প্রবাসে ঢাকা থেকে শ্রমিক যায় ৩%, রেমিট্যান্সের ৩৩ শতাংশ আসে ঢাকায়

আবু তাহের

প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যায় রাজধানীসহ গোটা ঢাকা জেলার অবদান ৩ শতাংশের সামান্য বেশি। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের পাঠানো মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৩৩ শতাংশ আসছে ঢাকা জেলায়। 

ব্যাংক খাতের কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলো দেশে রেমিট্যান্স আসে তিনভাবে। এর একটি হলো পারসন টু পারসন। অর্থাৎ বিদেশ থেকে একজন ব্যক্তি দেশে থাকা আপনজনের নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ পাঠান। এটি রেমিট্যান্স চ্যানেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। দ্বিতীয়ত, বিজনেস টু বিজনেস। বিদেশী কোনো কোম্পানি বাংলাদেশে থাকা তাদের কর্মীদের বেতন-ভাতা দিলে সেটিও রেমিট্যান্স চ্যানেলে আসে। বাংলাদেশে বিভিন্ন কোম্পানির কার্যালয়গুলো মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। এ কারণে এ অর্থও ঢাকা জেলায় আসে। তৃতীয়ত, প্রবাসী কোনো ব্যক্তির দেশে ব্যবসা থাকলে অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর ব্যাংকিং হিসাব ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রেও লেনদেনকৃত অর্থ ঢাকায় আসতে পারে। এছাড়া কোনো প্রবাসী দেশে টাকা পাঠাতে চাইলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ব্যাংক হিসাবের বাইরে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকিং চ্যানেলে তাদের ঠিকানা হিসেবে ঢাকার কোডকেই ব্যবহার করা হয়। পরবর্তী সময়ে ওই অর্থ দেশে এসে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখায় গিয়ে জমা হয়। তবে এর পরও প্রবাসী গমন ও রেমিট্যান্সের হারে এমন অসামঞ্জস্যের বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন তারা। 

বিএমইটির হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কর্মসংস্থানের উদ্দেশে বিদেশে যাওয়া প্রবাসীর সংখ্যা ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩। এর মধ্যে ঢাকা জেলা থেকে গেছেন মাত্র ৩৪ হাজার ৩৮৭ জন, যা গত বছর প্রবাসে কর্মসংস্থান হওয়া মোট বাংলাদেশীর ৩ শতাংশের কিছু বেশি।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৪৬ বছরে বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য গেছেন মোট ১ কোটি ৪৭ লাখ ৭০ হাজার ৩৪ জন বাংলাদেশী। যদিও তাদের অনেকেই দেশে ফিরে এসেছেন। বেঁচেও নেই অনেকে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মূলত চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালীসহ চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা। 

যদিও দেশে রেমিট্যান্সের সবচেয়ে বড় গন্তব্য এখন ঢাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৯৪১ কোটি ১৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে ঢাকা জেলায়ই এসেছে ৬৩৩ কোটি ২৫ লাখ, যা মোট রেমিট্যান্সের ৩২ দশমিক ৬২ শতাংশ। এর আগে দেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এ দুই অর্থবছরে ঢাকায় রেমিট্যান্স এসেছিল যথাক্রমে ৬৩৬ কোটি ৭০ লাখ ও ৮০২ কোটি ১৬ লাখ। সে অনুযায়ী গত দুই অর্থবছরেও দেশে আসা মোট রেমিট্যান্সের এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি এসেছে ঢাকায়।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে ঢাকার পরেই ছিল চট্টগ্রাম। জেলাটিতে রেমিট্যান্স এসেছে ঢাকার এক-চতুর্থাংশেরও কম, ১৪১ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। এছাড়া এ তালিকায় শীর্ষে থাকা অন্যান্য জেলার মধ্যে কুমিল্লায় ১১৫ কোটি ৮ লাখ, সিলেটে ১০৯ কোটি ৯৫ লাখ, নোয়াখালীতে ৬৩ কোটি ১৪ লাখ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫৭ কোটি ৭৩ লাখ, মৌলভীবাজারে ৫২ কোটি ৯ লাখ, চাঁদপুরে ৫০ কোটি ১১ লাখ, ফেনীতে ৪৯ কোটি ৮৪ লাখ ও টাঙ্গাইলে ৩৬ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে।

প্রবাসী গমন তুলনামূলক কম হলেও অন্যান্য জেলার সঙ্গে ঢাকামুখী রেমিট্যান্সের এ ব্যবধান নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন ব্যাংকাররা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দেশের প্রথম সারির একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকায় আসা রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশের প্রকৃত সুবিধাভোগী খুঁজে পাওয়া কঠিন। দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের একটি অংশ রেমিট্যান্স আকারে ফিরে আসছে। এ কারণে ঢাকায় রেমিট্যান্সের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেশি। আবার দেশের হুন্ডি তৎপরতা ও অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ ব্যক্তিরা ঢাকায় বসেই নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করেন। ঢাকায় রেমিট্যান্স বেশি আসার পেছনে এরও ভূমিকা থাকতে পারে।’ 

দেশে রেমিট্যান্স আনয়নকারী ব্যাংকগুলোর অন্যতম মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি)। ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য জেলার রেমিট্যান্স আহরণের ব্যবধান খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় রেমিট্যান্স প্রেরক ও সুবিধাভোগীর পূর্ণাঙ্গ তথ্য থাকে না। এজন্য ব্যাংক কর্মকর্তারা সে রেমিট্যান্সের ঠিকানা ঢাকায় দেখিয়ে দেন। ঢাকায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশি দেখানোর ক্ষেত্রে এটির ভূমিকা থাকতে পারে। তবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসা জেলার সঙ্গে ঢাকার যে ব্যবধান, সেটি স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। এর ভেতরে ভিন্ন কোনো কারণ আছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা যেতে পারে।’

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গমন করেছেন ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন বাংলাদেশী। ২০২২ সালে ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ এবং চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৪ হাজার ৫১৩ জন। গত বছর বিদেশ গমনকারী এসব বাংলাদেশীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গেছেন কুমিল্লা থেকে। জেলাটি থেকে ১ লাখ ৫ হাজার ৯৯৭ জন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গমন করেছেন। এছাড়া প্রবাসী গমনে শীর্ষ অন্যান্য জেলার মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ৬৯ হাজার ৪৪৮ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ৬২ হাজার ৬৯৮, নোয়াখালী থেকে ৪৮ হাজার ৩৯৩, টাঙ্গাইল থেকে ৪২ হাজার ৩৭৯, কিশোরগঞ্জ থেকে ৩৭ হাজার ৭৮৫, সিলেট থেকে ৩৬ হাজার ৯৭, ঢাকা থেকে ৩৪ হাজার ৩৮৭, নরসিংদী থেকে ৩২ হাজার ৮৭, হবিগঞ্জ থেকে ৩০ হাজার ৮৮৮ ও সুনামগঞ্জ থেকে ২৮ হাজার ৭০৩ জন বিদেশে গেছেন।

দেশের সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে। দেশের বৃহত্তম এ ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলছেন, ঢাকায় যে রেমিট্যান্স আসে, সেটির বড় অংশই প্রবাসী ব্যবসায়ীদের। কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রামের মতো প্রবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলোর প্রবাসীরা যে রেমিট্যান্স পাঠান, সেটির আকার ছোট। আর ঢাকায় আসা রেমিট্যান্সের ধরন বড়। এ কারণে ঢাকার প্রবাসী কম হলেও রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেশি।

দেশ থেকে যাওয়া প্রবাসীদের বড় একটি অংশ ফেনী জেলার। যে পরিমাণ প্রবাসী জেলাটি থেকে বিদেশে গমন করেছেন, সেই হারে রেমিট্যান্স আসছে না বলে জানান সেখানকার ব্যাংকের কর্মকর্তারা। প্রবাসী আয়ের বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে সেখানে লেনদেন হচ্ছে বলে সন্দেহ তাদের। 

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক ফেনীর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হারুন অর রশীদ মানিক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় ফেনী থেকে বেশিসংখ্যক মানুষ প্রবাসে রয়েছেন। কিন্তু জেলায় সে অনুপাতে রেমিট্যান্স আসছে না। আনুপাতিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন না হলে জানা মুশকিল এখানে কী পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে। তবে বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিং বিকাশের মাধ্যমে দেশে অর্থ আসছে। প্রতি মাসে ২০-৩০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে তাদের পরিবার ঘরে বসে পেয়ে যাচ্ছে। এ টাকাগুলো ব্যাংকিং চ্যানেলে ঢুকছে না। কিছু এজেন্ট প্রবাসে বাড়তি মূল্যে রেমিট্যান্স ক্রয় করে তা দেশের বন্ধু-বান্ধবদের দিয়ে বিকাশে লেনদেন করছে। দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার সংকটের এ সময়ে আবার কিছু আমদানিকারী প্রবাসে এজেন্ট বসিয়ে ডলার ক্রয় করে ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াই পণ্য আমদানি করছেন। এটিও রেমিট্যান্স কম আসার একটি কারণ হতে পারে।’

দেশের জনশক্তি রফতানিতে প্রথম সারিতে রয়েছে চট্টগ্রাম। গত বছরও জেলাটি থেকে ৬৯ হাজার ৪৪৮ জন বাংলাদেশী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। বাণিজ্য ও অর্থনীতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র বন্দরনগরী চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকায় গমনের প্রবণতাও অনেক বেশি। বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী প্রবাসে অবস্থান করলেও এ জেলায় বিদেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসার হার তুলনামূলক কম। 

এ প্রসঙ্গে এক্সিম ব্যাংকের অতিরিক্ত উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম জাকের হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী হিসেবে কাজ করলেও সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স আসে না। গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ তুলনামূলক কম। আমদানি-রফতানিসহ নানা কারণে বিদেশে এখানকার মানুষের কাছে ব্যাংকবহির্ভূত চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ থাকে বেশি।’

চট্টগ্রাম কাস্টমস সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমসের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনায় ১২০টির মতো মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়া পাঁচ হাজারের অধিক আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়ায় মানি লন্ডারিং সন্দেহে তদন্ত করছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। মূলত পণ্য আমদানি কিংবা রফতানিতে মূল্য, পরিমাণ ও ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানির মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনায় হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে, যা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা সমন্বয় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক প্রধান সাঈদ মাহমুদ আকতার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাণিজ্যের সহজলভ্যতায় বৈধ চ্যানেলের বাইরে অন্যভাবেও যে অর্থ আসছে না, সেটি বলা যাবে না। তবে পরিসংখ্যানগতভাবে প্রমাণ ছাড়া এ বিষয়ে মন্তব্য করাও ঠিক হবে না। তবে আমদানি-রফতানি ও চোরাকারবারির বাই প্রডাক্ট হিসেবে বিদেশ থেকে দেশে অর্থ আসার বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করেন প্রবাসীরা।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বণিক বার্তার চট্টগ্রাম ব্যুরোর উপপ্রধান সুজিত সাহা ও ফেনী প্রতিনিধি নুর উল্লাহ কায়সার) 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন