লোফটাস হল: অশরীরীর আনাগোনা যে বাড়ির আকর্ষণ

বণিক বার্তা অনলাইন

ছবি: দ্য লিটল হাউজ অব হররস

সরকারি নজরদারিতে চলছিল বাড়িটির ছাদের গর্ত মেরামত। কিন্তু কোনোভাবেই কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। যতবারই মেরামত করতে যাচ্ছেন মিস্ত্রীরা, কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বাড়িটিকেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করে আয়ারল্যান্ড সরকার।

বাড়িটির নাম লোফটাস হল, যাকে ঘিরে প্রচলিত আছে ভৌতিক ও অশরীরী গল্প। লেখাও হয়ে গেছে অনেক বই।

আয়ারল্যান্ডের ছোট একটি উপদ্বীপে অবস্থিত লোফটাস হলের ইতিহাস প্রায় ৭০০ বছরের পুরোনো। সতের শতকের শেষের দিকে বাড়িটি কিনে নেন টটেনহ্যাম নামের এক লোক। স্ত্রী লোফটাসের নামেই নামকরণ করেন লোফটাস হল। 

এর আগে বাড়িটির মালিকানা ছিল রেডমন্ডের উত্তরাধিকারীদের কাছে। সম্ভবত সেখান থেকে কিছু কিংবদন্তির উৎপত্তি। নির্জন দ্বীপে রেডমন্ডের বাড়ি বানানোর গল্পটাও বেশ চমকপ্রদ। ১১৭০ সালে একদিন রেডমন্ড লে গ্রস নামের নরম্যান নাইট পথ হারিয়ে সাগর জলে ভাসতে ভাসতে এ দ্বীপে নোঙর করেন। স্থানটির সৌন্দর্যে এতই মুগ্ধ হন যে, এখানেই ছোট কুটির বানিয়ে থাকতে শুরু করেন। সমুদ্রের সতেজ বাতাস ও স্নিগ্ধ প্রকৃতির কোলে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে তার বংশপরম্পরা।

১৪ শতকের মাঝামাঝিতে রেডমন্ডের বংশধরেরা ছোট বাড়িটির সংস্কার করেন। রাতারাতি বিশাল অট্টালিকা তৈরি করে ফেলেন তারা। মূলত তখন থেকেই যেন ঝামেলা সঙ্গী হয়ে উঠে বাড়িটির। ১৬৪১-৫৩ সালের যুদ্ধে রেডমন্ডের এক উত্তরসূরি ইংরেজ প্রশাসন ও অলিভার ক্রমওয়েলের বিরুদ্ধে গিয়ে সহযোগিতা করেন বিদ্রোহী আইরিশ ক্যাথলিক সৈন্যদের। যার ফলে বাস্তুচ্যুত হতে হয় রেডমন্ড পরিবারকে। আর সুযোগে বোঝেই বাড়িটি কিনে নেন টটেনহ্যাম। নাম দেন লোফটাস হল। এর কিছুদিন পর শহুরে বাসভবন ছেড়ে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে পাড়ি জমান সেখানে।

সমুদ্রের কূল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ২২টি কামরা ও ৯৭টি জানালা বিশিষ্ট বিশালাকার বাড়িটি একসময় বেশ দূর থেকে নাবিকদের দৃষ্টি কাড়তে শুরু করে। তবে শুধু সৌন্দর্য যে স্থাপনাটির বিশেষত্ব ছিল, তা নয়। বাড়িটি হয়ে উঠেছিল উত্তাল সামুদ্রিক ঝড়ে বিধ্বস্ত নাবিকদের একমাত্র আাশ্রয়। গৃহকর্তা টটেনহ্যামও সবাইকে আশ্রয় দিতেন। নাবিকদের আতিথেয়তায় আয়োজন করতেন সুস্বাদু ভোজনের। তারপর আড্ডা-গল্প ও মহাসাগরে দাপিয়ে বেড়ানোর রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনেই সবাই কাটিয়ে দিত রাত।

দুই মেয়ে অ্যান ও এলিজাবেথ আর স্ত্রী লোফটাসকে নিয়ে হাসি আড্ডায় এভাবেই কাটতে থাকে টটেনহ্যামের জীবন।

বিপত্তি বাঁধে এক রাতে। ওই রাতেও মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সমুদ্র ছিল উত্তাল। টটেনহামের বাড়ির পাশে নোঙর করে একটা জাহাজ। সেই জাহাজ থেকে কেবল একজন যুবক নেমে এসে আশ্রয় চায় তার কাছে। টটেনহামও সরল মনে আশ্রয় দেন সেই যুবককে। বড় মেয়ে বলে যুবকের আতিথেয়তায় নিয়োজিত থাকে অ্যান। পরের দিনগুলোতেও সমুদ্র ছিল উত্তাল। তাই যুবক থেকে যায় লোফটাস হলেই। এর মধ্যে অ্যানের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। একসময় বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা কাটাতে শুরু করে অন্তরঙ্গ সময়।

সে রকমই এক দুপুরে দুজন বসে ছিল চেয়ারে। সামনে রাখা টেবিল থেকে কিছু একটা নিচে পড়ে যাওয়ায় সেটি তুলতে নিচু হলো অ্যান। এর পরপরই বীভৎস এক ভয়ে কাঁপুনি দিয়ে উঠল তার শরীর। নিচে যা দেখল অ্যান, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে!

অ্যান দেখতে পায় তার প্রেমিকের পা দুটো অশরীরীর পায়ের মতো লম্বা। পায়ের পাতা দুটো যেন কেউ কেটে উল্টো করে জোড়া দিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে কুৎসিত কালো নখগুলোও চোখ এড়ায় না তার। বিকট চিৎকারে জ্ঞান হারায় অ্যান।

আচমকা এমন চিৎকারে ছুটে আসে পরিবারের সবাই। দেখতে পায় অ্যান পড়ে আছে মাটিতে। বাড়ির ছাদে বিশাল এক গর্ত, যেন অস্বাভাবিক কিছু সেটি ভেদ করে আকাশের দিকে উঠে গেছে। আশপাশে খোঁজাখুঁজি করে দেখেন কোথাও নেই সেই আশ্রিত নাবিক। জ্ঞান ফিরলে বাবা-মাকে সবটা জানায় অ্যান। তারপর আবার অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে অ্যান। বাধ্য হয়ে তাকে হলের টেপেস্ট্রি রুমে আটকে রাখেন তারা। কিছুদিন যাবার পর টটেনহাম ও তার স্ত্রী বুঝতে পারে অ্যান সন্তানসম্ভবা।

দেরি না করে তখনই চার্চের ফাদারকে ডেকে আনেন তারা। বিস্তারিত শুনে ফাদার জানার অ্যানের গর্ভ থেকে যে সন্তান জন্ম নেবে সে মানুষ নয়, প্রেতাত্মা। তাই জন্মের পরপরই বাচ্চাটিকে হত্যা করতে হবে। যথারীতি অ্যানের বাবা-মা শিশুটিকে মেরে সেই টেপেস্ট্রি রুমেই মাটিচাপা দেন। এ কাজের জন্য একজন ধর্মযাজককেও নিয়ে এসেছিলেন তারা। কিন্তু এরপর থেকেই লোফটাস হলে ঘটতে থাকে নানান রকম অস্বাভাবিক ঘটনা।

একটা সময় যে লোফটাস হলকে ঘিরে ছিল সমুদ্রের সতেজ বাতাস আর শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতি। সেখানেই ঘুরে বেড়াতে থাকে অশরীরী আত্মারা। রাতের বেলায় মনে হতো বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে, হাতের ইশারায় কাছে ডাকছে। ঘুম-গোসল ও খাবার সময়ও কেউ বসে রয়েছে পেছনে! একসময় টটেনহ্যাম পরিবার বাড়িটি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চলে যান দূরে, জনবহুল এক লোকালয়ে। পেছনে রেখে আসেন অসংখ্য সুখস্মৃতি।

তবে টট্যানহামের ফেলে আসা সেই বিশাল শূন্য বাড়িতে নাবিকেরা তখনও আশ্রয় নিতে থাকেন। সমুদ্রের উত্তাল ঝড়ের কবলে পড়ে মারা যা্ওয়ার চেয়ে পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নেয়াকে সমীচীন মনে করতেন তারা। তারাও টের পেতে থাকেন অশরীরীর উপস্থিতি, মুখোমুখি হন অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার।

এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। লোফটাস হলের অতিপ্রাকৃত ঘটনাগুলো মানুষ মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। হয়তো অদ্ভূত মূল গল্পের সঙ্গে যোগ হয়েছে রঙচঙ। অতিরঞ্জনের ছটায় তৈরি হয়েছে বিচিত্র সব গল্প।

এসব ভেবেই বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এসে তাঁবু টানিয়ে থাকতে শুরু করে লোফটাস হলের আশপাশে। তাদের অনেকেই নাকি দেখতে পেয়েছেন ছায়ামূর্তিদের ঘুরে বেড়াতে। পরবর্তীতে দর্শনার্থীদের সুরক্ষার কথা ভেবে বাড়িটি বাজেয়াপ্ত করে কর্তৃপক্ষ। নিষিদ্ধ করা হয় জনসাধারণের অবাধ আসা-যাওয়া। একসময় সরকারিভাবে ছাদে তৈরি হওয়া গর্তটিও মেরামতের সিদ্ধান্ত হয়। তবে যখনই মেরামতকাজ শুরু হয়, তখনই শিকার হতে হয়েছে কোনো না কোনো দুর্ঘটনার। আর তাই বিরক্ত হয়ে একসময় বাড়িটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সরকার।

অতিপ্রাকৃত ঘটনায় মানুষের আগ্রহ বরাবরই বেশি। গা ছমছমে রহস্য এখনো মানবমনে ভীতির সঞ্চার করে, শিহরণ জাগায় হৃদয়-আত্মায়। এসব রহস্যময়তাকে শৈল্পিক রূপ দিতে ২০২১ সালে বেশ চড়া মূল্যে লোফটাস হল কিনে নেয় এক হোটেল মালিক। রহস্য-রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষদের জন্য ভিন্নধর্মী ভূতুড়ে হোটেল তৈরিই হচ্ছে তার লক্ষ্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন