আলোকপাত

সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়

আবু আহমেদ

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানো সবসময় কার্যকর হয় না। মূলত উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় এ নীতি বেশি ব্যবহার হয়। যেসব দেশে জনগণ শতভাগ কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়, সেসব দেশে এসব নীতি কার্যকর হয়। সুদের হার বাড়ানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোগ কমিয়ে নিয়ে আসা। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব নীতির বাস্তবায়ন করে। এ নীতির মাধ্যমে ভোগের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কারণ তখন মানুষের হাতে অর্থের প্রবাহ সীমিত থাকে। 

যেসব দেশের অর্থনীতি উন্নত সেখানে ভোক্তার চাহিদা থাকে ঊর্ধ্বমুখী। তাই সেসব দেশে ভোগের চাহিদায় লাগাম রাখতে সুদের হার বৃদ্ধি করা হয়, যাতে ভোক্তার হাতে কম অর্থ প্রবাহ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ এসব নীতি অনুসরণ করে। অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের অনুসরণ করে। 

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। আমরা যদি সুদের হার বৃদ্ধি করি তাহলে ভোগের চাহিদা হয়তো কিছুটা সীমিত হবে তবে এক্ষেত্রে বিনিয়োগও কমে যাবে। আর বিনিয়োগ কমে গেলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমবে, যার ফলে দেশে বেকারত্ব বাড়বে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) আশানুরূপ হারে বৃদ্ধি পাবে না। ফলে দেশের বেসরকারি খাত নিরুৎসাহিত বোধ করবে এবং বিনিয়োগ সীমিত হয়ে আসবে। বিনিয়োগ কমে গেলে আমাদের সরবরাহে ভাটা পড়বে। এভাবে সরবরাহ কমতে থাকে তাহলে এমনিতেই মূল্যস্ফীতি বাড়বে। 

আমাদের দেশের অর্থনীতি অনেক ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল। এখানে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে সরবরাহ বৃদ্ধি হয়। আমাদের দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ এমপ্লয়েড অর্থনীতিনির্ভর নয়, এখানকার অর্থনীতি শক্তিশালী করতে বিনিয়োগের ওপর জোর দিতে হবে। তাই আমার মনে হয়, বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের সুদের হার কমিয়ে রাখা উচিত। এখন আমরা যদি সুদের হার না কমিয়ে বৃদ্ধি করি তাহলে আমাদের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, আর উৎপাদন ব্যয় বাড়লে এমনিতেই পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এভাবে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে তো মূল্যস্ফীতিটা থেকেই যাচ্ছে। 

আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতির মূল কারণ হচ্ছে আমাদের লেনদেনে ঘাটতি। আমাদের যদি লেনদেন ঘাটতি চলতে থাকে তাহলে আমাদের রিজার্ভ কমে যাবে। আর রিজার্ভ যদি কমতে থাকে তাহলে আমাদের টাকার মান কমে যাবে। এক্ষেত্রে টাকার মান যদি কমতে থাকে তাহলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। মূলত বাংলাদেশে এ কারণেই মূল্যস্ফীতি হচ্ছে।

আমাদের কার্ব মার্কেটে দাম বাড়ছে, সেটা অর্থ পাচারের কারণে হচ্ছে। পাচারকারীরা তো এখান থেকে নিচ্ছে, আবার আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। কারণ তারা বাইরে আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে ফরেন এক্সচেঞ্জ (যুক্তরাষ্ট্রের ডলার বা অন্য কিছু) সংগ্রহ করছে। যে কারণে ফরেন এক্সচেঞ্জগুলো সেখানে দিয়ে দিচ্ছে, আমাদের এখানে আর আসছে না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রেমিট্যান্স কম আসছে। কিন্তু বাংলাদেশীরা কম উপার্জন করছে তা নয়, বরং বাংলাদেশীরা আগের চেয়ে বেশি উপার্জন করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে টাকা বিদেশে সংগ্রহ করে বিদেশেই রেখে দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের কথিত ধনী লোকেরা যাদের হাতে অতিরিক্ত টাকা আছে, যারা দুর্নীতি, ঘুস, ব্যাংক লুট করছে তারা বিদেশে অর্থ পাচার করছে। অথবা বড় ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় ওভার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এটি করে। 

কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, দুই বছর আগে তো সব ঠিক ছিল, এখন কেন বেশি হচ্ছে? দেড়-দুই বছর ধরে মূল কারণটা হচ্ছে রাজনৈতিক। আন্দোলন, সংগ্রাম অথবা সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের বড় আন্দোলন যখন গড়ে ওঠে তখন এসব লোক ভয় পায়, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ব্যবসা-বাণিজ্যের যে সুবিধা তারা আগে নিয়েছিল, মনে করে যে সেটা থাকবে না। অথবা তারা কিছু টাকা নিরাপদ জায়গায় নিতে চাচ্ছে। সেজন্য তারা ফরেন এক্সচেঞ্জের আশ্রয় নেয়। আরেকটা কারণ হচ্ছে আমাদের রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং রেমিট্যান্সের আন্তঃপ্রবাহ কমে যাওয়া। আমাদের সম্পূর্ণ পেমেন্টের মধ্যে বেশ বড় রকমের একটা খাত প্রসারিত হয়েছে। অর্থাৎ বৈদেশিক ঋণের পেমেন্ট বেড়ে গেছে। গত এক বছর আগে যা দেয়া হতো তার চেয়ে চার বা পাঁচগুণ সুদ এবং আসল বেড়েছে। সেটা সামনে আরো বাড়তে থাকবে। এই যে আমরা আদানি থেকে ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়েছি, এটা তো ভারতীয় রুপি দিলে চলবে না। ডলারে দিতে হবে। শেভরনকে আগে থেকে ডলারে পেমেন্ট দেয়া হচ্ছে। বিদেশি ঋণ যেটা নেয়া হয়েছে, সেটা ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এখন এ পেমেন্টগুলো বড় ধরনের খাত হিসেবে দেখা দিচ্ছে। যে কারণে হিসাব করলে দেখা যায়, আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ঊর্ধ্বমুখী হবে না। কারণ আমাদের পেমেন্ট অবলিগেশন বেড়ে গেছে। তারা যে ৪ মিলিয়ন ডলার দিয়ে বলছে ২৫ বিলিয়ন ডলার ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ রাখতে হবে, এটা সম্ভব নয়, তারাও এটা জানে। তাহলে তারা বলুক বৈদেশিক ঋণ এখন শোধ করব না। এটা কি তারা মানবে? মানবে না। তাহলে? আমাদের কাছে যারা অর্থ পাবে, তাদের দিতেই হবে। আমরা বড়জোর বিলম্বিত করতে পারি। কিন্তু দেরি করাতে গেলে সেটিরও একটা খরচ আছে। যেমন আদানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের সুদ যোগ হবে। আমি মনে করি চুক্তিগুলো স্বচ্ছ হয়নি। চুক্তিগুলোয় আরো কঠোর বোঝাপড়ায় যাওয়া উচিত ছিল। সেটিতে যাওয়া হয়নি, অনেকে জানতও না। তাছাড়া সরকার কোনো পরামর্শ চেয়েছে বলে আমার মনে হয় না। তা না হলে তখনই বলা যেত এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন দরকার। এখন আমরা না নিলেও টাকা দিতে হবে, আর নিলে তো দিতেই হবে। এটি আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ফরেন এক্সচেঞ্জে আমরা যদি টাকার ভ্যালু ধরে রাখতে না পারি, একদিকে মূল্যস্ফীতি হলে টাকার মূল্য যেমন কমবে, অন্যদিকে আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট অতটা স্বচ্ছ না। যতক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের চাহিদা এভাবে বাড়তে থাকবে, ততক্ষণ ফরেন এক্সচেঞ্জ ধরে রাখা সম্ভব নয়। আবার এটি সম্ভব না হলে তখন আমাদের টাকা আরো মূল্যমান হারাবে। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সুতরাং আমরা আগের জায়গায় যাব সেটা চিন্তাই করা যায় না। বরং বর্তমানে যেখানে আছে, সেখানেও রাখা যাবে বলে মনে হয় না। 

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি অনেকটা অভ্যন্তরীণ। বাজারগুলো এখানে ঠিকমতো কাজ করছে না। বাজারগুলো যেভাবে প্রতিযোগিতামূলক ও স্বচ্ছ হওয়া উচিত, সেটা নেই। এখানে সিন্ডিকেট হয়ে যায়। একসময় বাজারে এসব পণ্যে সিন্ডিকেট উপস্থিত ছিল না। যেমন ডিম, পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্যতেল। ভোজ্যতেল যেহেতু কয়েকটি কোম্পানি আমদানি করে, পরিশোধন করে, তাই সেখানে তাদের একটা সিন্ডিকেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যায়। গত দুই বছরের মধ্যে সিন্ডিকেট দৃশ্যমান হয়েছে। তারা অ্যাসোসিয়েশন করেছে, তাদের সরবরাহ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে। কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এটি সরকারকে ট্যাকেল করতে হবে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি দিয়ে, সুদের হার বৃদ্ধি করে এ ধরনের মূল্যস্ফীতি রোধ করা যায় না। এমনকি বিনিময় হার যদি স্থিতিশীলও হয়, তার পরও মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না, যতক্ষণ না সিন্ডিকেট বন্ধ করা যায়। প্রতিযোগিতা কমিশন আছে, ভোক্তা অধিদপ্তর রয়েছে কিন্তু তাদের কাজকর্ম অতটা দৃশ্যমান নয়। এক্ষেত্রে সরকারকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট নামীয় কোনো অবাজারীয় বিষয় যেন কাজ না করে। যেটা মুক্ত বাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না, এ রকম কোনো আপদীয় গোষ্ঠী যেন গড়ে না উঠতে পারে। এটি সরকারকে দেখতে হবে। নাহলে সিন্ডিকেট যদি কাজ করে, তাহলে বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংস্থার পলিসিই কাজ করবে না। এজন্য বাজার হতে হবে সিন্ডিকেট মুক্ত, প্রতিযোগিতামূলক ও স্বচ্ছ। কোথাও যেন সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত না হয়। কেউ যেন অতিরিক্ত মজুদ করতে না পারে। দু-চারজন ব্যক্তি বা ব্যবসায়িক কোম্পানি মিলে যেন বেশি অর্থ খরচ করে প্রভাব খাটাতে না পারে। 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে ১০-১৫ বছর ধরে এটি এক ধরনের মাফিয়া গোষ্ঠীর (বড় কিছু শিল্পগোষ্ঠী) হাতে চলে গেছে। এর প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত না করতে না পারলে তাহলে ক্ষণে ক্ষণে এ ঘটনাগুলো ঘটতেই থাকবে। হঠাৎ করে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, কোনো পণ্য পাওয়া যাবে না। আর সিজনাল যেটা তা স্বাভাবিক, কোনো কোনো সিজনে কিছু পণ্যের সরবরাহ থাকে না এটা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সরবরাহ কম থাকলেও তা জনগণ মেনে নেয়। যেমন বর্ষাকালে সবজি উৎপাদন কম হয়, তখন সবজির দাম বাড়বে। গোল আলুর একটা সিজন আছে, অফ-সিজনে দাম একটু বাড়তে পারে। আর যদি সিন্ডিকেট এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে হবে কী—মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ বলতেও পারে না। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর দোষ দিয়ে লাভ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান ম্যানেজমেন্ট প্রতিকূল সময়ে দায়িত্ব নিয়েছে। এখন অনেকে বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে, যারা ডিপোজিট রাখছে, সুদের হার বাড়ানোয় মূল্যস্ফীতিতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুদের হার বাড়ালে খরচ বাড়বে এবং বিনিয়োগ কমে যাবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে না, যেটি বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল। এখন পলিসিগতভাবে যা-ই করুক না কেন পেমেন্ট অবলিগেশনে অধঃগতিকে কিছুটা হলেও রোধ করার জন্য দুটো কাজ করা যায়। একটা হচ্ছে যে সরকারের ব্যয় কমাতে হবে। সরকারি খাতে ব্যয় কমাতে হবে, বেসরকারি খাতে ব্যয় কমানো সেভাবে সম্ভব নয়। সরকারি সে ব্যয়গুলো কমাতে হবে, যেগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে না। সরকার যতই বলুক ব্যয় কমাতে, কিন্তু সে ব্যয় কমানো দৃশ্যমান হতে হবে। নতুন কোনো প্রকল্প যেটায় ফরেন এক্সচেঞ্জ জড়িত, সেটা না নিলেই ভালো হবে। এদিকে দেশের সম্পদ তো কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। যাদের অনেক টাকা আছে, বারবার বিদেশে যাচ্ছে, আসছে। এ প্রসঙ্গটি তুললাম, কারণ এখন ফার্স্ট ক্লাস বিমানের সবগুলো বুকিং হয়ে যায়। ওভার বুকিং। তাহলে কারা যাচ্ছে, বাংলাদেশী লোকেরাই তো যাচ্ছে। তাহলে এরা ফরেন কারেন্সি খরচ করছে না? একটা লোক যদি চারবার, দশবার যায় তাহলে তো ফরেন কারেন্সি প্রচুর খরচ করতে হবে। আমার কাছে মনে হয় এগুলোর ওপর সীমিত হলেও বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত। সরকারি কর্মকর্তাদের ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত, সরকারি কেনাকাটায় কৃচ্ছ্র সাধন করা উচিত, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি বন্ধ রাখা উচিত। তাহলে না আমরা দেখতাম যে সরকার তার ক্ষমতা অনুযায়ী ব্যয় করছে। নাহলে সরকার যদি তার ক্ষমতার বাইরে ব্যয় করতেই থাকে তাহলে অর্থনীতির যে নিম্নপ্রবাহ সেটা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এটা গেল একটা কথা। কিন্তু অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায় কিনা সেটা অনেকটা নির্ভর করে আমাদের রাজনীতির ওপর। 

রাজনীতিতে একটি ভালো, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া এক কথা আর কোনো রকম নির্বাচন হওয়া আরেক কথা। সরকার যদি কাগজে-কলমে একটা নির্বাচন করে ফেলে, তাহলে কিন্তু অর্থনীতির যে অধঃনমন সেটা সহজে রোধ করা যাবে বলে মনে হয় না। এর মূল কারণ হচ্ছে মানুষের মধ্যে যে হতাশা আছে, তাতে আশা ফেরানো কঠিন হয়ে যাবে। আরেকটা কথা হলো বিদেশীরা এটা বিশ্বাস করবে না। গত দুই বছরে আমাদের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে গেছে। বিদেশী বিনিয়োগ আসা কমে গেছে, আসবেও না। যদি আমরা একটা ইনক্লুসিভ নির্বাচনের দিকে না যেতে পারি। ইনক্লুসিভ বলতে দেশের বিরোধী দলগুলোসহ নির্বাচন। আমি সেটা বোঝাতে চাচ্ছি। দেশের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং অংশগ্রহণ করলেই শুধু হবে না, জনগণের সেটা অনুভব করতে হবে যে দেশে একটা ভালো নির্বাচন হয়েছে। একটা স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে যে পার্টি ক্ষমতায় আসুক তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু বিরোধী দলগুলোকে বাদ দিয়ে কিংবা তাদের জেলের মধ্যে রেখে আরেকটা নির্বাচনের দিকে যাওয়া, সেটা কিন্তু অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু হবে না বলে আমি মনে করি। কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ রাজনৈতিক ইস্যুগুলো আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে। বিনিয়োগ যদি বাইরে থেকে না আসে আর ভেতর থেকে মানুষ যদি উৎসাহ না পায়, তাহলে বিনিয়োগ হবে না। লোকের মধ্যে একটা হতাশা কাজ করবে। 

শেয়ারবাজার বা পুঁজিবাজারটা তো আমরা আগেই পঙ্গু করে রেখেছি ফ্লোরপ্রাইস দিয়ে। তো সেটা যদি না ওঠাই বা ওঠাতে না পারে তাহলে সেটাও সচল হবে না। সবকিছু মিলে আগে যেটা বলেছি আমাদের রফতানি বাড়ছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, আমরা বৈদেশিক ঋণ যেখান থেকে চাইছি পাচ্ছি। তিনটি আন্তর্জাতিক রেটিং কোম্পানি আমাদের ডি গ্রেড দিয়েছে। মুডি’স, এসঅ্যান্ডপি ও ফিচ। এই রেটিং কোম্পানিগুলো আমাদের ডাউনগ্রেড করে দেয়ার অর্থটা কী? আমাদের এখন এলসি খুলতে ক্যাশ টাকা দিতে হয়ে। মানে ক্যাশ ফরেন এক্সচেঞ্জ। আমাদের কেউ সহজে লোন দিতে চায় না। লোন দিলেও সেখানে থার্ড পার্টি গ্যারেন্টার হতে হয় এবং সুদের হার বেশি চায় তারা। এগুলো আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের অর্থনীতি যেটা আমরা দেখেছি অনেকটা ভালো অবস্থানে সেটা কিন্তু মলিন রঙ ধারণ করার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং এটার ভুক্তভোগী হবে নিচের দিকে যে লোকজন আছে তারা। যারা ৫-১০ শতাংশ লোক। তাদের অবস্থা খুবই খারাপ হবে। কারণ তারা তো উচ্চমূল্য দিয়ে এগুলো কিনতে পারবে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা তাদের পক্ষে দুরূহ ব্যাপার হয়ে যাবে। 

সরকারের পলিসিতে পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি দিয়ে হবে না। এর মধ্যে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার আছে। সরকার যদি মনে করে অর্থনীতির প্রয়োজনে দেশে একটা ভালো নির্বাচনের দিকে যাওয়া উচিত, তাহলে সে দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। এছাড়া তো কারো হাতে ম্যাজিক পাওয়ার নেই যে অর্থনীতিকে ওপরের দিকে নিয়ে যাবে। ডলারের যে ক্রাইসিস সেটা বন্ধ করবে এমন কোনো ম্যাজিক পাওয়ারও কারো হাতে নেই। এটা বললেই হয় না কোনো দিন। মুখের কথায় এগুলো হয় না। এটা ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের ব্যাপার। এটা হচ্ছে বিশ্বাসের ব্যাপার। আর মানুষ যদি মনে করে যে দেশের অর্থনীতি ভালো যাবে না, তাহলে তাদের মধ্যে হতাশা আসবেই। এটা হয়, পৃথিবীর সবখানেই হয়। এই ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা অনেকটা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সরকারের অন্যান্য পলিসির সঙ্গে যুক্ত। শুধু ওই সুদের হার বাড়িয়ে আর বিনিময় হার খোলাবাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে আমাদের অর্থনীতি ভালো করতে পারব বলে আমি মনে করি না। 

আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন