নারী অভিবাসী শ্রমিকদের ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বিশ্বাস করে না ৪৮ শতাংশ পরিবার

শফিকুল ইসলাম

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যান নারী শ্রমিকরা। নানা কারণে সেখানে তাদের মৃত্যু হয়। স্বাভাবিক মৃত্যুর পাশাপাশি এসব শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ হিসেবে উঠে আসে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যাও। ডেথ সার্টিফিকেটের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশে মারা যাওয়া ৬৯ শতাংশ বাংলাদেশী নারী শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তথ্য বিশ্বাস করে না ৪৮ শতাংশ নিহতের পরিবার। বাংলাদেশে মরদেহ পৌঁছার পর নতুন করে ময়নাতদন্ত না হওয়ায় মৃত্যুর সঠিক কারণ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে পরিবারগুলোর।

গত পাঁচ বছরে লাখ ৩০ হাজার ৪৫৩ জন বাংলাদেশী নারী শ্রমিক বিদেশে গেছেন। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে মারা গেছেন ৭০৯ জন নারী অভিবাসী। ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে আসা ৬৯১ নারী শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মৃত্যুসনদ অনুযায়ী বিভিন্ন রোগ প্রাকৃতিকভাবে ৬৯ শতাংশ শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনা আত্মহত্যায় ৩১ শতাংশ নারী শ্রমিকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। তবে সৌদি আরবের ক্ষেত্রে ২৪ শতাংশের মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা।

রামরুর ডেথ অব উইমেন মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স ইন ডেস্টিনেশন কান্ট্রিজ শীর্ষক গবেষণার জন্য মৃত নারী অভিবাসীদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। ৪৮ শতাংশ পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তারা ডেথ সার্টিফিকেটে নির্ধারিত মৃত্যুর যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে তা বিশ্বাস করেন না। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, মৃতরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত অধিক কর্মঘণ্টা, শারীরিক, মানসিক যৌন নির্যাতনের অভিযোগ জানিয়েছেন। এসব কারণে অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন।

গবেষণার তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ১৩০ জন অভিবাসী নারী শ্রমিকের মৃতদেহ দেশে ফেরে। যার মধ্যে আত্মহত্যা করেছিলেন ২৪ জন। এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো অস্বাভাবিক মৃত্যু শুধু শ্রমিক হিসেবে যেসব দেশে নারীরা যাচ্ছেন সেসব দেশেই বেশি। এশিয়া উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোয় অস্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো ঘটনা নেই। ১০০টি পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, যাদের লাশ দেশে এসেছে তাদের ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে কাজ করতে গিয়েছিলেন। ১০ শতাংশের বিদেশে যাওয়ার আগেই কোনো না কোনো ক্রনিক অসুখ যেমন ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার ইত্যাদি ছিল।

রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, প্রবাসীকল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে পাওয়া নারী অভিবাসীর মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় মৃত নারী শ্রমিকের ১০০টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নেয়া হয়েছে। নারী শ্রমিকের মৃত্যু নিয়ে তথ্য জানার পাশাপাশি অভিবাসন খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য গবেষণাটি করা হয়েছে।

বিএমইটি ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য মতে, ২০১৭ সালে এসেছে ১১৫ জন অভিবাসী নারী শ্রমিকের মরদেহ, ২০১৮ সালে ১৩৫, ২০১৯ সালে ১৩০, ২০২০ সালে ৬৯, ২০২১ সালে ১৩০ এবং ২০২২ সালে ১৩০ জন। সব মিলিয়ে গত ছয় বছরে মোট ৭০৯ জনের মরদেহ দেশে এসেছে। এর মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শ্রমিক হিসেবে যাওয়া দেশগুলোয় মারা গেছেন ৫৫৪ জন, নন-লেবার হিসেবে যাওয়া এশীয় দেশগুলোয় ৫৪ জন এবং পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোয় মারা গেছেন ৮৩ জন অভিবাসী। সৌদি আরব, জর্ডান, ওমান, বাহরাইন, কুয়েত, লেবাননসহ শ্রমিক হিসেবে যাওয়া দেশগুলোয় মৃত নারীদের ডেথ সার্টিফিকেটে উল্লেখ করা স্বাভাবিক মৃত্যুর গড় বয়স দেখা গেছে ৩৭ বছর। কিন্তু নন-লেবার হিসেবে যাওয়া এশিয়ান পশ্চিমা দেশগুলোয় স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা নারীদের গড় বয়স যথাক্রমে ৪৬ ৪৯ বছর।

বিষয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন টক্সিকোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. ইলিজা আলী বণিক বার্তাকে বলেন, স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে প্রশ্নটি একদিনে আসেনি। এতগুলো নারীর মরদেহ দেশে এসেছে সেটি প্রাকৃতিক মৃত্যু কিনা তা আসলেই সন্দেহজনক। ডেথ সার্টিফিকেটে তাদের যে বয়স, সে বয়সে এগুলো স্বাভাবিক হওয়ার কথা না। যেহেতু দেশে আসার পর মরদেহের ময়নাতদন্ত হয় না, তাই প্রমাণ ছাড়া কথা বলাও কঠিন। তবে সন্দেহজনক মৃত্যুগুলোর কারণ বের করতে হবে। এটি প্রমাণ করার প্রয়োজন রয়েছে। ১০টি ঘটনা ঘটলে হয়তো একটি ঘটনা সামনে আসে। যৌন নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতনের কারণেও অনেকে মারা যেতে পারে। এখন সময় এসেছে এগুলো পরীক্ষা করে সত্যতা যাচাইয়ের।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বয়সে দেশের মানুষ এত পরিমাণে সাধারণত মারা যায় না। ৬৯ শতাংশ যদি প্রাকৃতিক মৃত্যু হতো তাহলে দেশের মানুষ সাফ হয়ে যেত। সরকারি কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে। নারী প্রবাসীরা ১৮ ঘণ্টা কাজ করে, ঘুমাতে পারে না, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা হয়, মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। এতগুলো স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও সেটি তদন্ত করার দরকার রয়েছে। প্রত্যেকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

রামরুর গবেষণাকে নির্মোহ বলেই মনে করেন প্রবাসীকল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম। তিনি বলেন, গবেষণা পক্ষপাতদুষ্ট বা উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হচ্ছে না। অনেক সময় মনে করা হচ্ছে মৃত্যুর কারণকে চ্যালেঞ্জ করা হলে তা শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সত্যকে তো আর বেশি দিন চেপে রাখা সম্ভব না। নিজেদের গবেষণার প্রয়োজনে হলেও পরিবারের সম্মতি নিয়ে মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ থাকা থেকে ১০ শতাংশ মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করা প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন