বড় অংকের রেমিট্যান্সগুলো আসছে ব্যাংকিং চ্যানেল এড়িয়ে

ইয়াহইয়া নকিব

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, প্রবাসে বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী কর্মরত মানুষের সংখ্যা দেড় কোটির বেশি। উপার্জিত আয়ের বেশিরভাগই দেশে পাঠাচ্ছেন তারা। তাদের কেউ রেমিট্যান্স হিসেবে সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকা আবার কেউ সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকারও বেশি পাঠাচ্ছেন। তুলনামূলক ছোট বা বড় অংকের রেমিট্যান্সগুলোর বেশিরভাগই দেশে আসছে অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে। ব্যাংক খাত ব্যবহার করে আসছে মূলত মাঝারি অংকের (১ লাখ থেকে অনূর্ধ্ব ৫ লাখ টাকা) রেমিট্যান্সগুলো। 

রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরা বলছেন, খরচ বেশি হওয়ায় ছোট অংকের রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতকে এড়িয়ে চলছেন প্রবাসীরা। আবার বড় অংকের রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে আয়ের উৎস দেখাতে হয় বলে তা পাঠানো হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত সপ্তাহে প্রকাশিত খানা আয়-ব্যয় জরিপের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৫ লাখ টাকার সমান বা এর বেশি পরিমাণ অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রায় ৯ শতাংশ প্রবাসী। তাদের ৩২ দশমিক ১২ শতাংশ দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে। যেখানে ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। এজেন্ট বা দালালদের মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন প্রায় ১০ শতাংশ। আবার বন্ধু-বান্ধবের হাতে পাঠানো অর্থের ক্ষেত্রে এ হার ৪ দশমিক ১২ শতাংশ। 

অন্যদিকে ২৫ হাজার টাকার কম রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রায় ৬৮ শতাংশ আসছে ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে। ব্যাংক খাতে আসছে ৪ শতাংশেরও কম। বাকিটা আসছে বন্ধু-বান্ধব, দালাল, মোবাইল ব্যাংকিং বা অসংজ্ঞায়িত-অপ্রাতিষ্ঠানিক নানা মাধ্যমে। 

বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন মাধ্যমে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের বিষয়টির সঙ্গে হুন্ডির সংযোগ রয়েছে। ট্রাভেল এজেন্সির আড়ালে চলছে মানি এক্সচেঞ্জ, হুন্ডি ও বিমানের টিকিট বিক্রির কারবার। দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন ব্যবসা বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব মুদ্রা সংগ্রহের পর দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে দরকষাকষি করে সেগুলো আবার বেশি মূল্যে দেশে পাঠানোর ঘটনাও ঘটছে। 

বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে দেশ থেকে ৩০ লাখের বেশি অভিবাসী শ্রমিক বিদেশ গিয়েছেন। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের বিদেশ যাওয়ার কোনো প্রভাব রেমিট্যান্স প্রবাহে দেখা যাচ্ছে না। ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ২ হাজার ৪৭৭ কোটি বা ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমে ২ হাজার ১৩০ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বাড়লেও সেটির প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত অর্থবছর দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশেরও অনেক কম। এ সময়ে ৮৮০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছে।

বিষয়টি নিয়ে জোর অনুসন্ধান চালানো প্রয়োজন উল্লেখ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিষয়টি নিয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌ট্রাভেল এজেন্টদের রেমিট্যান্স আনার কোনো এখতিয়ার নেই। দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ কিছু দেশে হুন্ডির কারবার চলছে। সেখানে কিছু লোক ট্রাভেল এজেন্সি খুলে প্রবাসীদের থেকে বিদেশী মুদ্রা সংগ্রহ করছে। আবার তারা মানি এক্সচেঞ্জ ও বিমানের টিকিট বিক্রি করছে। বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতদের থেকে মুদ্রা সংগ্রহ করছে। কিছু ক্ষেত্রে আবার দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে দরকষাকষি করছে তারা। বেশি মূল্য যেখানে পাচ্ছে, সেখানে সেসব মুদ্রা বিক্রি করে দিচ্ছে। সেখানে বসে তারা বিভিন্নভাবে হুন্ডির ব্যবসা করছে।’

অনেক ক্ষেত্রেই আয়ের উৎস দেখানো সম্ভব হয় না বলে অপ্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন চ্যানেল বেছে নিতে হয় বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশীরা। এমনই এক অভিবাসী বাংলাদেশী জহির আহমেদ (ছদ্মনাম)। সৌদি আরবের জেদ্দায় বিলাসপণ্যের একটি শোরুম পরিচালনা করছেন তিনি। ওই দোকান থেকে প্রতি মাসে তার মুনাফা হয় ৮-১০ লাখ টাকা। নিজেদের আয়ের পুরোটা ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠাতে পারেন না তিনি। কারণ উদ্যোক্তা নয়, বরং সাধারণ শ্রমিক হিসেবেই সৌদি আরব গিয়েছিলেন তিনি। সে অনুযায়ী তার মাসিক আয় হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা। 

আয়কৃত অর্থ কীভাবে দেশে পাঠান—এমন প্রশ্নের জবাবে জহির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংক কিংবা মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় দেশে টাকা পাঠাতে গেলে আয়ের উৎস দেখাতে হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নথিপত্র চাওয়া হয়। কিন্তু আমার পক্ষে আয়ের যথাযথ উৎস দেখানো সম্ভব নয়। কারণ সৌদি সরকারের কাছে যে নথি আছে, তাতে আমি একজন সাধারণ শ্রমিক। একজন শ্রমিক হিসেবে আমি এত টাকা আয় করতে পারি না। তাই বাংলাদেশে টাকা পাঠাতে হলে হুন্ডিওয়ালাদের কাছে যেতে হয়। অনেক সময় বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টদের মাধ্যমেও দেশে টাকা পাঠাই।’ 

কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের দেশে দেশে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের আইনগুলো কঠোর হচ্ছে। আবার প্রত্যেক দেশই চাচ্ছে নিজেদের দেশ থেকে অতিরিক্ত অর্থ যাতে অন্য দেশে চলে না যায়। এজন্য সব দেশই প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোয় কড়াকড়ি আরোপ করছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকদের প্রধান গন্তব্য। দেশের রেমিট্যান্স আহরণের প্রধান উৎসও মধ্যপ্রাচ্য। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে। গত কয়েক বছরে এসব দেশের মানি লন্ডারিংসহ অর্থ স্থানান্তরের আইনগুলো কঠোর করা হয়েছে।

প্রবাসীরা বলছেন, ব্যাংক, মানি এক্সচেঞ্জসহ আইন অনুমোদিত মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে দেশে অর্থ পাঠানো অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল ও জটিল। এসব মাধ্যমে অর্থ পাঠানো হলে সেটির দালিলিক প্রমাণও থেকে যায়। কিন্তু হুন্ডি, হাওলা, ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে সেটির ব্যয় কম হয়। আবার জবাবদিহিতার ভয়ও কমে যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্সে হুন্ডির ব্যবহার ঠেকাতে তৎপরতা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। হুন্ডিতে জড়িত থাকার অভিযোগে  মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকশ এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটি। হুন্ডির মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীদের সতর্ক করা হয়েছে। এসব তৎপরতা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়েনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে যেসব অর্থ পাঠান কেবল সেগুলোই রেমিট্যান্স হিসেবে গণ্য হয়। হুন্ডি বা আইন অননুমোদিত কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে দেশে অর্থ পাঠালে সেটি রেমিট্যান্সের হিসাবে আসে না। কারণ এসব মাধ্যমে আসা অর্থে কেবল সুবিধাভোগী পরিবার বা ব্যক্তি উপকৃত হয়। দেশের হিসাবে কোনো ডলার যুক্ত হয় না।’

মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘রেমিট্যান্স গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের দিক থেকে আইন-কানুন বেশ উদার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যেসব দেশ থেকে অর্থ পাঠানো হচ্ছে সেখানে। কারণ বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকরা নির্দিষ্ট পেশার বাইরেও ওভারটাইম করে অর্থ আয় করেন। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেন। কিন্তু সেসব দেশের আইন অনুযায়ী, আয়কৃত অতিরিক্ত অর্থ দেশে পাঠাতে পারেন না। এ কারণে বেশি আয় করা প্রবাসীদের বড় রেমিট্যান্স আমরা ব্যাংক খাতে কম পাচ্ছি। এসব অর্থ হুন্ডি, ট্রাভেল এজেন্টসহ অন্যান্য মাধ্যমে চলে যাচ্ছে।’


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন