বৈধ পথে রেমিট্যান্স উৎসাহিত করতে পদক্ষেপ আশা করছি

মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা , ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড

বিভিন্নমুখী সংকট চ্যালেঞ্জের মধ্যে সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। বাজেট নিয়ে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

বিশ্বের উন্নত উন্নয়নশীল অনেক দেশের অর্থনীতি দুই বছরে ধসে পড়েছে। আমরা দেখেছি, শ্রীলংকার মতো একটি দেশের অর্থনীতি কীভাবে ভেঙে পড়েছে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিটি দেশই একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্বের কোনো একটি প্রান্তে অস্থিরতা বিরাজ করলে তার প্রভাব সব দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর আমরা সত্যটি আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিও বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়েছে।

তবে বৈশ্বিক নানা দুর্যোগ সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অগ্রসরমাণ। আমরা সাফল্যের সঙ্গে করোনাভাইরাসের মতো বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পেরেছি। তবে কভিড-১৯ সৃষ্ট অনেক ক্ষত অর্থনীতিতে রয়ে গেছে। সেসব ক্ষত সারানো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বাজেটে সঠিক দিকনির্দেশনা দরকার। মূল্যস্ফীতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষ চাপে আছে। চাপ কমানোর জন্য সরকারের কাছে গণমুখী বাজেট প্রত্যাশা করছি।

ব্যাংক খাতের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাব আশা করছেন?

দেশের ব্যাংক খাতের সুস্থতা সমৃদ্ধির প্রধান প্রতিবন্ধক হলো খেলাপি ঋণ। অর্থনৈতিক সংকট প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ঊর্ধ্বমুখী। তবে এর বাইরেও এক শ্রেণীর মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ফেরত দিচ্ছে না। পরিস্থিতির শিকার হয়ে খেলাপি হওয়া উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংকগুলোর সহমর্মিতা আছে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো চাইলেও টাকা আদায় করতে পারছে না।

ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা ব্যাংক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি দেশ-বিদেশে নির্বিঘ্নে ঘুরছেন। আদালতের আশ্রয় নিয়েও ধরনের ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে যে ব্যক্তি ঋণখেলাপি হয়েছেন, তার প্রতি আদালত যে রায় দেবেন, একই ধরনের রায় যদি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরাও পেয়ে যান, সেটি ন্যায়বিচার নয়। ব্যাংকার হিসেবে আমরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে বাজেটে কঠোর বার্তা চাই।

ব্যাংক খাত তারল্য সংকটে ভুগছে। অন্যদিকে সরকারের ঘাটতি বাজেটও স্ফীত হচ্ছে। অবস্থায় বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ালে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা?

ব্যাংক খাতে তারল্যের চাপ তৈরি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থের জোগান দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরজুড়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে পাশে পেয়েছি। বাজেট বাস্তবায়নে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেবে, এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে এক্ষেত্রে বেসরকারি খাত যাতে ঋণ বঞ্চিত না হয়, সেটিও দেখতে হবে। দেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের অবদান ৭০-৮০ শতাংশ। অর্থের অভাবে বেসরকারি খাত দুর্বল হয়ে গেলে সেটির বিরূপ প্রভাব দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর পড়বে। এজন্য বেসরকারি খাতকে প্রাণবন্ত রাখতে বাজেটে দিকনির্দেশনা আশা করছি।

দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা এখনো কমেনি। ডলারের সংকটও তীব্র হচ্ছে। সংকট কাটাতে বাজেটে কী প্রত্যাশা করছেন?

গত অর্থবছরের রেকর্ড আমদানির চাপ দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছিল। চাপ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশে ডলারের সংকট শুরু হয়। সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেকর্ড সংখ্যক ডলার বাজারে বিক্রি করেছে। আবার ডলারের বিপরীতে টাকারও রেকর্ড পরিমাণ অবমূল্যায়ন হয়েছে। তবে আশার কথা হলো দেশের আমদানি ব্যয় অনেক কমে এসেছে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিয়েছিল, সেটির ফল পাওয়া গেছে। বিপরীতে রেমিট্যান্স রফতানি আয় প্রবৃদ্ধির ধারায় আছে। প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা সম্ভব হলে নতুন অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রিত থাকবে। তবে বিদেশী বিনিয়োগ রফতানি বাড়াতে বাজেটে দিকনির্দেশনা আশা করছি। রফতানি আয় যথাসময়ে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দিতে হবে।

গত মাসে পবিত্র রমজান ঈদুল ফিতর সত্ত্বেও রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৬ শতাংশের বেশি পতন হয়েছে। অবস্থায় বৈধ পথে রেমিট্যান্সকে উৎসাহিত করতে সরকারের কী করণীয় রয়েছে বলে মনে করেন?

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস হলো রেমিট্যান্স। অবৈধ পথে বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসছে। এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। রেমিট্যান্স ঘিরে আবর্তিত হওয়া অবৈধ তত্পরতা যাতে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, সেটির বিষয়ে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। রেমিট্যান্সের অবৈধ চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেলে বৈধ পথে রেমিট্যান্সের বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হবে। বৈধ পথে রেমিট্যান্সকে উৎসাহিত করতে সরকারের আরো অনেক করণীয় রয়েছে। এর মধ্যে প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণে উৎসাহ দিতে প্রণোদনার হার আরেকটু বাড়ানোর প্রস্তাব আশা করছি। পাশাপাশি অবৈধ হুন্ডি তত্পরতা বন্ধে সরকারের জোরালো তত্পরতা দরকার।

ব্যাংকের প্রতিটি সেবার ক্ষেত্রেই গ্রাহকদের ভ্যাট-ট্যাক্স গুনতে হচ্ছে। এটি সাধারণ মানুষকে ব্যাংকে আসতে নিরুৎসাহিত করছে কিনা?

ব্যাংকের হিসাব খোলা থেকে শুরু করে প্রতিটি সেবার বিপরীতেই শুল্ক  কর আছে। এমনকি হিসাব খোলার ক্ষেত্রেও শুল্ক দিতে হয়। জাতীয়ভাবে আমাদের জনগণের সঞ্চয় খুবই কম। সাধারণ মানুষকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। ব্যাংকে সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি ধাপেই গ্রাহককে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। একইভাবে ভ্যাট দিতে হয় ঋণের ক্ষেত্রেও। সীমাতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্স সাধারণ মানুষকে ব্যাংকে লেনদেনে নিরুৎসাহিত করছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার যৌক্তিক পর্যায়ে নেই। এক বছরের জন্য ঋণ নিয়ে গ্রাহক যে হারে ভ্যাট দেন, যিনি এক সপ্তাহের জন্য ঋণ নেন, তাকেও একই হারে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। বিশেষ করে ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে আবগারি শুল্ক আদায় করার পদ্ধতিটি যৌক্তিকতার পর্যায়ে নেই। ব্যাংকের যেসব ঋণ আদায় হচ্ছে না, সেগুলোর ওপর প্রভিশন বা সঞ্চিতি রাখতে হয়। আবার রক্ষিত সঞ্চিতির ওপর সরকারকে কর দিতে হচ্ছে। এটি একেবারেই অযৌক্তিক।

দেশের জিডিপির আকারের তুলনায় ট্যাক্স আদায়ের হার খুবই কম। শুল্ক করের আওতা যত বেশি সম্প্রসারণ করা যায়, ততই অর্থনীতির মঙ্গল। যারা ট্যাক্স দেন, তাদের ওপর চাপটা অনেক বেশি। বাজেটে করহার কমিয়ে এর আওতা বাড়ানো দরকার। আমাদের জনসংখ্যার সঙ্গে করদাতার সংখ্যা তুলনা করলে সেটি একেবারেই নগণ্য। আরো বেশি সংখ্যায় মানুষ যাতে করজালে আবদ্ধ হয়, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ আশা করছি।

নতুন বাজেট বাস্তবায়নে ইসলামী ব্যাংক কী ধরনের ভূমিকা পালন করবে?

বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক সবসময়ই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। দেশের ব্যাংক খাতের মধ্যে আমরা সর্বোচ্চ করদাতা প্রতিষ্ঠান। সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইসলামী ব্যাংকের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। গত চার দশকের প্রতিটি বাজেট বাস্তবায়নেই ব্যাংকটি গর্বিত অংশীদার হয়েছে। ব্যাংকের সেবাগুলো যত বেশি সম্প্রসারণ হবে, সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্সও ততটা বাড়বে। আমরা ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ সেবার বিস্তৃতি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতে আমাদের ব্যাংকের বিনিয়োগ ছড়িয়ে পড়ে, সে বিষয়ে জোর দেয়া হবে। সম্পদের সুসম বণ্টন সম্ভব হলে দেশের সব মানুষ উপকৃত হবে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাছান আদনান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন