বিশ্লেষণ

ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে

ড. আর এম দেবনাথ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সাবেক ‘‌পূর্ব পাকিস্তান’ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে অত্যাচারিত হয়ে এক কোটির অধিক শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। তখন ভারতে খাদ্যাভাব। মোটা মোটা কঙ্করসহ চালের ভাত আর বড় বড় গোল আলু খেতে খেতে আমরা কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। ভাবলাম কোথায় এলাম? খাদ্যাভাবের দেশে আশ্রয়। এটা মোটামুটি ৫০-৫২ বছর আগের ঘটনা। এখনকার অবস্থা কী? ভারত কি খাদ্যাভাবের দেশ? মোটেই না। বরং উল্টো। ভারত চালে-গমে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, তারা ৪২টির বেশি সংখ্যক দেশে চাল রফতানি করে। ওই সব দেশের ৫০ শতাংশেরও বেশি চাল আমদানি হয় ভারত থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিশ্বে মোট রফতানি হওয়া চালের প্রায় ৪০ শতাংশ রফতানি করেছে ভারত (বণিক বার্তা ২৭.০৮.২৩)। চলতি অর্থবছরে ৪৫ লাখ টন বাসমতী চাল রফতানি করেছে ভারত। শুধু চাল-গম নয়, ভারত অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে খুবই ভালো করছে। আমরাও চাল ও গমের আমদানির জন্য ভারতের ওপর বেশ কিছুটা নির্ভরশীল। শুধু চাল ও গম নয় বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের বাজারেও ভারতের পণ্যের উপস্থিতি লক্ষণীয়। কাঁচা বাজারে গেলেই এর সত্যতা মিলবে। সংকটকালীন অবস্থায়ও আমরা অনেক পণ্য ভারত থেকে আমদানি করি। পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, চিনি আমদানির ঘটনা তো নিত্যদিনের। এমনকি এবার কাঁচামরিচও ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। ডিমও আমদানি হয়। মসলা-পাতিসহ অন্যান্য দ্রব্যের কথা নাইবা বললাম। আমি শুধু বলছি ভোগ্যপণ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির কথা। 

বণিক বার্তাতেই কয়েকদিন আগে এ সম্পর্কে সুন্দর একটি স্টোরি প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আমরা কি ভোগ্যপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ক্রমেই ভারতনির্ভর হয়ে পড়ছি। বণিক বার্তার খবরের সত্যতা মেলে আরেকটি খবরে। ২৭ তারিখে প্রকাশিত একটি কাগজের খবরে শিরোনাম হচ্ছে ‘‌সাত নিত্যপণ্য সরবরাহের আশ্বাস ভারতের মন্ত্রীর’। খবরটিতে দেখা যায়, আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলছেন, ‘‌দিল্লির ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও আমার আলাদা বৈঠক হয়েছে। বাংলাদেশের ব্যাপারে তারা ইতিবাচক। নিত্যপণ্য কোটা রাখা ও পণ্যে শিগগির ছাড় পাওয়া যাবে, আশ্বাস পেয়েছি।’ মন্ত্রী কথিত সাতটি পণ্য কী? দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে চেয়েছে ১৫ লাখ টন চাল, ২৬ লাখ টন গম, ১০ লাখ টন চিনি, ৮ লাখ টন পেঁয়াজ, ৫০ হাজার টন আদা, ৭০ হাজার টন রসুন ও ১ লাখ টন মসুর ডাল। এ চাওয়ার তালিকা থেকে কী বোঝা যায়? আমরা চাল উৎপাদনে ঈর্ষণীয় উন্নতি করলেও খাদ্যশস্যসহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতিতে রয়েছি। এখন বিশ্বজুড়ে নানা সংকট চলছে। চাল ও গমের আমদানি নিয়ে সমস্যা হতে পারে। হতে পারে চিনি ইত্যাদিতেও। অতএব পূর্বাহ্নেই ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। আরো কথা এই যে বাণিজ্য ও আমদানিনির্ভরতা, পরস্পর নির্ভরশীলতা, যোগাযোগ, কানেক্টিভিটি, বিনিয়োগ, বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয় বহুদিন ধরে আমাদের দেশে আলোচিত। 

সামরিক-আধাসামরিক শাসনামলেই তৈরি হয়েছিল ‘‌সার্ক (সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব রিজিওনাল কো-অপারেশন)। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ ছিল এর সদস্য। এ সার্কের আলোচনা এমন এক পর্যায়ে উঠেছিল যে আমাদের বর্তমান সরকারের একজন ব্যবসায়ী ও উপদেষ্টা একবার বলেছিলেন, ‘‌সার্কের’ মুদ্রা হবে একটি। যিনি বলেছিলেন তখন তিনি ছিলেন সার্ক প্রস্তাবের সভাপতি। বলা বাহুল্য, ‘‌সার্ক’ বহু আগেই মাঠে মারা যায়। কে দায়ী এ আলোচনায় গিয়ে লাভ নেই। তবে আমার মনে আছে, আমাদের দেশের একশ্রেণীর মিডিয়া তখন সার্কের তীব্র বিরোধী ছিল। তাদের কথা ছিল একটা: ভারত এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিযোগিতামূলক, পারস্পরিক সম্পূরক নয়। ওই বাদানুবাদ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সার্ক ধারণা পেছনে পড়ে। তখন আঞ্চলিক সহযোগিতার একটা কাঠামো উপস্থাপন করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। তারা বলে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান মিলে একটা চতুর্দেশীয় সহযোগিতা তৈরি হতে পারে। এর উদ্দেশ্য হবে আঞ্চলিক সম্পদের ব্যবহার, আঞ্চলিক বাজার সৃষ্টি, আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিনিয়োগ, চতুর্দেশীয় কানেক্টিভিটি—রেল, সড়ক, বিমান, নৌপথ সব ক্ষেত্রেই। মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে পারস্পরিক আস্থা তৈরি করাও তার উদ্দেশ্য ছিল। কারণ বারবার দেখা গেছে, এখানে আঞ্চলিক সহযোগিতা সৃষ্টির প্রধান বাধা হচ্ছে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাব। স্বাধীনতার পর থেকে এটা লক্ষ করে আসছি। তবে আশার কথা এখন বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা নিজেদের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলেছেন। তাদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। আমদানি, রফতানি বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বিবিধ ব্যবসা দিনে দিনে বাড়ছে। এতে সরকারগুলো সহায়তা করছে। সহায়তা করছে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ সব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে নেপাল, ভুটানের সঙ্গে সম্পর্কের পরিপূরক হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য তারা এখন কানেক্টিভিটির ওপর জোর দিচ্ছে। চতুর্দেশীয় উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তারা যোগ করছে আরো বড় একটি প্রকল্প। এর নাম বাংলাদেশ ইকোনমিক করিডোর ডেভেলপমেন্ট। এ আলোচনায় একটু পরে আসছি। 

এরই মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কানেক্টিভিটি বেশ কিছুটা অগ্রসর হয়েছে। ঢাকা-কলকাতা, খুলনা-কলকাতা, ঢাকা-আগরতলা, ঢাকা-শিলিগুড়ি সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। আখাউড়া-আগরতলা ট্রেন চালু হচ্ছে। নদীপথে ভারতের কলকাতা, হলদিয়া থেকে মালামাল উত্তর-পূর্ব ভারতে যথারীতি যাচ্ছে। চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর ভারত ব্যবহার করতে পারছে। এর মাধ্যমে তারা পূর্ব ভারতে মালামাল পাঠাতে পারবে। স্থল বাণিজ্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য এলাকা উন্মুক্ত হবে। সাতটি নতুন স্থল বাণিজ্য কেন্দ্র চালু করার কথা হচ্ছে। বাংলাদেশ ভারতের পূর্ব দিকের ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। বাংলাদেশ-নেপাল সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর, মোংলা বন্দর চারটি নদীপথের মাধ্যমে কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, আসাম, ত্রিপুরা আর মেঘালয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। বিবিরবাজার থেকে শ্রীমন্তপুর (ত্রিপুরা) হয়ে আখাউড়া থেকে আগরতলা ইত্যাদি অঞ্চলে চলবে আন্তঃদেশীয় ট্রাক। 

বাংলাদেশ, চীন, ইন্ডিয়া ও মিয়ানমার (বিসিআইএম) তৈরি হয়েছে সহযোগিতার ক্ষেত্র আরো প্রসারিত করার জন্য। দেখা যাচ্ছে এসবের ফলে লাখ লাখ বাংলাদেশী-ভারতীয় পর্যটনে, চিকিৎসা পর্যটনে উৎসাহিত হচ্ছে। বাড়ছে আমাদের রফতানি। চীনের পরই ভারত হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় আমদানির উৎস। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানীকৃত পণ্যের মূল্য ছিল ১ হাজার ৬১৯ কোটি ডলার। রফতানি অবশ্যই খুব কম—মাত্র ১৯৯ কোটি ডলার। তবে রফতানি বিশেষ করে তৈরি পোশাকের রফতানি ভারতে বাড়ছে। বিরাট এ বাণিজ্য ঘাটতি কীভাবে দূর করা যায় এ প্রশ্নই এখন সর্বত্র। যেসব অবকাঠামো আমরা তৈরি করেছি, এর মধ্যে রয়েছে অনেক মেগা প্রকল্প। মেগা প্রকল্পগুলোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার একা সম্ভব নয়। এসব প্রকল্পের সঙ্গে বৃহত্তর সহযোগিতামূলক প্রকল্প দরকার।

অবশ্যই এ সহযোগিতা প্রতিবেশী দেশসহ অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় দেশের সঙ্গে করতে হবে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ইত্যাদি উন্নয়নশীল দেশ আমাদের পূর্বে অবস্থিত। তাদের সঙ্গেও আমাদের সহযোগিতা, কানেক্টিভিটি দরকার। এক্ষেত্রেই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বর্তমান বাংলাদেশ ইকোনমিক করিডোর ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পটি আমাদের কাজে লাগবে। প্রকাশিত এক খবরে দেখা যাচ্ছে এ করিডোরে অনেকগুলো প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে আছে ৫৬টি রেল প্রকল্প, ৩৩টি জলপথ প্রকল্প, ১১৪টি সড়কপথ প্রকল্প, ২৯টি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, ১২ হাজার ১৫০টি স্কুল স্থাপন, ১ লাখ ৩৪ হাজার হাসপাতাল শয্যা স্থাপন ও ১২টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি। এসব প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল যুক্ত হবে সেগুলো হচ্ছে ভারতের কলকাতা, বেনাপোল, গুয়াহাটি, শিলং, ইম্ফল, শিলচর, আগরতলা, আইজল। ভুটানের থিম্পু। বাংলাদেশে যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল যুক্ত হবে সেগুলো হচ্ছে মোংলা বন্দর, পায়রা বন্দর, খুলনা, যশোর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, আখাউড়া, বিবিরবাজার, সিলেট, তামাবিল। 

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন ঢাকা শহর ও বিভাগ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যা কাম্য নয়। এখন প্রশ্ন বাংলাদেশ কি এ করিডোর প্রস্তাবে রাজি হবে? যদি আমরা রাজি হই, তাহলে এ প্রকল্পের মাধ্যমে এ অঞ্চলে উৎপাদন বাড়বে ৩২ বিলিয়ন থেকে ২৮৬ বিলিয়ন ডলারে। এতে সাত কোটিরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক মনে করে। দেখা যাচ্ছে, এ প্রকল্পে আমাদের ১৪টি জেলা উপকৃত হবে আর লোকসংখ্যা উপকৃত হবে মোট জনসংখ্যার ৩৪ শতাংশ। লক্ষণীয় এ করিডোরে আমাদের উত্তরবঙ্গের এলাকাগুলো অনুপস্থিত। অথচ ওই অঞ্চলই বেশি অনুন্নত। তবে থিম্পু থাকা মানেই ভুটান আছে। ভুটান, নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ এ চতুর্দেশীয় উন্নয়ন কাঠামোয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক আরো কাজ করতে পারে। আমার মনে হয় বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এমন এক পর্যায়ে আছে, যেখানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের করিডোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিষয়টি মূলত অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক কানেক্টিভিটি সম্পর্কিত। এখানে বিশাল বিনিয়োগের প্রয়োজন। এ বিনিয়োগের অর্থ আমাদের নেই। আমাদের বেসরকারি খাতের ক্ষমতাও সীমিত। যদি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের অর্থ সহায়তা নিয়ে আসে, তাহলে প্রস্তাবটি গৃহীত হতে পারে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে প্রশংসনীয় পর্যায়ে কানেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাণিজ্যিক সম্পর্কও ধীরে ধীরে দৃঢ় হচ্ছে। সম্পর্কটি হচ্ছে সহযোগিতামূলক। মনে হয় আমাদের বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা এ করিডোর প্রস্তাব ইতিবাচকভাবে দেখবেন। তাহলেই দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠবে। আমাদের রফতানি বাড়বে, রাজস্ব আয় বাড়বে। অবকাঠামো গড়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় কথা ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি দূর হবে।


ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন