ঢাকা বিআরটি

ভুল, ভোগান্তি ও ভবিষ্যতের বোঝা

শামীম রাহমান

বিআরটি প্রকল্পের মাধ্যমে নির্মিত টঙ্গী ফ্লাইওভারের ঢাকামুখী লেন গত বছরের ৬ নভেম্বর চালু হয় ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশের আলোচিত-সমালোচিত প্রকল্পগুলোর একটি গাজীপুর-বিমানবন্দর বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) শুরু থেকেই নির্মাণকাজের কারণে সৃষ্ট যানজট, জলাবদ্ধতায় অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে আসছেন দেশের ব্যস্ততম ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ব্যবহারকারীরা। কষ্ট দীর্ঘায়িত হয়েছে নির্মাণকাজের ধীরগতিতে। গার্ডার ধস, ক্রেন ছিঁড়ে চলন্ত প্রাইভেট কারের ওপরে পড়া, ঠিকাদারের অদক্ষতাসহ নানা কারণে বারবার আলোচনায় এসেছে প্রকল্পটি।

বিআরটি প্রকল্পের প্রধান অর্থায়নকারী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকল্পটি নিয়ে এডিবির পর্যবেক্ষণ হলো প্রকল্প শুরুর আগে নিয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজটিই করা হয়নি ঠিকমতো। এতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে তৈরি হয়েছে নানা জটিলতা।

অনেকটা একই পর্যবেক্ষণ নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞদেরও। দেশের প্রথম বিআরটি নির্মাণের পরিকল্পনায়ই গলদ দেখছেন তারা। তাদের ভাষ্যমতে, ঢাকাবাসীকে যানজট থেকে স্বস্তি দিতে বিআরটি নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছিল। রুট ধরা হয়েছিল গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর হয়ে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত। কিন্তু মূল ঢাকায় না হয়ে বিআরটি হচ্ছে গাজীপুর-বিমানবন্দর রুটে, যা ঢাকাবাসীর যানজট নিরসনে খুব একটা কাজে আসবে না।

পরিকল্পনা সমীক্ষার ভুল আর বর্তমানের জনভোগান্তির পাশাপাশি ভবিষ্যতে প্রকল্পটি দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিআরটি প্রকল্পে এডিবি ছাড়াও ফ্রেঞ্চ ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (এএফডি) ঋণ অর্থায়ন রয়েছে।

প্রকল্পে সাধারণ ঋণ হিসেবে এডিবির প্রাথমিক অর্থায়ন ছিল ১০ কোটি ডলার। পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের মোট সময়কাল ২৫ বছর। এর সঙ্গে কনসেশনাল লোন বা সহজ শর্তের ঋণ হিসেবে রয়েছে আরো প্রায় কোটি ডলার। ২০১২ সালে প্রথম ঋণের অর্থছাড়ের অনুমোদন দেয় এডিবি। পরে গত বছরের ডিসেম্বরে আরো ১০ কোটি ডলার অর্থায়নের জন্য এডিবির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। এখানেও পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের মোট সময়কাল ধরা হয়েছে ২৫ বছর। এএফডির কাছ থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ সাড়ে কোটি ডলার। এছাড়া অনুদান হিসেবে ৪৬ লাখ ডলার দিচ্ছে জিইএফ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশী উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে পুরোপুরি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। ডলারের বিপরীতে টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন পুরোপুরি বাণিজ্যিক ঋণকে অদূর ভবিষ্যতে সরকারের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ করে তুলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে চড়া সুদে বাণিজ্যিক ঋণ নিয়ে বিআরটির মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় ক্ষত তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, আমার মনে হয়, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আমরা কিছুটা ভুল জায়গায়, ভুল নকশায় এবং ভুলভাবে বিআরটির মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। প্রকল্পটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে।

হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ প্রকল্পটি সামনের দিনগুলোয় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপরও চাপ ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা পরিবহন বিশেষজ্ঞদের। মহাসড়কের ঠিক মাঝখান দিয়ে বিআরটি লেন তৈরি করায় ব্যস্ততম মহাসড়কটির সক্ষমতাও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে।

শুধু পরিকল্পনা নয়, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা নিয়েও অভিযোগ রয়েছে বিআরটি প্রকল্পের উন্নয়ন সহযোগী এডিবির। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ বলছে, এতে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজটি ঠিকভাবে করা হয়নি। ২০১১ সালে সম্পন্ন করা সমীক্ষায় গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটি নির্মাণের জন্য খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছিল হাজার ৩৯ কোটি টাকা। কিন্তু কাজ শুরুর পর দেখা যায়, এতে ব্যয় হবে প্রাক্কলিত অংকের দ্বিগুণেরও বেশি।

এডিবির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করতে গিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান এবং নির্মাণের জন্য যথাযথ নকশা করা হয়নি। পরে বিস্তারিত নকশা করতে গিয়ে একের পর এক অনুষঙ্গ যোগ করায় বেড়ে যায় কাজের পরিধি। আর খরচ বেড়ে হয় দ্বিগুণ। বর্তমানে গাজীপুর-বিমানবন্দর বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় দাঁড়িয়েছে হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।

শুরুতে পরিকল্পনা করা হয়েছিল গাজীপুর-বিমানবন্দর করিডোরে শুধু বাসের জন্য বিশেষায়িত একটি লেন তৈরি করা হবে। লেনটির সাড়ে ১৬ কিলোমিটার করা হবে রাস্তার ওপরে। আর সাড়ে চার কিলোমিটারের জন্য উড়ালপথ বা ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। এর বাইরে কাজের আর কোনো অনুষঙ্গ ছিল না। কিন্তু ২০১৭ সালে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরুর পর বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ অনুধাবন করতে পারে, বিআরটি লেনের পাশাপাশি পুরো মহাসড়কটি উন্নয়ন করা জরুরি। এজন্য বার বার পরিবর্তন করতে হয় প্রকল্পের নকশা। এর সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার পরিষেবা লাইন স্থানান্তরে বিলম্ব, সঠিক সময়ে জমি অধিগ্রহণ করতে না পারা এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে কাজ এগিয়ে নিতে বেগ পেতে হয়েছে বলেও উঠে এসেছে এডিবির পর্যবেক্ষণে।

সরকারের ২০০৫ সালে প্রণয়নকৃত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (এসটিপি) সুপারিশের আলোকে ঢাকায় মেট্রোরেল আর বিআরটির মতো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে মহাখালী-রমনা-গুলিস্তান হয়ে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি (বিআরটি-) গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু উন্নয়ন সহযোগী এডিবির আগ্রহে ২০১৫ সালে সংশোধিত এসটিপিতে (আরএসটিপি) প্রকল্পটি গাজীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। ২০১৭ সালে গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশে শুরু হয় নির্মাণকাজ। প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ব্যবহারকারীদের ব্যাপক ভোগান্তি শুরু হয়। জনদুর্ভোগ মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় এক পর্যায়ে বিমানবন্দর থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত অংশে বিআরটি নির্মাণের পরিকল্পনা থেকেই সরে আসে সরকার। প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছিল যানজট থেকে ঢাকাবাসীকে স্বস্তি দেয়ার উদ্দেশ্য থেকে। কিন্তু শুধু বিমানবন্দর-গাজীপুর করিডোরে হওয়ায় ঢাকা মহানগরের বাসিন্দারা এর সুফল পাবেন না বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। একেবারে পরিকল্পনা পর্যায় থেকেই আলোচিত-সমালোচিত বিআরটি প্রকল্পে ভুলের বিড়ম্বনার শুরু বলে অভিমত দিয়েছেন তারা।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক . সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, বিআরটি হলো শহর এলাকার জন্য একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্যবস্থাটি অস্থায়ী স্বল্পমেয়াদি। এতে খুব বেশি বিনিয়োগের দরকার হয় না। শুধু রাস্তার একটা অংশ বিআরটির বাস চলাচলের জন্য বিশেষ লেনে রূপান্তর করতে হয়। স্থায়ী সমাধান হিসেবে বিআরটি করিডোর ভেঙে মেট্রোরেলের মতো স্থায়ী গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। কিন্তু বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটিকে ছয়টি ফ্লাইওভার দিয়ে একটি স্থায়ী কাঠামো হিসেবে রূপ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিআরটি ভেঙে ভবিষ্যতে মেট্রোরেল বা এর মতো কোনো পরিবহন ব্যবস্থায় যাওয়ার সুযোগ আর থাকল না।

তিনি বলেন, আমরা শহর এলাকাকে বাদ দিয়ে বিআরটি তৈরি করলাম ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে। বিআরটি করতে গিয়ে মহাসড়কটির সক্ষমতাও আমরা কমিয়ে দিলাম। আবার ভবিষ্যতে সড়কের উন্নয়নের সম্ভাবনাও নষ্ট করে ফেললাম। পরিকল্পনা নকশার ভুলে প্রকল্পটি আগামীতে দেশের বোঝায় পরিণত হতে যাচ্ছে।

গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-বিমানবন্দর) শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে বিআরটির কাজ যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে সরকারের তিনটি সংস্থা। ছয়টি ফ্লাইওভার দিয়ে সাড়ে চার কিলোমিটার উড়াল অংশ বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। মাটির সমান্তরালে ১৬ কিলোমিটার অংশ বাস্তবায়ন করছে সড়ক জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। আর বাস ডিপোসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। তিন সংস্থার কাজ সমন্বয় করে ঢাকায় বিআরটি নির্মাণ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেড। চলতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ বিআরটি চালুর পরিকল্পনার কথা রয়েছে বলে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে।

প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম মনে করছেন, প্রকল্পটি ঢাকা আশপাশের এলাকার মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনবে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু বিআরটি নয়, গাজীপুর-বিমানবন্দর মহাসড়কও উন্নয়ন করা হচ্ছে। মহাসড়ক দেশের অন্তত ৩০ জেলার মানুষ ব্যবহার করে। ঢাকা শহরে প্রবেশ বাইরের অন্যতম পথ মহাসড়ক। আগে মহাসড়ক দুই লেনের ছিল। আমরা এটির উন্নয়ন করে সক্ষমতা বাড়িয়েছি। এর সুফল ব্যবহারকারীরা পাবেন। আবার বিআরটি করিডোর ব্যবহার করে সহজেই গাজীপুর থেকে ঢাকার মধ্যে যোগাযোগ করা যাবে। বিআরটির সঙ্গে মেট্রোরেলের সংযোগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যার মাধ্যমে ঢাকার ভেতরেও সহজেই যাতায়াতের সুযোগ পাবেন ব্যবহারকারীরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন