাজার ডলার। ওই বছরের ডিসেম্বর শেষে যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৬০ কোটি ১০ লাখ ৯০ হাজার ডলারে। ২০২২ সালের জুন শেষে ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টকের পরিমাণ হয় ১ হাজার ৩৯৩ কোটি ৭৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার। গত বছরের জুন শেষে যার পরিমাণ হয়েছে ১ হাজার ৩২৭ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার ডলার। এ হিসাবে এক বছরে ইকুইটি ক্যাপিটাল স্টক কমেছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।  

ইউএনসিটিএডির ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩ অনুসারে ২০১৭-২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বার্ষিক গড় এফডিআই এসেছে ২৯২ কোটি ডলার যা জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। ‘রূপকল্প ২০৪১’ অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে হলে বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৬৬ শতাংশের সমপরিমাণ এফডিআই পেতে হবে। প্রশ্ন হলো বিশ্বের ৩৫তম বড় অর্থনীতির দেশ কেন আশানুরূপ বিদেশী বিনিয়োগ পাচ্ছে না? কেন দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও জিডিপির হিসাবে এফডিআইয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ? এ অঞ্চলে মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার মতো দেশও জিডিপির শতাংশ হিসাবে এফডিআইয়ে এগিয়ে। ২০২২ সালে মালদ্বীপ এফডিআই পেয়েছে ৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার যা জিডিপির প্রায় ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। ওই বছর ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়া শ্রীলংকা পেয়েছে ৮৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার যা দেশটির জিডিপির ১ দশমিক ২০ শতাংশ। দেশ দুটি মূলত এফডিআই সুরক্ষায় নীতিমালা প্রণয়ন করে তা কার্যকর করেছে। মালদ্বীপ যেমন পর্যটন খাতে মনোযোগ দিয়েছে, শ্রীলংকাও কৃষি, পর্যটন ও তথ্যপ্রযুক্তিতে গুরুত্ব দিয়েছে।

কভিড সংকট, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী এফডিআই প্রবাহ নিম্নমুখী ছিল। তা সত্ত্বেও অনেক দেশ এফডিআই আকর্ষণ করতে পেরেছে। বিদেশী বিনিয়োগে বাংলাদেশের নীতিগত ও পরিচালনগত দুর্বলতা রয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছে বিকল্প থাকায় তারা পছন্দমতো দেশ নির্বাচন করতে পারে। যেসব দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নিরাপদ ও সুযোগ-সুবিধা বেশি সেসব দেশ তারা বেছে নেয়। আশির দশক-পরবর্তী ভিয়েতনাম, চীন, মেক্সিকো ও ভারতের মতো দেশ অর্থনৈতিক বিকাশ লাভ করে। সে সময় দেশগুলো ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে এফডিআই আকর্ষণ করতে পেরেছিল। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলেও রয়েছে এফডিআই। দেশটিতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও একই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দেশে ১৮৪ কোটি ৫০ লাখ ডলারের এফডিআই এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ২১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। সে হিসাবে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ কম। এই পাঁচ মাসে ৬৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের নিট এফডিআই এসেছে দেশে। গত বছরের এই সময়ে এসেছিল ৭৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। নিট এফডিআই কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। কারণ হিসেবে ব্যবসা সহজীকরণে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, তথ্যের ঘাটতি, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকের অভাবকে বিবেচনা করা যায়। আবার ডলার সংকট, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা ও জ্বালানি সংকটের মতো বিষয় তো রয়েছেই। এসঅ্যান্ডপি, মুডি’স ও ফিচ রেটিংয়ে আমাদের ঋণমানের অবনমন হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশী নাগরিকদের কাজের অনুমতি পেতে দেরি, জমির ইজারা ও বন্দরে শুল্ক জটিলতার মতো অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে পরিবহন, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, বিনিয়োগবান্ধব করনীতি ও অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

যোগাযোগ খাতে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বিজনেস হাব হিসেবে বাংলাদেশ বিবেচিত হচ্ছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বিদেশীদের জন্য ব্যবসায় সহজীকরণে বাংলাদেশকে বিনিয়োগবান্ধব নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করতে হবে। সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগকারীদের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন ও ইউটিলিটি সার্ভিসের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা প্রদান এবং বিভিন্ন সেবার জন্য ননস্টপ সার্ভিসও চালু করেছে। এখনো উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় সেখানে আশানুরূপ বিনিয়োগ মিলছে না। গত অর্থবছর দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে এফডিআই এসেছে প্রায় ৪২ লাখ ডলার।

দেশে বিদেশী বিনিয়োগে বস্ত্র খাত, টেলিকমিউনিকেশন, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম, বিদ্যুৎ, খাদ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কেমিক্যাল ও ওষুধ, নির্মাণ ও সার খাতে এগিয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আসে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, চীন, নেদারল্যান্ডস, হংকং, নরওয়ে, ভারত, মালয়েশিয়া ও জাপান থেকে। প্রয়োজনীয় কিছু আইনি, আর্থিক ও নীতিগত ব্যবস্থা সংস্কার করা গেলে এসব খাতে বিনিয়োগ আরো বেড়ে যাবে। বিদ্যমান ব্যবসার পাশাপাশি আমাদের নতুন নতুন বাজার ধরতে হবে। যেসব দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী তাদের সুযোগ দিতে হবে। সেমিকন্ডাক্টর, ব্লু ইকোনমি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাজার বিস্তৃত করতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে স্যামসাংসহ ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ফলে এই খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক মোবাইল উৎপাদন সক্ষমতা তিন কোটির ওপরে। এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্য যদি রফতানিমুখী করা যায়, তাহলে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে, কর্মসংস্থানও বাড়বে। প্রতিবেশী ভারত ও চীন গাড়ির বাজার ধরেছে। আমাদেরও এসব বাজার তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। শুধু বস্ত্র খাতে ইউরোপের ওপর ভর করে থাকলে চলবে না। দেশের প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। প্লাস্টিকের খেলনা, জুতা ও গাড়ির টিউবের বাজার ধরলেও ক্ষতি হবে না। 

বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে গত মাসে ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‌বিশ্বব্যাংক। এতে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের সম্ভাব্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি, রফতানি এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে সুখবর নেই। সংস্থাটির আশঙ্কা, চলতি অর্থবছরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিম্ন পর্যায়ে থাকবে। সেক্ষেত্রে সরকারকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে হতে পারে। চাপ থাকবে মূল্যস্ফীতিরও। বাধাগ্রস্ত হবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ। হ্রাস পেতে পারে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও। এ পরিস্থিতিতে সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যারা বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে, তাদের যত্ন নেয়া। 

এফডিআই আকর্ষণে সরকারকে সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। বিনিয়োগবান্ধব করনীতি, আইনি পরিবেশ, দ্রুত মেগা প্রকল্প সম্পন্ন, রাজনৈতিক টানাপড়েন, নীতি ধারাবাহিকতা, ইউটিলিটি ও বিনিয়োগ সেবার দিকে একযোগে নজর দিলে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাবে। জিডিপির হিসাবে এফডিআইয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকা ও মালদ্বীপের চেয়ে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা মানায় না। 

পাপলু রহমান: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন