আলোকপাত

পানি রাজনীতির শেষ কোথায়?

ড. এএসএম সাইফুল্লাহ

পানিতে যেমন জীবনের উদ্ভব, তেমনি পানি ছাড়া জীবের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যেমন পানি দরকার তেমনি একটি রাষ্ট্রের কিংবা অঞ্চলের উন্নয়ন, সাফল্যও পানির লভ্যতার ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা থেকে মিসরের নীল নদ, ব্রাজিলের রেইন ফরেস্টের অ্যামাজনসহ সব নদীরই রয়েছে আঞ্চলিক সীমানায় এবং বিশ্ব পরিমণ্ডলে বিশাল অবদান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, জনপদ, সম্প্রদায় তাদের উন্নয়ন ও জীবন-জীবিকার জন্য বেছে নিয়েছে নদী কিংবা সাগর-তীরবর্তী স্থান। 

আমরা দেখি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট নদীগুলো বিভিন্ন দেশের সীমানা তৈরি করছে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রবাহিত হচ্ছে, যেমন সীমানাগতভাবে আলাদা করছে তেমনি সম্পর্কও স্থাপন করছে। নীল নদ প্রায় এক ডজন দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে একটি বিশাল জনপদকে সজীব করেছে। কিন্তু কিছু মানুষ তার স্বার্থে নদীকে তার রাষ্ট্রীয় সীমানায় আবদ্ধ রেখে এককভাবে সম্পদ ভোগ করে, যার ফলে আঞ্চলিক সংকট সৃষ্টি হয়। তবে জলাধার অথবা নদীর পানির ভাগাভাগি না থাকলে পৃথিবীতে শান্তি থাকত না। কোনোভাবে পানি ভাগাভাগির সমঝোতা বিনষ্ট হলে এর পরিণতি দেশে দেশে ও জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ।

রাজনীতির আঞ্চলিক কিংবা বৈশ্বিক নানা মারপ্যাঁচের মধ্যে পানি এক অতিগুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তঃসীমান্ত পানিসম্পদ ব্যবহার নিয়ে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সহযোগিতার পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ ও অধ্যয়ন বিষয়টিকে ‘পানি রাজনীতি’ (‘ওয়াটার পলিটিকস’) কিংবা কখনো ‘হাইড্রো পলিটিকস’ নামেও অভিহিত করা হয়। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পানির গুরুত্ব বিবেচনায় ‘পানি রাজনীতি’ বিষয়টি এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত। 

পিপি মোলিংগা তার লেখনীতে পানি রাজনীতিকে চারটি বিভাগে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। যেমন পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার দৈনন্দিন রাজনীতি; সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে পানি নীতির রাজনীতি, আন্তঃরাজ্য পানি রাজনীতি এবং পানির বৈশ্বিক রাজনীতি। অঞ্চল, সময় ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাজনীতির ধরনও পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। অনেক সময় দেখা গেছে, আন্তঃরাষ্ট্র পানি রাজনীতির দ্বন্দ্ব সমাধান করতে গিয়ে অন্তঃরাষ্ট্র রাজনীতি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো কখনো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা (যেমন গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র কিংবা একনায়কতন্ত্র) ও পানি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। 

পানিসম্পদের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার কিংবা পানিসম্পদের কৌশলগত ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার নজির সেই খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে চলে আসছে। ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক পানিসম্পদ বিষয়ক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক ইনস্টিটিউটের মতে, ২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী পানি নিয়ে সংঘাত হয়েছে কয়েকশ বার। বলা চলে, পানির ভাগাভাগি নিয়ে কিংবা এর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে কিংবা পানি ব্যবহার করে অন্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানুষের মাঝে দ্বন্দ্ব যেমন পুরনো তেমনি পানিকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাচীনকাল থেকে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পশ্চিম এশিয়ার দেশ প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় সেই খ্রিস্টপূর্ব ২৫ শতকেই পানি নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। ‘ওয়াটার কনফ্লিক্টস ক্রোনলজি’ নামে একটি রিপোর্ট পানিকে কেন্দ্র করে এবং পানির ব্যবহারের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ১ হাজার ২৯৮টি বিরোধ ও সংঘাত সংঘটিত হওয়ার তথ্য দিয়েছে। 

ইতিহাস মতে, শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে লাগাসের রাজা উরলামা খ্রিস্টপূর্ব ২৪৫০ থেকে ২৪০০ অব্দ পর্যন্ত পানির ধারার গতি পরিবর্তনের মাধ্যমে শুষ্ক অঞ্চলকে পানিবঞ্চিত করে আরো শুষ্ক অঞ্চলে পরিণত করতে থাকেন। এমনকি তার দ্বিতীয় পুত্র গিরসা শহরের পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেন। বিরোধটি শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র রূপ ধারণ করে। এরপর খ্রিস্টপূর্ব ১৭২০ থেকে ১৬৮৪ অব্দ সময়ে বিখ্যাত টাইগ্রিস নদীতে বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। প্রচলিত আছে হামুরাবির দৌহিত্র আবিশ কিংবা আবি-এশুহ ব্যাবিলনের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী বিদ্রোহীদের দমনের জন্য টাইগ্রিস নদীতে বাঁধ নির্মাণ করেন। নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে ভাটির দেশকে পানিবঞ্চিত করার ভয়ানক রাজনীতির শুরুও সেই অনেক আগে। বর্তমানেও সেই দীর্ঘ প্রাচীন কৌশল অবলম্বন করতে দেখা যায়, যেখানে উজানের দেশগুলো ভাটির দেশে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, অনেক সময় স্বার্থ আদায়ে দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবেও পানিকে ব্যবহার করা হয়। এশিয়া মহাদেশ কিংবা আরো ক্ষুদ্রাঙ্গনে বললে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায়ও এমনটা চলছেই। এখানে আন্তঃরাষ্ট্র ও অন্তঃরাষ্ট্র পানি রাজনীতি সম্প্রীতি বিনষ্ট করেই চলছে।

খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরের সময়ের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ৩০ খ্রিস্টাব্দে ইহুদি বিক্ষোভকারীরা পানির ধারা পরিবর্তনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে রোমান সৈন্যদের হাতে নিহত হয়। রোমান প্রকিউরেটর পন্টিয়াস পিলাট তার তথাকথিত পবিত্র অর্থ ব্যবহার করে ইসরায়েলের জেরুজালেমের দিকে পানির পরিবর্তিত প্রবাহের সৃষ্টি করেন। ইহুদিরা এ পরিবর্তনে ক্ষুব্ধ হয় এবং হাজার হাজার লোক প্রতিবাদ করতে জড়ো হয়। পিলাটের সৈন্যরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যায় এবং ধারালো ছুরি দিয়ে আক্রমণ করে। ফলে অনেক ইহুদি রোমান সৈন্যদের হাতে নিহত হয়। 

যুদ্ধক্ষেত্রে পানির প্রবাহকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার উদাহরণও অনেক আগের। ১৬৭২ সালে চতুর্দশ লুই তৃতীয় ডাচ যুদ্ধ শুরু করেন, যেখানে ফরাসিরা নেদারল্যান্ডসকে পরাজিত করে। প্রতিরক্ষার খাতিরে ডাচরা তাদের বাঁধগুলো খুলে দেয় এবং দেশটিকে প্লাবিত করে এমন একটি জলীয় বাধা তৈরি করে যা কার্যত দুর্ভেদ্য হয়ে পড়ে।

পানি নিয়ে নানা রাজনীতির সাম্প্রতিক শতকের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৭৪ সালে ইরাক সিরিয়ার বাঁধ বোমা দিয়ে ধ্বংস করে দেয়ার হুমকি দেয়। ইরাকের অভিযোগ ছিল, সিরিয়া ইউফ্রেটিস নদীতে বাঁধ দেয়ার কারণে ইরাকে পানির প্রবাহ কমে গেছে এবং এ অভিযোগে ইরাক তার সীমান্তে সশস্ত্র সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। ১৯৭৬ সালে চীনের ঝাং নদী নিয়ে এক সংঘর্ষে মিলিশিয়াপ্রধান গুলিবিদ্ধ হন। ঝাং নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ এবং অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহারের কারণে ওই অঞ্চলে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয় এমন অভিযোগে সংঘর্ষের উদ্ভব। 

বিরোধ থেকে পানিকে ব্যবহার করে ভয়াবহ প্রতিশোধ নেয়ার নজিরও রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ১৯৭৬ সালে পানির দূষণ ঘটিয়ে মোজাম্বিকের ক্ষতি করার চেষ্টা করে দক্ষিণ আফ্রিকা। ওই সময়ে মোজাম্বিকের ভূ-উপরিস্থ এবং ভূগর্ভস্থ পানিতে এক ধরনের অজ্ঞাত ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন সূত্র বলছে, রোডেশিয়ান সরকার কৃষ্ণাঙ্গদের শায়েস্তা করার জন্য মোজাম্বিকের পানিতে এ অজানা ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার ঘটিয়ে দূষণ ঘটায়। 

নদীকে যেমন দেশের সীমানা নির্ধারণে সাহায্য করতে দেখা যায় তেমনি অনেক দেশ আছে যারা আন্তঃসীমান্ত নদী, হ্রদের জলজ সম্পদ ভাগাভাগি করে থাকে। যেমন মিসরের নীল নদ প্রায় ১২টি দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী। এ নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে চলে বিস্তর রাজনীতি, তা হোক অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তঃরাষ্ট্র। পানির প্রবাহের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করতে গিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অবিশ্বাস লেগেই আছে। 

একুশ শতকে এসে দেখা যাচ্ছে যে আমাদের স্বাদু পানির উৎসগুলো দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বৃদ্ধিও রাষ্ট্রীয় সীমানা ওলট-পালট করে দিতে পারে বলে মনে করা হয়। বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার বিস্ফোরণ সম্পদের অতিব্যবহারকে ত্বরান্বিত করছে এবং ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে, মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। এ কারণে আন্তঃরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্কেও চিড় ধরছে। বিশ্ব রাজনীতিতে পানির প্রভাব শত শত বছর আগে থেকেই চলে আসছে। প্রাচীন সভ্যতায় জাতি ও রাষ্ট্রের প্রাকৃতিক সীমানা নির্ধারণ করত জলাধার। যেমন নদী, পরিখা খনন করা হতো। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভূরাজনীতির চিত্র ভিন্নতর, তবুও পানির সহজলভ্যতা, প্রাপ্যতা ভূরাজনীতির একটা বিশাল নিয়ামক। 

নদীর প্রবাহের ক্ষেত্রে দেখা যায়, উজানের দেশগুলো যেমন পানির সুবিধা বেশি পায় তেমনি তারা এর নিয়ন্ত্রক হয়ে যায় এবং ভাটির দেশগুলোকে তাকিয়ে থাকতে হয় উজানে অবস্থিত দেশগুলোর দিকে। বিশ্বব্যাপী নদীর উৎসের দেশগুলো পানিসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ভাটির দেশগুলোর ওপর অবিচার করছে অহরহ। ভাটি অঞ্চলে অনেক নদী তীরবর্তী জনপদে সেখানের লোকজনের চলাচল, জীবন-জীবিকার বিরাট একটা অংশজুড়ে থাকে নদী। উজানে খবরদারি, পানিপ্রবাহে বাধাদানের মাধ্যমে মূলত ভাটির লোকজনের ওপর ছড়ি ঘোরানো এক ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক রাজনীতি, যা ভাটির লোকজনের জন্য বিপদ ডেকে আনে এবং জীবনকে করে তোলে দুর্বিষহ। 

মধ্যপ্রাচ্যে জর্ডান নদী অববাহিকার দেশ জর্ডান, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলসহ অনেক অঞ্চল জর্ডান নদীর পানি ব্যবহার করে এবং এর বণ্টন নিয়ে এ অঞ্চলে উত্তেজনা লেগেই থাকে। পানির অভাবে সিরিয়ায় সহস্রাব্দের দীর্ঘ ভয়াবহ খরায় যে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল সেখান থেকে উগ্রপন্থা তথা ইসলামিক স্টেটের উদ্ভব হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। 

প্রায় এক শতাব্দী ধরে মিসর ও ইথিওপিয়া নীল নদের পানি ব্যবহার করে আসছে তাদের উন্নয়নকাজে। বহুল পরিচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ নীল নদ ইথিওপিয়ায় উৎপত্তি লাভ করে মিসরে গিয়ে শেষ হয় এবং এর গতিপথে পানির ব্যবহারে ভাগাভাগি থেকে সৃষ্টি হয় নানা বিরোধের। ২০১৫ সালে নীল নদের ওপর গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ বাঁধ নির্মাণ করা হয়, যেটিকে আফ্রিকার বৃহত্তম বাঁধ মনে করা হয়। এ নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে পানির ন্যায্য হিস্যা বিষয়ে চুক্তিও স্বাক্ষর হয়। কিন্তু অসন্তোষ পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। পানির হিস্যা নিয়ে বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে চুক্তি রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই চুক্তি মেনে চলায় ব্যত্যয় দেখা যায় এবং একে ঘিরে প্রতিবেশী দেশগুলোর মাঝে বিরোধ লেগে থাকার নজির অনেক। 

স্বাদু পানির লভ্যতা একটি উন্নত দেশের জন্যও অতি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন দেখা যায় সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে। দেশটি মালয়েশিয়ার সঙ্গে ৯৯ বছরের পানিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যাতে তারা জোহর নদী থেকে স্বাদু পানি পেতে পারে। চারদিকে সমুদ্র দিয়ে বেষ্টিত দেশটিতে স্বাদু পানির অভাব তার সব উন্নতিকে দুর্বল করে দেয়। স্বাদু পানির সহজলভ্যতা ব্যতীত সিঙ্গাপুরের কোনো উন্নতিই মূলত টেকসই নয়। এমনকি পানির অভাব দেশটির শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংস্কৃতি সবকিছুকে স্থবির করে দিতে পারে। এক্ষেত্রে পানি নিয়ে প্রতিবেশী মালয়েশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বিনষ্ট হলে সিঙ্গাপুর আদতেই অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

একুশ শতকের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পানি নিয়ে বিরোধ এবং তা থেকে নানা রাজনীতি, বিরোধ, সংঘর্ষ, হত্যা কোনো অংশেই কমেনি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেয়েছে নতুন মাত্রা। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ফিলিস্তিন জবরদখলকারী ইসরায়েলের সৈন্যরা পশ্চিমতীরের ইবজিকে পানির ট্যাংকি ধ্বংস করে দেয় এবং কৃষি ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। একই বছর ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে রাশিয়ার সৈন্যরা ইউক্রেনে দখলকৃত অঞ্চলে ইউক্রেন ও ক্রিমিয়ার মাঝে ২০১৪ সালে নির্মিত একটি কংক্রিট বাঁধ ধ্বংস করে দেয় এবং এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা আমাদের অতি আদিম হিংস্রতাকে যেন আবার জাগিয়ে তুলছে। 

পানি প্রাচীনকাল থেকেই অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। পানিকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বসতি গড়ে উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাই এ কৌশলগত প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজের আয়ত্তে রাখতে মরিয়া থাকে সব দেশ। পানির সহজলভ্যতা একদিকে যেমন হ্রাস পাচ্ছে, ঠিক আরেকদিকে পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা বেড়েই চলছে। এ কারণে অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে পানির গুরুত্ব দিন দিন তেলের সমান হয়ে উঠবে। সারা বিশ্বে পানিসম্পদে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে কানাডা, চিলি, নরওয়ে, কলম্বিয়া ও পেরুর মতো দেশ। ধারণা করা হয়, কালের চক্রে এ দেশগুলো পানিসম্পদের প্রাচুর্যের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রমে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

পানীয় জলের অভাব বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বড় কারণ হয়ে উঠবে বলে মনে হচ্ছে। মজার বিষয় হলো বিশ্বের একটা অংশ পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে বোতলজাত পানি ব্যবহার করছে। পানি দ্বারা সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে যদিও আদতে তেমন একটা সুফল আসছে বলে মনে হয় না। একই সময় বিশ্বের আরেক অংশের দারিদ্র্যপীড়িত অসহায় মানুষ তীব্র জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে নালা, হ্রদ ও নদী থেকে পানি পান করতে গিয়ে। 

অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক পানি অধিকার দরকষাকষি এবং রাজনীতি ছাড়াও নদী তীরবর্তী অঞ্চলের দেশগুলোর পানি অধিকার এখন আন্তর্জাতিক কূটনীতির বিষয় হয়ে উঠেছে। ইসমাইল সেরাগেলদিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, “‘বিংশ শতাব্দীর অনেক যুদ্ধ তেল নিয়ে ছিল, তবে একবিংশ শতাব্দীর যুদ্ধগুলো পানি নিয়ে হবে যদি না আমরা পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পরিবর্তন করি।’ অনেকে অবশ্য বিষয়টির সঙ্গে দ্বিমতও পোষণ করেন। অনেকের মতে, পানি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ কূটনীতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান হবে এবং এ নিয়ে যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চুক্তি করা এবং তা পুরোপুরি মেনে না চলা কিংবা ভাঙার নজিরও পৃথিবীতে অনেক রয়েছে। তাই নদীর পানি ভাগাভাগির চুক্তির ব্যত্যয় হলে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ শুরু হতে পারে এবং সেখান থেকে যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াতে পারে। তাই শুধু চুক্তিই যে বিরোধের মুক্তি দিতে পারে তা নয়।

শুরুতে পানি নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির যে অবতারণা করেছিলাম তার সূত্র ধরে প্রশ্ন আসে—আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব যে প্রত্যেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পাবে এবং এভাবে একবিংশ শতাব্দীতে আপেক্ষিক বিশ্ব শান্তি বজায় থাকবে? পানিকেন্দ্রিক রাজনীতি কিংবা যুদ্ধ কি চলতেই থাকবে? নাকি আমরা ‘পানি যুদ্ধ’ বন্ধ করে একে অন্যের সঙ্গে পানির ভাগাভাগি করে আমাদের জন্য পর্যাপ্ত ফসল ফলাব, ধরিত্রীকে বাঁচিয়ে রাখার, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে শামিল হব? যদি সেটা না হয়, তাহলে প্রশ্ন থেকেই গেল—পানি রাজনীতি কি অনন্তকাল চলবে? 

ড. এএসএম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন