সময়ের ভাবনা

দেশীয় ফলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

তৌফিকুল ইসলাম

আম, জাম, লিচু, আনারস, কাঁঠালের ম-ম গন্ধে চারদিক মুখরিত। দেশী ফলগুলোর প্রত্যাশিত উৎপাদনে বিক্রেতাদের মুখেও হাসি ফুটেছে। চলতি বছর তাপপ্রবাহের ফলে আমের মুকুল ফোটা নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সময়মতো বৃষ্টি হওয়ায় এ শঙ্কা কেটে যায়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছে যাচ্ছে সুস্বাদু ফলগুলো। বিগত বছরগুলোয় যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় মানুষ এখন ঘরে বসেই গ্রাম থেকে নিয়ে আসা সুমিষ্ট ফলের স্বাদ উপভোগ করতে পারছে।

দেশীয় ফলের বিপণন ব্যবস্থায় ই-কমার্স যুক্ত হওয়ায় এ খাতে অভূতপূর্ব সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। যার ফলে ভোক্তারা এখন সহজেই কেমিকেল মুক্ত আম খাওয়ার কথা ভাবতে পারছেন। কয়েক বছর আগেও এটি অকল্পনীয় ছিল, যার ফলে ভেজালমুক্ত ফল খাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই দুঃসাধ্য হয়ে যায়। সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে, মানুষ এখন সহজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পেজের মাধ্যমে ফল কিনতে পারছে। ফলের ব্যবসায় প্রযুক্তির ছোঁয়া আসার পর অনেক বেকার তরুণের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি ফল বিক্রি করে স্বাবলম্বী হতে পারছে। 

বর্তমানে সব ফলের চাহিদা থাকলেও মূলত ‘আম’ ব্যবসার প্রতিই ব্যবসায়ীরা অধিক মনোযোগী হচ্ছেন। হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি, গোপালভোগ, হাঁড়িভাঙা, আম্রপালি এসব নানা প্রজাতির আম দেশে উৎপন্ন হয়। এসব আমের চাহিদাও অনেক। অন্যান্য ফলের ক্ষেত্রে রাজশাহী, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জে উৎপন্ন লিচুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও এসব ফলের জনপ্রিয়তা দেখা যায়। পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা, টাঙ্গাইলের মধুপুরের আনারস বেশ সুস্বাদু। বাণিজ্যিকভাবে আনারস উৎপাদন করে এ এলাকার অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছে।

ফলের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। যখন মানুষ আগুন আবিষ্কার করেনি, তখন গাছের ফলমূল খেয়েই বাঁচত। এখনো অনেক মানুষ শুধু ফল খেয়েই জীবন ধারণ করে। ভারতে বসবাসরত ‘জৈন’ ধর্মের অনুসারীরা কোথাও ভ্রমণে গেলে সঙ্গে করে ফল নিয়ে যান। এছাড়া যারা নিরামিষভোজী তাদের কাছেও ফল নিত্যদিনের আহার হিসেবে গণ্য।

প্রাকৃতিক এ খাবারের প্রতি উন্নত দেশগুলো অনেক আগে থেকেই গুরুত্ব প্রদান করে আসছে। এর ফলে আপেল, মাল্টা, বেদানা, কমলা, স্ট্রবেরি থেকে শুরু করে হালে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করা ড্রাগন ফল সবকিছুই বিদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে। এটি ঠিক যেন পাখির মাধ্যমে নির্গত বীজের মাধ্যমে অঙ্কুরিত ফল গাছেরই বাণিজ্যিক সংস্করণ। 

ধারণা করা হয়, দেশে খুচরা পর্যায়ে বছরে ফলের বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিদেশী ফলের চাহিদা বেশি থাকে। কারণ এ সময় দেশীয় ফলের সরবরাহ কম পাওয়া যায়। অবশ্য আম, লিচু, তরমুজের মৌসুমে বিদেশী ফলকে হটিয়ে একচেটিয়া রাজত্ব চালায় দেশীয় সুস্বাদু ফল। সম্প্রতি ডলার সংকটে বিদেশী ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে বিদেশী ফলের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা লাভ কম করে হলেও বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ বছর রমজান মাসে বিদেশী ফলের মূল্য অনেক বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে দেশী ফলগুলো স্বস্তির জোগান দিয়েছে।

বর্তমানে দেশী ফলগুলোর যে চাহিদা তৈরি হয়েছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে ভেজালমুক্ত ফল নিশ্চিত করতে পারলে দেশী ফলের বাজার আরো বৃদ্ধি পাবে। 

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোয় ভোক্তা পর্যায়ে ফল পৌঁছে দিতে সুপারশপগুলোয় অল্প পরিমাণেও ফল বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ কারো যদি কেজি দরে ফল কেনার সামর্থ্য না থাকে, সেও যেন ফল খাওয়া থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য অল্প পরিমাণে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দেশে সীমিত আকারে এ রকম উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বৃহৎ আকারে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন।

ফলের ব্যবসার ক্ষেত্রে নৈতিকতা চর্চাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শুধু আর্থিক লাভের কথা বিবেচনা করে ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রয়োগ করলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে কলা একটি বারোমাসি লাভজনক ফল হওয়ার পরও কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়। গাছে থাকতে এক দফা, ঢাকায় পাঠানোর আগে আরেক দফা কেমিকেল ছিটানো হয়। যার ফলে দেখা যায় রাস্তার পাশের টং দোকানেও কেমিকেল দেয়া কলা মজুদ করা থাকে। গোড়ায় সবুজ রং দেখেই বোঝা যায় কলাগুলো পাকেনি। বিশেষ করে তরমুজের ক্ষেত্রে রঙ মিশিয়ে লাল করার অসাধু মানসিকতাও কাজ করে। আর পিস দরে কিনে কেজি হিসেবে বিক্রি করার মতো অপ্রত্যাশিত বিষয়টি এ বছরও দেখা গেছে। এটি নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে অভিযানও চালাতে হয়েছে।

আমের ক্ষেত্রেও কেমিকেল মেশানোর অভিযোগ রয়েছে। এজন্য বাজারে ভেজালমুক্ত আম বিক্রির ক্ষেত্রে কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। আবার অতীতে মেশিনের ভুলের কারণে কেমিকেলমুক্ত আমও রাস্তায় ফেলে নষ্ট করা হয়েছিল, এ রকম ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

এছাড়া আচার, জেলি, জুস তৈরিতে কৃষকদের কাছ থেকে পাল্প সংগ্রহ করার যে প্রক্রিয়াটি রয়েছে, সেটিও অব্যাহত রাখা দরকার। কারণ এতে সরাসরি কৃষক লাভবান হয়ে থাকেন। এভাবে দেশী ফলের বাজার বিস্তৃতি লাভ করলে দেশের অর্থনীতির জন্যই তা গতিশীলতা বয়ে আনবে। ক্রমেই বিদেশী ফলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারলে আমাদের কৃষকরা লাভবান হবেন। আর দেশী ফল বিদেশী ফলের তুলনায় অনেক স্বাস্থ্যকর ও সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। স্থানীয় ফল হওয়ায় এতে রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বেশি। তার পরও বিদেশী ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে ফলগুলোর স্থানীয় জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশেই উৎপাদন বাড়ানো যায় কিনা তা নিয়ে কৃষিবিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারেন। সব মিলিয়ে দেশের বাজারে ফলের যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগাতে পারলে সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে অতিমুনাফার আশায় অনৈতিকতার আশ্রয় নিলে তা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আমরা আশা করব আমাদের ফলগুলোর চিরায়ত যে স্বাদ রয়েছে, সেটি অটুট থাকুক। এক্ষেত্রে ফল বিপণনে ব্যবসায়ীরা সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা। 

তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন