মানমাত্রায় পরিবর্তন এনে উন্নতি দেখাতে চায় পরিবেশ অধিদপ্তর

আল ফাতাহ মামুন

ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীগুলোর একটি ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বায়ুমানের বৈশ্বিক সূচকে (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই) গত রাতেও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীগুলোর তালিকায় ঢাকা ছিল শীর্ষে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ রাজধানীর বাইরের শিল্পাঞ্চলগুলোয় দূষণ ঘটছে সহনীয় মাত্রার অনেক বেশি। কারখানার রাসায়নিক বর্জ্যনিঃসৃত দূষিত পদার্থ মিশছে কৃষিজমি ও নদী-খাল-বিলসহ জলাশয়ের পানিতে। হুমকিতে প্রাণ-প্রতিবেশ, বাস্তুসংস্থান ও জনস্বাস্থ্য। বিষয়টি নিয়ে দিনে দিনে উদ্বেগ বাড়ছে পরিবেশবিদসহ সংশ্লিষ্ট সবার। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে বা ভূমিকা রাখতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তরও। অভিযোগ উঠেছে, ব্যর্থতা ঢাকতে এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে দূষণের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রাই বদলে ফেলছে সংস্থাটি। পরিবেশ বিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই নেয়া হচ্ছে দেশের পরিবেশ সূচকে উন্নতি দেখানোর প্রয়াস। 

বিষয়টিতে আপত্তি তুলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূষণের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রায় কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হলে বা এটিকে শিথিল করা হলে তা দেশের সার্বিক পরিবেশের জন্য কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। একদিকে বাড়বে প্রতিবেশগত বিপর্যয়, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক।

দূষণের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রায় পরিবর্তন আনতে এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধিমালায় পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এরই মধ্যে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালায় জনগুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে ভাটার গ্রহণযোগ্য দূরত্বসংক্রান্ত নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এছাড়া কিছু বিধিমালায় পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। এসব বিধিমালায় দ্রুত পরিবর্তন আনতে চায় পরিবেশ অধিদপ্তর। বিধিমালাগুলো হলো পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ২০২৩; কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১; বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২; চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও বাজারজাত) বিধিমালা, ২০০৮; বিপজ্জনক বর্জ্য ও জাহাজ ভাঙার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিধিমালা, ২০১১; প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৬; শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ ইত্যাদি।

মানমাত্রা সংশোধন করে ধীরে ধীরে সব বিধিমালায়ই পরিবর্তন আনা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভিন্ন মহল থেকে নির্ধারিত মানমাত্রা দ্বিগুণ-তিন গুণও বাড়ানোর তদবির-সুপারিশ রয়েছে। এমনকি রীতিমতো চাপপ্রয়োগও করা হচ্ছে। এর একটি উদাহরণ হলো পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ২০২৩। গত বছরের মার্চে পাস হওয়া বিধিমালায় দূষণের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। বিধিমালার তফসিল-৫ শিল্পশ্রেণীভিত্তিক তরল বর্জ্য নির্গমনসংক্রান্ত বিধিতে বলা হয়েছে, ট্যানারি শিল্পে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) থেকে সর্বোচ্চ দুই হাজার লিটার সোডিয়াম ক্লোরাইড নিঃসরণ করা যাবে। কিন্তু বর্তমানে সাভারের ট্যানারিপল্লীর সিইটিপি থেকে সোডিয়াম ক্লোরাইড নিঃসরণ হচ্ছে পাঁচ হাজার লিটারের বেশি। শিল্প মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে তাই নির্ধারিত মানমাত্রা দ্বিগুণ করার দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন মহল থেকে পানি ও বায়ু দূষণের মানমাত্রায়ও পরিবর্তনের জন্যও চাপ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌শুধু ব্যবসায়ী নয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকেও আমাদের ওপর চাপ আছে। বিধিমালা পরিবর্তনের বিষয়টি দ্রুত করা হবে। এসব পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তি হিসেবে বিভিন্ন দেশের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার উদাহরণ টানা হচ্ছে। যদিও এসব দেশের বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের বাস্তবতার অনেক অমিল রয়েছে।’

পরিবেশ বিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারায় পরিবেশ অধিদপ্তর দীর্ঘদিন থেকেই ইমেজ সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় নিজেদের ভাবমূর্তির সংকট কাটাতে ও বিভিন্ন মহলের চাপে মানমাত্রা সংশোধনের বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি। 

দূষণের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রায় পরিবর্তন আনতে হলে এতে বিশেষজ্ঞসহ অংশীজনদের মতামত নেয়া অত্যাবশ্যক বলে মনে করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পানিতে আর্সেনিকের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রা দিয়েছে দশমিক শূন্য ১। আমরা সেটাকে দশমিক শূন্য ৫ রেখেছি। আমরা দেখেছি আমাদের দেশে এটা সহনীয়। কিন্তু তাই বলে যে সব মানমাত্রায় গণহারে পরিবর্তন করা হবে, আর এজন্য বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টানা হবে তা মোটেও মেনে নেয়ার মতো নয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের এ উদ্যোগের বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে। তারা কোনোভাবেই অংশীজনদের পরামর্শ না নিয়ে এমন কাজ করতে পারে না।’

২০১৯ সালে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ হয় ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন। এতে বলা হয়েছিল, ‌সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, আবাসিক এলাকা, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, বাগান, জলাভূমি, কৃষিভূমির সীমানা এবং বিশেষ কোনো স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের সীমা থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে। কিন্তু এর এক বছর পরই ২০২০ সালে আইনটিতে সংশোধনী এনে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সংশোধনীতে উল্লিখিত স্থাপনাগুলোর সঙ্গে ইটভাটার গ্রহণযোগ্য দূরত্ব ৪০০ মিটারে নামিয়ে আনা হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মানমাত্রায় পরিবর্তন আনতে হলে তা হতে হবে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। দেশের মানুষ বর্তমান দূষণই সহ্য করতে পারছে না, আরো বেশি মাত্রার দূষণ কীভাবে সহ্য করবে? অন্যান্য দেশের মানমাত্রা বাংলাদেশের জন্য অনুসরণ করতে গেলে বাস্তবতাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। যেমন বাংলাদেশে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার আছে। জাপানের মানুষ নদীতে গোসল করে না। তাহলে সেখানে সোডিয়াম ক্লোরাইড চার হাজার বা ৪০ হাজার লিটার ডিসচার্জ করলেই ক্ষতি কী। কিন্তু আমার দেশের মানুষ তো নদীতে গোসল করে, কাপড়-থালাবাসন ধোয়। এখানে দূষণ কীভাবে আরো নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে উদ্যোগ না নিয়ে নেয়া হচ্ছে মানমাত্রা বাড়ানোর উদ্যোগ!’ 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌এখনো বিষয়টি আমার নজরে আসেনি। তবে আমরা এতটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, যেসব বিধিমালা আমরা করেছি এবং করব সেখানে যে মানমাত্রা দেয়া হবে, সেটা অবশ্যই বিজ্ঞানভিত্তিক হতে হবে। ব্যবসায়ী বা কোনো গোষ্ঠীর চাপে মানমাত্রা বাড়াব-কমাব, এমনটি হওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হবে পরিবেশকে বাঁচানো।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন