বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়

মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপানুষ্ঠানিক ও জীবনব্যাপী শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সঙ্গে কাজ করেছেন। মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য লিখিত কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা বইয়ের প্রধান লেখক তিনি। বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। কমনওয়েলথ রিসার্চ ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে দক্ষ শিক্ষকের অভাব, প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৌফিকুল ইসলাম

প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তরে দক্ষ শিক্ষকের অভাব দেখা যাচ্ছে, এ সমস্যা সমাধানে করণীয় কী? 

আমরা বলি মানসম্মত শিক্ষার কথা, মানসম্মত শিক্ষার জন্য সবার আগে দরকার মানসম্মত শিক্ষক। গড়পড়তা অথবা মানহীন শিক্ষক দিয়ে কখনই মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে এটিই হচ্ছে, চাকরির বাজারের বর্তমান গতিপ্রকৃতিতে কেউ শিক্ষকতায় সাধারণত যেতে চায় না। তারা অন্যান্য চাকরিতে যখন ব্যর্থ হয়, তখনই শিক্ষকতার ক্ষেত্রে চেষ্টা করে। বিসিএসে সাবজেক্ট চয়েসের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, দুই-চারজন ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশই একদম শেষের দিকে রাখে। শিক্ষকতায় কেন যেতে চায় না? কারণ সেখানে যে সামাজিক মর্যাদা, বেতন, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এবং নিরাপত্তা এ জায়গাগুলো আগে নিশ্চিত করতে হবে। এর পরই একজন মেধাবী চাকরিপ্রার্থীকে শিক্ষকতায় আসার কথা বলা যায়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অনেকেই যায়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিসিএস বা অন্য কোনো সরকারি চাকরি হলে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দেয়। বেতন কিন্তু সমান, কিন্তু তার পরও চলে যায়। কেন যায়? অর্থাৎ কোথাও না কোথাও সমস্যা আছে। এ জায়গা চিহ্নিত করতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে যদি দেখি সামাজিক যে অবস্থান অন্যান্য ক্যাডার হলে যে সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়, শিক্ষকতায় সে সুযোগ-সুবিধা নেই। যে কারণে মেধাবীরা অন্যান্য ক্যাডারে যাবে, এটি খুব স্বাভাবিক। আমাদের আগে সে জায়গাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। সমতায়ন করতে হবে, রাষ্ট্রের সবাই এক ধরনের সুবিধা পাবে। শুধু একই না, বরং শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা আরো বাড়িয়ে দিতে হবে। কারণ শিক্ষকরা অন্য পেশাজীবীদের তৈরি করেন। কাচ কাটতে হীরা দরকার। লোহা বা তামা দিয়ে ঘষা দিলে কাচ কাটবে না। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত জাতির সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের শিক্ষকতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে সে সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে আরেকটি বিভাজন রয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষকরা কম বেতন পাবেন, মাধ্যমিকরা একটু বেশি বেতন পাবেন। উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষকরা আরেকটু বেশি বেতন পাবেন। এটা কিন্তু আমরা বদলাতে পারি। অনেক দেশেই নিয়ম আছে বেতন কাঠামোর ক্ষেত্রে শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী, ফলাফল, ডিগ্রি, মানসম্মত শিক্ষাদানের অভিজ্ঞতা, যাচাইয়ের মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে কেমন, কোন গ্রেডের শিক্ষক—এ সবকিছুর ওপর ভিত্তি করে তিনি বেতন পাবেন। এমনও হতে পারে এসব শর্ত পূরণ করলে একজন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চেয়েও বেশি বেতন পেতে পারেন। এ জায়গাগুলোয় যদি আমরা সমতায়ন করতে পারি, তাহলে আমরা প্রাথমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও মানসম্মত শিক্ষক পাব।

প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়া দরকার, রাষ্ট্র কি এটি অনুভব করছে?

কাগজে-কলমে রাষ্ট্র অনুভব করছে, এটি বিভিন্ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে আমরা দেখি। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ফিনল্যান্ডের ‘ফিনিশ’ এডুকেশন সিস্টেমকে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সেরা গণ্য করা হয়। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি বেতন পান। কারণ তাদের পরিশ্রম বেশি, তাদের মর্যাদাও বেশি। আমাদের এ জায়গায় মনোযোগী হতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও আমাদের দেশে পরিষ্কার না। প্রাথমিকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য মূলত দুটো। একটি হচ্ছে মৌলিক শিক্ষা প্রদান করা, দ্বিতীয়ত মাধ্যমিকের জন্য প্রস্তুত করবে। মৌলিক শিক্ষার মধ্যে আমরা দেখি ব্যবহারিক সাক্ষরতা ও জীবন দক্ষতা রয়েছে। ব্যবহারিক সাক্ষরতার মধ্যে পড়তে পারা, লিখতে পারা ও গাণিতিক দক্ষতা রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ১০টি জীবনদক্ষতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুনিয়াব্যাপী এটি অনুসরণ করা হয়, আমাদের দেশেও অনুসরণ করে। আমরা জীবন দক্ষতা ও সাক্ষরতার ক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছি না। যে কারণে দেখা যায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পরও ঠিকমতো লিখতে, পড়তে পারে না। গাণিতিক দক্ষতা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে হচ্ছে না। জীবন দক্ষতা তো আরো দূরে। যেমন জীবন দক্ষতার একটি উদাহরণ—সাঁতার জানা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও অনেকে সাঁতার পারে না। দেখা যায় নদী, খাল-বিলে সাঁতার না জানার কারণে মারা যাচ্ছে। অথচ এটি প্রাথমিকেই শিখে যাওয়ার কথা। এজন্য অবশ্য অবকাঠামোর বিষয়ও আছে। স্কুলগুলোয় সাঁতার শেখার অবকাঠামোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ জায়গায় মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সে রকম প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও প্রশিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। তাছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনো শিক্ষকের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। দেখা যায়, একজন শিক্ষক অনেক বেশি শিক্ষার্থী পড়াচ্ছেন এবং দিনে চার-পাঁচ ক্লাস নিচ্ছেন।  অথচ প্রতি ৩০ জন শিশুর জন্য দুজন শিক্ষক দরকার। উন্নত দেশগুলো এসব অনুসরণ করে। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের আরো মনোযোগ দেয়া দরকার। মূলত প্রাথমিক শিক্ষায় ঘাটতি থাকার কারণেই আমাদের দেশে কোটি কোটি লোক নিরক্ষর রয়ে গেছে। বেশির ভাগ প্রাথমিক থেকেই ‘ড্রপ আউট’ হয়ে যায়। এছাড়া অবকাঠামোর পাশাপাশি কারিকুলামও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পুরো দেশের জন্য একই কারিকুলাম করে দিয়েছি। এটা কিন্তু ঠিক না, আমরা যদি ইংল্যান্ডের দিকে তাকাই, বিভিন্ন কাউন্টি এমনকি বিদ্যালয় অনুযায়ী কারিকুলাম প্রণয়ন করে। বেসিক কিছু জিনিস অর্থাৎ বিজ্ঞান, গণিত, ভাষা এসব ঠিক রেখে সে বিদ্যালয় বা কাউন্টির প্রয়োজন কী সে অনুযায়ী তৈরি করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের কারিকুলাম দেখেন, পুরো দেশের জন্য এক কারিকুলাম। পাহাড়ি একটি বাচ্চা যা পড়ে, ঢাকা শহরেও তাই পড়ানো হচ্ছে। সিলেটের চা বাগানে বেড়ে ওঠা শিশু চা সম্পর্কে যা পড়ছে, উপকূলবর্তী এলাকার শিশুও একই কারিকুলামে চা সম্পর্কে জানছে। এজন্য ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা আমাদের কারিকুলামে উঠে আসা দরকার। একটি উদাহরণ দিই। আমি অনেক আগে কয়েকটি চরে গিয়েছিলাম, যেখানে রাস্তাঘাট নেই কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। সেখানকার বাচ্চাদের ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ানো হচ্ছে অথচ সেখানে রাস্তাঘাট বা গাড়ি নেই। এটি তো স্থানীয় শিশুদের আরো পরে পড়ানো দরকার, তার আগে সেখানকার পরিবেশে কীভাবে মানিয়ে নেবে সেটি শেখানো প্রয়োজন। যেমন ঘূর্ণিঝড় হলে কী করতে হবে, জীবিকা কী হবে এসব পড়ানো দরকার ছিল। এসব কারণে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারছে না। 

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানে অবনতি হচ্ছে কেন? 

বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলা হয়। যা বৈশ্বিক অঙ্গনে নিত্যনতুন জ্ঞান উদ্ভাবন করবে। জাতির চাহিদা পূরণের জন্য বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাজ করলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেভাবে পারছে না। এক্ষেত্রে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা ও দর্শন জাতিগতভাবে এখনো আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। বিশেষ করে আমাদের যারা নীতিনির্ধারক রয়েছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এ বিষয়গুলো ভালোভাবে অনুধাবন করছেন না। যার ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনার্স-মাস্টার্স করানো হচ্ছে। দিনে-রাতে ব্যাচ, সার্টিফিকেট ও ডিগ্রি দেয়া হচ্ছে। এটা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ? বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন তো এটি নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?

বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্পষ্ট কাজ হলো বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ ও জাতির জন্য নিত্যনতুন জ্ঞান উদ্ভাবন করা। দ্বিতীয় কাজ জ্ঞান সংরক্ষণ করা, তৃতীয় কাজ জ্ঞানের বিস্তার ঘটানো। এ তিনটি কাজের মানদণ্ডে যদি দেখি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী করছে? হাতে গোনা দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া নিত্যনতুন জ্ঞান উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে খুবই ‍দুর্বল ভূমিকায় রয়েছে। তবে সফলতাও রয়েছে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাউকুল থেকে শুরু করে অনেক কিছুর উদ্ভাবন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও কিছু ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যে পরিমাণে ভূমিকা পালন করার কথা, সে প্রত্যাশিত পরিমাণে পারছে না। এজন্য প্রত্যাশা না থাকার একটি বিষয় রয়েছে, যা আমাদের প্রথম সমস্যা। দ্বিতীয় সমস্যা হলো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ধরনের ডেডিকেশন, সুযোগ-সুবিধা, বাজেট, শিক্ষক থাকা দরকার। সেই সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উৎসাহী করা প্রয়োজন, গবেষণা ও নিত্যনতুন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তাদের যে প্রচেষ্টা সেটি উজ্জীবিত করার কাজটি হচ্ছে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ইনোভেশনের চেয়ে সনদ ও ডিগ্রি নির্ভরতাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। বলা হয়, যে দেশে জ্ঞানের কদর করা হয় না, সে দেশে জ্ঞানী জন্মায় না। আমরা কাদের কদর করছি? কাদের বিভিন্ন বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করছি? কাদের উৎসাহিত করছি? দেখা যাচ্ছে যারা রাজনীতি করছে, বিভিন্ন দল করছে, তাদের আমরা বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করছি। শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের মধ্যে যারা প্রকৃত গবেষক তাদের আমরা সেভাবে উৎসাহিত করছি না। যে কারণে জ্ঞান উদ্ভাবনের জায়গায় ঘাটতি রয়ে গেছে। প্রথমত আমরা জানি না, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী। দ্বিতীয়ত অবকাঠামোর অভাব আছে আমাদের। ল্যাব থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যূনতম অবকাঠামো নেই। প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েই ভালো থাকার জায়গা পায় না। তারা গণরুমে থাকে, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে রাজনীতি করা লাগে। তারা কখন গবেষণা করবে? সার্টিফিকেট নিয়েই তো একধরনের ব্যস্ততার মধ্যে তারা থাকে। ফলে এ জায়গাগুলো থেকে তারা দূরে সরে যাচ্ছে। যে কারণে র‌্যাংকিংয়েও আমাদের অবস্থান কমে যাচ্ছে।

আমাদের নতুন নতুন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় সেগুলোর ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

উচ্চশিক্ষা কিন্তু সবার জন্য নয়। উচ্চ শিক্ষা কেবল তাদের জন্য যাদের মেধা ও আগ্রহ এ দুটোর সমন্বয় আছে। অথচ এখন আমরা দেখছি জেলায় জেলায়, উপজেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন না। আমরা ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ডেকে নিয়ে আসছি। পরে দেখা যাচ্ছে, তারা কর্মক্ষেত্রে সুযোগ পাচ্ছে না। যে বিষয়ে সে পড়াশোনা করছে, দক্ষ হচ্ছে সে বিষয় অনুযায়ী কাজ পাচ্ছে না। এর কারণে এক ধরনের অনীহা তৈরি হয়। দেখা যায়, সরকারি চাকরির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। এমনটা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মূল পড়াশোনা না করে বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করছে। এতে মানের ক্ষেত্রে তো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আবার চাকরির বাজারে সমাজে একধরনের বৈষম্য রয়েছে। 

গবেষণার চেয়ে সরকারি চাকরিতে যোগদানের ঝোঁক বেড়েছে ইদানীং। এমনটি হওয়ার কারণ?

সরকারি চাকরি পেলে সুযোগ-সুবিধা পায়, সামাজিক স্ট্যাটাস পায়। অন্য চাকরি বা গবেষকের ক্ষেত্রে সে সম্মান সমাজে পায় না। যে কারণে একজন বিশেষজ্ঞ সে বুয়েট বা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ল, বিজ্ঞানের একটি গভীর বিষয়ে পড়াশোনা করল সেও বিসিএস দিয়ে পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্স, প্রশাসনের কাজ করছে। এই যে প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার। এর কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের অবনতি হচ্ছে, আমরা যতই শিক্ষার্থীদের বলি পড়ো, গবেষণা করো। কিন্তু তারা দেখছে সিনিয়রদের কী অবস্থা, তারা কোথায় যাচ্ছে? এগুলো দেখে তারা মূল পড়াশোনায় মনোযোগ না দিয়ে যে পড়াশোনা করলে চাকরি হবে, তারা সে পড়াশোনার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যে কারণে শিক্ষার মানে অবনতি হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে বাজেট। গবেষণায় বিভিন্ন বরাদ্দ দেয়া লাগে। এটা অনেক সময় সরকার দেয়, বেসরকারি ফার্মগুলোও দেয়। এক্ষেত্রে বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডিপার্টমেন্টের যে ফান্ড, আমাদের দেশে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড মিলেও তার সমান হবে না। পর্যাপ্ত ফান্ডিং ছাড়া রিসার্চ কীভাবে হবে? সরকারও মনোযোগ দিচ্ছে না, বেসরকারি কোম্পানিগুলো দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সেভাবে এগিয়ে আসছে না। 

বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবকাঠামো থেকে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে যাচ্ছে, এর প্রতিকার কী?

শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। কিন্তু আমাদের এখানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাকে এমনভাবে মোড়কায়ন করে ফেলছে যে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন একটা উদাহরণ দিই, সবাই এখন হয়ে গেছে পরীক্ষার্থী, এসএসসি/এইচএসসি পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থী নয়। অর্থাৎ, মূল টার্গেট হলো পরীক্ষা, এর মাধ্যমে ভালো একটা গ্রেড অর্জন। শেখা মূল টার্গেট না, এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে সার্টিফিকেট। সিজিপিএ কত পেল, এ প্লাস না গোল্ডেন এ প্লাস পেল—এসব গুরুত্ব পাচ্ছে। এতে শিক্ষার উদ্দেশ্য হারিয়ে যাচ্ছে। অতিমাত্রায় রেজাল্টের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে। অবশ্য সিজিপিএর আগে বিভিন্ন শ্রেণী বা মেধাতালিকা নিয়ে একটা হইহুল্লোড় ছিল। তবে ইদানীং এটিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়ার কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড হয়ে যাচ্ছে। সন্তান কী শিখল, সেটি গুরুত্বপূর্ণ না, কী গ্রেড পেল সেটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। এটাকে আমি সামাজিক অসুস্থতা মনে করি। এ অসুস্থতার ফলে অভিভাবকরা যে চাপ তৈরি করে এর দায়ভার স্কুলকেও নিতে হয়। এভাবে পুরো জাতির মধ্যে এটা ছড়িয়ে পড়েছে। আমি মনে করি এ অসুস্থতা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। এ রকম বহু উদাহরণ রয়েছে যে ভালো ফলাফল করেছে কিন্তু পরবর্তী সময়ে ভালো কিছু করতে পারেনি। অন্যদিকে মোটামুটি গ্রেডের রেজাল্ট দিয়ে অনেক ভালো করছে এমন উদাহরণও আছে। এ জায়গাগুলোকে হাইলাইট করতে হবে, তাহলে এ অসুস্থতা থেকে বের হয়ে আসা যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন