রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকই বড় গ্রহীতাদের ঋণ দেয়ার সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘন করেছে

হাছান আদনান

কোনো ব্যাংক তার বিতরণকৃত মোট ঋণের কত শতাংশ অর্থ বড় গ্রাহকদের দিতে পারবে, তা ব্যাংক কোম্পানি আইন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রীতিনীতিতে স্পষ্ট করা আছে। ব্যাংককে অল্প কিছু গ্রাহকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতেই এমন বিধান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও খোদ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংকসোনালী, জনতা, অগ্রণী রূপালীতে বিধানটির প্রতিপালন হয়নি। বরং চার ব্যাংকের সবকটিরই ঋণ পোর্টফোলিওতে বড় গ্রাহকদের দেয়া ঋণের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘন হয়েছে।

আইন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী জনতা ব্যাংক তার ঋণ পোর্টফোলিওর ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বড় ঋণ দিতে পারে। যদিও গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪৯ শতাংশই ছিল বড়দের কাছে। আর বড় গ্রাহকদের কাছে গেছে জনতা ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর ৬৯ শতাংশ অর্থ। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী রূপালী ব্যাংকও বড় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘন করেছে।

অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ পোর্টফোলিওর ৩৬ শতাংশ অর্থ নিয়েছেন বড় গ্রাহকরা। যদিও এক্ষেত্রে ব্যাংকটির বড় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা হলো পোর্টফোলিওর ৩০ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের বড় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ৩৪ শতাংশ হলেও ব্যাংকটি এরই মধ্যে ৩৬ শতাংশ অর্থ বড়দের দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ বড় গ্রাহকদের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার চিত্র উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড়দের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি রাতারাতি হয়নি। বরং বছরের পর বছর ধরেই প্রক্রিয়া চলছে। বিশেষ করে গত ১০-১২ বছরে এটি অনেক বেশি ত্বরান্বিত হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মালিকানা পরিচালনা পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে। ব্যাংকগুলোর পর্ষদে অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিও রয়েছেন। তার পরও বড়দের কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার বিষয়টি ঠেকানো সম্ভব হয়নি।

রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের সাবেক বর্তমান তিনজন শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে দেশের ক্ষমতাবানদের নির্দেশনার ভিত্তিতে প্রভাবশালীদের ঋণ দিতে হয়েছে। তবে তাদের কেউই বিষয়ে নিজের নাম উদ্ধৃত করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৮৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ঋণের মধ্যে ৫২ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা গেছে মাত্র ২৩ গ্রাহকের কাছে। বড় গ্রাহকদের কাছে কেন্দ্রীভূত ঋণের মধ্যে ৩১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা ছিল ফান্ডেড। বাকি ২১ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকার ঋণ নন-ফান্ডেড। তবে সোনালী ব্যাংকের বড় গ্রাহকদের ১৮টি প্রতিষ্ঠান সরকারি খাতের। আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ একক কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিতে হয়। এক্ষেত্রে ১১টি প্রতিষ্ঠানকে সোনালী ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনায় দেখা যায়, সোনালী ব্যাংকের বড় ঋণ দেয়ার সর্বোচ্চ সীমা হলো ঋণ পোর্টফোলিওর ৩৪ শতাংশ। কিন্তু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহৎ ব্যাংকটি সীমা লঙ্ঘন করে ৪৯ শতাংশ ঋণই বড়দের দিয়েছে।

সারা দেশে সোনালী ব্যাংকের শাখা রয়েছে হাজার ২৩১টি। এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি শাখার মাধ্যমেই ব্যাংকটি ২৯ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। সোনালী ব্যাংক তার ঋণ পোর্টফোলিওর ৩৫ শতাংশ অর্থ বিতরণ করেছে পাঁচ শাখার মাধ্যমে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির বিতরণকৃত মোট ঋণের ৩০ শতাংশের আকার ১০০ কোটি টাকার বেশি।

বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, গত বছরের ২৮ আগস্ট আমি সোনালী ব্যাংকের এমডি পদে যোগদান করি। তখন থেকেই ব্যাংকের ঋণ বিতরণে সিএসএমই কৃষি খাতকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ব্যাংকের এজিএম  ডিজিএমদের ঋণ বিতরণের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। অল্প কিছু গ্রাহকের কাছে কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়াটি ভালো সংবাদ নয়। আমরা সোনালী ব্যাংকের ঋণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।

আফজাল করিম বলেন, সোনালী ব্যাংকের বড় ঋণগ্রহীতাদের বেশির ভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের বৃহৎ ব্যাংক হিসেবে আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি ঋণপত্রের পাশাপাশি ঋণের জোগান দিচ্ছি। কারণে সোনালী ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকিও রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় অনেক কম।

রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকে গত ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৮৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। ঋণের মধ্যে ৬৩ হাজার ৬১৫ কোটি টাকাই বিতরণ করা হয়েছে মাত্র পাঁচ শাখার মাধ্যমে। সে হিসেবে জনতা ব্যাংকের ৭৫ শতাংশ ঋণই মাত্র পাঁচ শাখায় কেন্দ্রীভূত। রাষ্ট্রায়ত্ত দ্বিতীয় বৃহৎ ব্যাংকটির ৬১ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা গেছে মাত্র ৬১ গ্রাহকের কাছে। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান সরকারি। বাকি ৫৭ বড় গ্রাহকই বেসরকারি খাতের। জনতা ব্যাংকের মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ পেয়েছেন এমন গ্রাহক সংখ্যা ৩২। ব্যাংকটির মোট ঋণ পোর্টফোলিওর সর্বোচ্চ ৩৪ শতাংশ অর্থ বড়দের কাছে যাওয়ার কথা। যদিও এরই মধ্যে জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের ৬৯ শতাংশই বড় গ্রাহকদের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৪৬ শতাংশের আকারই ১০০ কোটি টাকার বেশি।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে আমি দায়িত্ব নেয়ার আগেই জনতা ব্যাংকের বড় ঋণগুলো বিতরণ করা হয়েছিল। আমি ঋণ বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করেছি। সিএসএমই কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে ঋণ বিতরণ করেছি। যেসব বড় ঋণ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলো আদায়ের পাশাপাশি পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত রাখার উদ্যোগ নিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পাদিত সর্বশেষ এমওইউর লক্ষ্য অর্জনে জনতা ব্যাংক বেশ সাফল্য দেখিয়েছে।

গত কয়েক বছরে বড় গ্রাহকদের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল অগ্রণী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, অগ্রণী ব্যাংকের ৩৬ শতাংশ ঋণই গেছে ৫১ গ্রাহকের কাছে। এর মধ্যে ৪৪ বড় গ্রাহকই বেসরকারি খাতের। ফান্ডেড নন-ফান্ডেড মিলিয়ে বড় গ্রাহকদের কাছে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৯ গ্রাহককে ব্যাংকটির মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী, অগ্রণী ব্যাংকের মোট ঋণ পোর্টফোলিওর ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বড় ঋণের সুযোগ রয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি বড় ঋণের হার ৩৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। সারা দেশে অগ্রণী ব্যাংকের শাখা রয়েছে ৯৬৯টি। এর মধ্যে মাত্র পাঁচ শাখার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে ২৯ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণ পোর্টফোলিওর ৪২ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ৩০ শতাংশের আকার ১০০ কোটি টাকার বেশি।

ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই রূপালী ব্যাংকও। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ৪৩ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৪ হাজার ৬০ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৫৫ শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে মাত্র পাঁচটি শাখার মাধ্যমে। যদিও সারা দেশে রূপালী ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ৫৮৬। রূপালী ব্যাংকের ঋণের ১৫ হাজার ৪৭১ কোটি টাকাই নিয়েছেন মাত্র ৩৩ গ্রাহক। এসব গ্রাহকের মধ্যে ৩১টিই বেসরকারি খাতের। বড় গ্রাহকদের মধ্যে ১০টিকে রূপালী ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির মোট ঋণের ৩২ শতাংশের আকার ১০০ কোটি টাকার বেশি।

রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এমন অনেক প্রভাবশালী গ্রাহক আছেন, যারা রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক থেকেই ঋণ নিয়েছেন। আবার বড় গ্রাহকদের বেশির ভাগই নামে-বেনামে একাধিক কোম্পানি বানিয়ে একই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। সেগুলো বিবেচনায় নিলে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের অর্ধেক ঋণই সর্বোচ্চ ১০টি শিল্প গ্রুপে সীমাবদ্ধ। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন