ঋণচুক্তির ৮ বছর

সমীক্ষায় আটকে আছে দেশেই রেল কোচ তৈরির উদ্যোগ

ইয়াহইয়া নকিব

রেল খাতে ২০১১ সালে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের পর থেকে বরাদ্দ বাড়তে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছর রেলে বরাদ্দের পরিমাণ ১৪ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর ধরে প্রায় একই হারে বরাদ্দ পেয়ে আসছে খাতটি। এসব টাকায় কেনা হয়েছে নতুন ইঞ্জিন-কোচ। বসানো হয়েছে নতুন লাইন। সম্প্রসারিত এসব রেললাইনে নতুন কোচ চালুকরণে আমদানির চেয়ে দেশেই সাশ্রয়ী মূল্যে কোচ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০১৫ সালে। কিন্তু সম্ভাবনাময় এ উদ্যোগ এখন পর্যন্ত সমীক্ষার মধ্যেই থমকে আছে। এক্ষেত্রে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকেই দায়ী মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের সময়ও কমে আসায় শঙ্কায় পড়েছে ইআরডি। 

গত এক দশকে এ খাতে শেষ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ। গত তিন বছরেই নতুন করে ৭৩৭ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। আর ডাবল লাইন করা হয়েছে ১ হাজার ৭৮৯ কিলোমিটার রেলপথ। বর্তমানে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকার ২৮টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে ৪ হাজার ৪৩০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫৭০টি কোচ সংগ্রহের কাজ করছে রেলওয়ে। আরো ৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০টি কোচ সংস্কার করা হচ্ছে। কিন্তু দেশেই কোচ তৈরির সক্ষমতা তৈরি করতে পারলে অর্ধেক ব্যয়ে কোচ নির্মাণ করা সম্ভব হতো বলছেন বিশেষজ্ঞরা। 

২০১৫ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ঋণের আওতায় সৈয়দপুরে প্রথমবারের মতো রেলকোচ তৈরির একটি প্রকল্প তালিকাভুক্ত করা হয়। ২ বিলিয়ন ডলারের এ ঋণচুক্তির আট বছর পরও প্রকল্পটি শুরু করা যায়নি। এমনকি প্রকল্পটির সমীক্ষাও শুরু হয়নি এখনো। এজন্য রেলওয়ের দীর্ঘ বিলম্বকে দায়ী মনে করছে পরিকল্পনা কমিশনও। 

পরিকল্পনা কমিশনের সূত্রমতে, এলওসি ঋণচুক্তির পর ২০১৬ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে সৈয়দপুরে ১২২ একর জমিতে কোচ তৈরির কারখানা তৈরির জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়। ৭৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পের মূল্যায়ন সভার সিদ্ধান্তের আলোকে সাত সদস্যের একটি কমিটি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে। পরিদর্শনের পর আবার ১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে নতুন করে প্রস্তাব পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে।

ব্যয় দ্বিগুণ করার কারণ জানতে চেয়ে পরিকল্পনা কমিশন থেকে চিঠি দেয়া হয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে। প্রকল্পের নথি বলছে, ২ বছর ৬ মাস পর পরিকল্পনা কমিশনে চিঠির জবাব পাঠানো হয়। এ বিষয়ে কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের রেল উইংয়ের যুগ্ম প্রধান কবির আহামদ বলেন, ‘‌নানা কারণে প্রকল্পটির কাজ বিলম্বিত হয়েছে। কিন্তু আমরা তাগিদপত্র পাঠিয়ে প্রকল্পটির কাগজপত্র নিয়ে এসেছি। নির্বাচনের কারণে এখন মূল্যায়ন সভা করা না গেলেও জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে প্রকল্পটির বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা হবে।’ 

যদিও প্রকল্পটি বিলম্বের পেছনে রেল কর্মকর্তাদের আগ্রহের ঘাটতির কথা বলছে কমিশন সূত্র। অন্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে পরিকল্পনা কমিশনে যোগাযোগ করা হলেও এ প্রকল্পে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না বলছে সূত্রটি। 

একই কথা বলছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরাও। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘‌আমলারা প্রতিষ্ঠান গড়ার চেয়ে ক্রয় কার্যক্রম বেশি পছন্দ করেন। কারণ কোচ আমদানি করতে গেলে কানাডা, ইন্দোনেশিয়া ঘুরে আসতে পারবেন সরকারি কর্মকর্তারা। কিন্তু সৈয়দপুরে কোচ তৈরি হলে তাদের কোনো লাভ নেই।’ যদিও দেশে কোচ তৈরি হলে সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যেত বলছেন এ বিশেষজ্ঞ। 

আমদানির চেয়ে ৫০-৬০ শতাংশ কম মূল্যে কোচ মিলবে বলে মনে করেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌কোচ তৈরি কোনো উচ্চ প্রযুক্তির কাজ নয়। কোচ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও ৩০-৪০ শতাংশ কমানো যাবে দেশে উৎপাদন করা হলে। আর আমদানিনির্ভর থাকলে রেল লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারবে না।’ 

টেকসই উন্নয়ন করতে গেলে আমদানি কমিয়ে দেশে দক্ষ লোকবল ও ব্যবস্থাপনাগত আমূল পরিবর্তন জরুরি বলছেন এ বিশেষজ্ঞ। কোচ আমদানি করতে গেলে চাহিদামতো বৈশিষ্ট্যের মিল থাকে না। আর সময় মতো কোচ না আসায় যাত্রীদের ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তা থাকে বলে জানান তিনি। কোচ সংগ্রহের কয়েকটি প্রকল্প বিশ্লেষণ করে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

রেলওয়ের সূত্রমতে, ২০টি লোকোমোটিভসহ ১৭০টি কোচ সংগ্রহের জন্য ১ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত ১৫০টির মধ্যে কোচ এসেছে ১২৮টি। বাকিগুলোসহ অতিরিক্ত আরো ৩৫টি কোচ সংগ্রহের জন্য প্রকল্প সংশোধনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ২০০ যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহের জন্য ৯২৭ কোটি টাকার আরো একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছিল ২০১৬ সালে। কিন্তু চীনের অর্থায়ন না পাওয়ায় প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। 

রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার বলেন, ‘‌আড়াই বছর পর চিঠির জবাব দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ সবকিছু যাচাই করে চিঠির জবাব দিতে সাত-আট মাস সময় লেগে থাকতে পারে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

প্রকল্পটির দায়িত্বে থাকা প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পশ্চিম) মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌প্রকল্পটি দীর্ঘ সময়েও না হওয়ার কারণ বলতে পারবে রেল মন্ত্রণালয় কিংবা পরিকল্পনা কমিশন।’ সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হলে মূল প্রকল্প গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন