ব্যাংক খাতে সুশাসন না থাকলে বড় ধরনের ধস নামতে পারে

ড. সেলিম জাহান নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক। ইউএনডিপিতে যোগদানের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ ও কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। অতিথি অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যাল্ড ইউনিভার্সিটিতে। বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা, আইএলও, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি, রিজার্ভ সংকট, রফতানি খাতের বৈচিত্র্যায়ণ, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, ব্যাংক খাতে সুশাসন, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অন্যান্য প্রসঙ্গে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৌফিকুল ইসলাম

দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। খোদ নীতিনির্ধারকরাই এটি স্বীকার করছেন। সংকট উত্তরণের উপায় কী হতে পারে?

আমাদের অর্থনীতি একটা চাপের মুখে আছে। এটি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যে কারণে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ শঙ্কা সাধারণ মানুষের মধ্যেও কাজ করছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দাবি করছে বাংলাদেশের বর্তমানে যে মজুদ আছে তা হচ্ছে ২০ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার কোটি ডলার। এ মজুদ দিয়ে চার মাসের আমদানি করা যেতে পারে। সাধারণত আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডার বলে থাকে তিন মাসের আমদানি করা যাবে এমন পরিমাণে মজুদ থাকা দরকার। মজুদ থেকে আমাদের ঋণ শোধ করতে হবে, অন্যান্য দায় শোধ করতে হবে। সেটা করে যদি মজুদের পরিমাণ আরো কমে আসে তাহলে বুঝতে হবে আমরা চাপের মুখে আছি। বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে, আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য না হওয়ায় সাধারণ মানুষ চাপের মুখে আছে। এ চাপের ফলে নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সবাই শঙ্কার মধ্যে রয়েছে।

ব্যাংক খাতে সুশাসন কি মিথ হতে চলেছে? বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যাংক রয়েছে, অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে এটিও বলা হচ্ছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে, আদায় করা যাচ্ছে না। গ্রাহকদের আস্থা রক্ষায় ব্যাংক খাতে সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে কী করণীয়?

মোটা দাগে যদি বলি, আমাদের ব্যাংক খাতে ছয়টি সমস্যা দেখি। একটা হলো অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণ যেটির পরিমাণ বিশাল। আইএমএফ বলছে প্রতি চারটি ঋণের একটি খেলাপি। বস্তুত অর্থনীতির স্বাস্থ্যের অবস্থা সবল থাকলেও মোট ঋণের ২ বা ৩ শতাংশের বেশি খেলাপি হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে সেটা ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ঋণ যদি অনাদায়ী থাকে তাহলে ব্যাংক খাতের আয়ে সেটা একটা প্রভাব ফেলবে। ব্যাংক খাতে নাজুকতা বেড়ে যাবে। এটি একটি বড় সমস্যা। দুই নম্বর হলো, ব্যাংক খাতে আয় ব্যয়ের হিসাবের ক্ষেত্রে নানা অব্যবস্থাপনা কাজ করে। ঋণের মধ্যে সুস্থ ঋণ ও বাজে ঋণ রয়েছে। বাজে ঋণগুলো যদি যথাযথভাবে হিসাব-নিকাশে উপস্থাপিত হয়, তাহলে ব্যাংক খাতে প্রকৃত চিত্রের বদলে অন্য রকম চিত্র ফুটে উঠবে। তৃতীয়ত, অনেকে বলছেন ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে আমাদের কোনো তারল্য সংকট নেই। ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ব্যাংকগুলোর কাছে যথেষ্ট পরিমাণে তারল্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হচ্ছে। কলমানি বাজারে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। ৮-১০টি ব্যাংক সিআরআর-এসএলআর সংরক্ষণ করতেও ব্যর্থ হচ্ছে। এ অবস্থায় আরো ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে। ফলে পুরো ব্যাপারটির মধ্যেই ভঙ্গুরতা কাজ করছে। চতুর্থত হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে জালিয়াতি রয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে লাপাত্তা, পুরো ঋণ লোপাট হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে খবর বেরিয়েছিল দেশের ব্যাংক খাত থেকে নামসর্বস্ব কিছু প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যেগুলোর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এসব ঋণ আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। এমনটি অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুশাসন ব্যাহত হবে। শেষ কথা হলো, ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেহেতু অর্থের সঙ্গে জড়িত সেহেতু এখানে উচ্চস্তরের দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। সেটা নিশ্চিত করা এবং বিধি-নিষেধগুলো ঠিকমতো চালিত করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব। বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের আওতার মধ্যে আনা দরকার কিন্তু আনা যাচ্ছে না। এটির সঙ্গে সুশাসনের বিষয়টি জড়িত। ব্যাংক প্রতিষ্ঠা বা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব বা বিবেচনা কাজ করে। এর মাধ্যমে বহু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ব্যাংক স্থাপনের সুযোগ দেয়া হয়েছে যেসব ব্যাংকের সবল ভিত্তি নেই। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে যারা দুর্বল ব্যাংক এবং যারা বিধিনিষেধ মানছে না এমন ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা না নেয়া এবং তাদের বন্ধ করে না দেয়া বা নতুন কোনো ব্যাংক রাজনৈতিক কারণে স্থাপনের অনুমতি দেয়া এগুলোর কোনোটাই নেই। এটি না হওয়ার কারণে আমরা ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব দেখছি এবং এটি শুধু দেশের অভ্যন্তর থেকে বলা হচ্ছে এমনটিও নয়। আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে যে এখানে সুশাসনের অভাব রয়েছে। আমি মনে করি, ব্যাংক খাতে কাঠামোগত সংস্কারের দরকার আছে এবং অত্যাবশ্যক এবং এটা এখনই করতে হবে। কারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যদি সুশাসন না আসে তাহলে এ খাতে গ্রাহক বা সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গাটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু অর্থনীতির ভিত দুর্বল হয়ে যাবে। আমরা খবরে দেখি, কোন ব্যাংকগুলো আস্থাভাজন বা জনগণ কোন ব্যাংকগুলোর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এটা তো অত্যন্ত ভঙ্গুর একটি পরিস্থিতি। ব্যাংকিং ব্যবস্থা সেটা বড় ব্যাংক বা ছোট ব্যাংক হোক আমি যদি তার গ্রাহক হিসেবে আস্থা না পাই, যদি শঙ্কার মধ্যে থাকি, তাহলে একটা বড় ধরনের ধস নামতে পারে। এটা দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিবিদ, শিক্ষিতজন, নীতিনির্ধারকরা বলে আসছেন। 

রিজার্ভ ক্রমেই কমছে, ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এলে সংকট আরো বাড়বে। রিজার্ভ বাড়াতে আশু কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন?

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অনুসারে যে মজুদ আছে তা যদি আরো কমে আসে তাহলে আমদানির ওপর চাপ পড়বে। আমাদের বহু জিনিস আমদানিনির্ভর। আমরা যদি জ্বালানি তেলের কথা বলি, পরিবহন খাত থেকে শুরু করে আমাদের শিল্প, এসব কিছু জ্বালানির ওপর নির্ভর। সুতরাং এ মজুদ কমে এলে আমাদের আমদানি ক্ষমতা কমে আসবে। সেটার বিরূপ একটা প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিতে পড়ছে। কিছু জায়গায় এ ব্যাপারে নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে। একটা হলো আমদানির ক্ষেত্রে। যেসব আমদানি আমাদের উৎপাদন কিংবা জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন, সেগুলো অব্যাহত রাখা এবং অন্য যেসব আমদানি আছে সেগুলো কমিয়ে ফেলা। তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুদ সেটার ওপর চাপ কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, রফতানি কীভাবে বাড়ানো যায় সেটি বিবেচনা করা দরকার। কারণ রফতানি না বাড়লে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুদ তার সরবরাহ বাড়বে না। আর এ রফতানি বাড়ানোর জন্য আমরা যেসব দেশে রফতানি করে থাকি, তাদের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। এটাকে আরো নানা দিক থেকে বাড়ানো যেতে পারে কিনা বা রফতানি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে কিনা। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বা বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে ঋণ নিয়েছে, সেই ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা যে দেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে—তাদের ঋণ ফেরতের প্রক্রিয়াটি আরো নমনীয় করা যেতে পারে কিনা। অথবা এটাকে আরো দীর্ঘায়িত করা বা এটাকে ধাপে ধাপে দেয়া যায় কিনা সেটি আলোচনার মধ্যে আনতে হবে। তাহলে আমরা বলতে পারি যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের সংকটের চাপটা কমিয়ে নিয়ে আসতে পারব।

দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে, আমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোও সে অর্থে মানবসম্পদ তৈরি করতে পারছে না। কীভাবে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে বিশ্বের শ্রমবাজারে আরো শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলা যাবে?

আমি প্রশ্নটাকে একটু ব্যাপ্ত করি, প্রশিক্ষণের বাধা সেটা অবশ্যই একটা বড় বাধা। শ্রমবাজারের সর্বস্তরের শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই এ কথা সত্য। তবে আমি শুধু প্রশিক্ষণের মধ্যে এ আলোচনাকে রাখতে চাই না। দক্ষ মানবসম্পদের একটা বড় অংশ আসে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা এ বিভিন্ন স্তরে যারা পড়াশোনা করছেন ও যারা পড়াচ্ছেন তাদের দুটো দলই সনদ পাওয়া এবং দেয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। অন্যদিকে এ শিক্ষার মাধ্যমে আমরা কী শিখছি এবং কতটুক দক্ষতা অর্জন করলাম সে ব্যাপারে আগ্রহ কম। আবার দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে শিক্ষা পদ্ধতিরও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে কারিগরি মাধ্যম থেকে যারা বের হচ্ছে তারা সেভাবে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারছে না। সেজন্যই দেখা যায় যে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমিকরা ন্যূনতম কারিগরি দক্ষতাও উপস্থাপন করতে পারে না। অর্থাৎ সনদপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও যে দক্ষতা থাকার কথা সেটা আমরা তাদের থেকে পাচ্ছি না। এক্ষেত্রে বলা যায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার যে ত্রুটি রয়েছে সেটা দেশের অগ্রগতিকে ব্যাহত করবে। কারণ আমরা যতই প্রযুক্তিনির্ভর হই না কেন আমাদের কিন্তু মানবসম্পদ লাগবেই। তাই আমি বলব, এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন যেখানে দক্ষতার সঙ্গে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে তৈরি করতে পারবে। এটা হচ্ছে অন্তরায়ের প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, যখন একজন শিক্ষার্থী শ্রমবাজারে ঢুকছেন প্রথমেই তিনি যে বিষয়টি টের পান সেটা হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অর্জিত জ্ঞান কর্মক্ষেত্রের কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পর্যাপ্ত নয়। একজন শিক্ষার্থী যে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করছেন তাকে সেখানে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদেরও প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহ কম, আবার যারা শিখবে তাদেরও শেখার আগ্রহটা কম থাকে। পৃথিবী প্রতিনিয়তই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি প্রযুক্তিও বদলাচ্ছে, উৎপাদনের প্রক্রিয়াও দিন দিন বদলে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে যদি আমরা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে না পারি তাহলে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত মানের মানবসম্পদ তৈরিতে ব্যর্থ হব। বর্তমানে অনেক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন হলেও কেন্দ্রগুলোয় ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। দেখা যায়, সেখানে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের যন্ত্রপাতি থাকে না অথবা ভালো প্রশিক্ষকেরও ঘাটতি থাকে অনেক জায়গায়। অন্যদিকে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোরও যোগাযোগ প্রয়োজন যাতে প্রতিষ্ঠানের চাহিদার আলোকে মানবসম্পদ তৈরি হয়। অন্যথায় আমরা চাহিদার আলোকে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারব না। তবে কোনো স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে মানবসম্পদের এ ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত প্রকৃত শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রণয়ন করতে হবে। সেটি না করে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে সেটি কতটুকু কাজে আসবে তা তো প্রতীয়মান হচ্ছে। আমাদের দেশের চাহিদা অনুযায়ী এখন আমাদের উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে যদি আমরা আমাদের জনশক্তি দিয়ে শূন্যতা পূরণ করতে না পারি তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবে আমাদের বহির্বিশ্বের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। 

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানবসম্পদ তৈরিতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না বলা হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে কী ধরনের কারিকুলাম প্রণয়ন করা উচিত? এদিকে সম্প্রতি আরো ছয়টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে, সব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কতগুলো নির্ণায়ক থাকে এর মধ্যে একটি হচ্ছে, এখান থেকে আমরা উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি তৈরি করতে চাই। সেক্ষেত্রে আমাদের ভাবা দরকার মূলত কতসংখ্যক এমন দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন এবং এ সংখ্যক জনশক্তি সরবরাহ করতে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন রয়েছে। তাহলে দক্ষ জনসম্পদের যে চাহিদা তাতে ভারসাম্য রাখা সম্ভব হবে। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনগুলো এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে হয়। স্থানীয় কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে আনুকূল্য দেয়ার জন্য স্থাপিত হয়। এটি বস্তুনিষ্ঠ কোনো নির্ণায়ক হিসেবে গণ্য হতে পারে না। এভাবে গণহারে যদি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় তাহলে দক্ষ জনসম্পদ তৈরির বদলে ভুল জায়গায় অর্থ বিনিয়োগ হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এখান থেকে যারা বের হবে তাদের আমরা দক্ষভাবে তৈরি করতে পারব না। যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে আমরা সনদ দিয়ে বের করব, তাদের আমরা বেকার জনশক্তি হিসেবে তৈরি করব। কারণ তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ, চাকরি বা কাজ আমাদের হাতে নেই। সুতরাং সে জায়গায় একটা বড় সমস্যা দেখা দেবে। এটা না করে উচ্চতম পর্যায়ে বিশেষত ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক খাতে মনোযোগী হতে হবে। প্রতি বছর আমাদের কতজন উচ্চতম দক্ষ মানুষের প্রয়োজন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে? সেই অনুপাতে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঢেলে সাজানো হয় তাহলে আমাদের যে প্রয়োজন সেটা মিটবে। কারিগরি, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে সেখানেও ঠিক একইভাবে যদি আমরা মূল্যায়ন করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যস্ত করি তাহলে সেটা হবে। বর্তমান পর্যায়ে ঢালাওভাবে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হচ্ছে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে না। অন্যদিকে আর্থিক অপচয় হচ্ছে। আমাদের দেশে আর্থিক অপ্রতুলতা রয়েছে। এ সম্পদগুলো অন্য জায়গায় ব্যবহার হতে পারত। যেমন স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে ব্যবহার হতে পারত, সেটা হচ্ছে না।


(বাকি অংশ আগামীকাল)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন