সময়ের ভাবনা

স্মার্ট বাংলাদেশ: নগদ থেকে ক্যাশলেসের পথে যাত্রা

মো. আবিদ মঈন খান

মানব ইতিহাসের প্রাথমিক পর্যায়ের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে নগদবিহীন সমাজের অস্তিত্ব সেই সময় থেকেই ছিল। বিনিময় প্রথার শুরুতে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে সরাসরি পণ্য বিনিময় করত। বিনিময় প্রথার শুরু থেকে ব্রোঞ্জ, রুপা ও স্বর্ণের মাধ্যমে পণ্য বিনিময়ের দিকে ধাবিত হয় মানব সম্প্রদায়। চীনা বণিকদের হাত ধরে আসে কাগজের মুদ্রার প্রচলন ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। কাগজের মুদ্রা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। তার পরও মুদ্রার ক্রমবিকাশে ব্যাংক চেক, তারবার্তার মাধ্যমে মানি ট্রান্সফার, ওয়্যার ট্রান্সফার পরিষেবা ও ইলেকট্রনিক যুগে এটিএম কার্ডসহ বিভিন্ন ব্যবস্থার সংযোজন ঘটেছে, একবিংশ শতাব্দীর উদ্ভাবনী তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে অনলাইনে নগদবিহীন অর্থ প্রদানে ডিজিটাল ট্রানজেকশন পদ্ধতির জোয়ার এসেছে।

যাতায়াত, কেনাকাটা বা যেকোনো ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ এখন ক্যাশলেস বা নগদবিহীন লেনদেন ব্যবস্থার পথে এগোচ্ছে। কভিড-১৯ মহামারী সময়টা ক্যাশলেস হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এখন কাগজের নোটের লেনদেন থেকে ক্যাশলেসের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়েছে। কল্পবিজ্ঞানের ভাবনাটা এখন ভবিষ্যৎ বিশ্বে বাস্তবতা। ক্যাশলেস ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা বিশ্বের লেনদেনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে মনে হচ্ছে।

তথ্যপ্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে বাংলাদেশ ক্রমেই অগ্রসরমাণ ভবিষ্যতের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে, এরই ধারাবাহিকতায় ক্যাশলেস বাংলাদেশ নির্মাণে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রচারণা চালু করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকার বাণিজ্যিক অঞ্চল মতিঝিলে ১২০০ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে নিয়ে এ যাত্রা শুরু করেছে। ব্যাংক অ্যাপ বা এমএফএস (মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস) অ্যাপের মাধ্যমে কিউআর কোড স্ক্যান করে সরাসরি টাকা পরিশোধ করে পণ্য ও সেবা নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এখন পর্যন্ত ১০টি ব্যাংক, তিনটি এমএফএস (মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস) ও তিনটি আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিম কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে। এ কার্যক্রমের আওতায় ধীরে ধীরে দেশব্যাপী মোবাইল অ্যাপ দিয়ে কিউআর কোড স্ক্যান করে দৈনন্দিন লেনদেনের মাধ্যমে ক্যাশলেস স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে। 

মূলত ক্যাশলেস বলতে বোঝায় নগদ অর্থবিহীন লেনদেন, যেখানে ক্যাশ বা নগদ অর্থ ব্যবহার ছাড়াই লেনদেন করা হয়। নগদবিহীন লেনদেনের মধ্যে ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড, মোবাইল অ্যাপসে পেমেন্ট, ডিজিটাল ওয়ালেট এবং অন্য যেকোনো অনলাইন পেমেন্টে করা অর্থ আদান-প্রদানও অন্তর্ভুক্ত।

ক্যাশলেস নামক বিপ্লবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বর্তমান চিত্র দেখলে আমরা ভবিষ্যৎ ডিজিটাল বিশ্বের রূপ সম্পর্কে ধারণা পেতে সক্ষম হব। মার্কেট মার্চেন্টের বিশ্লেষণকৃত তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৫৪টি দেশ সম্পূর্ণ ক্যাশলেস হওয়ার পক্ষে আছে আর ৩২টি দেশ এখনো নগদ অর্থের মাধ্যমে বিনিময় করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সবচেয়ে বেশি ক্যাশলেস লেনদেন করা দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে।

এতে বোঝা যাচ্ছে, আগামী বিশ্ব নগদ টাকা ছেড়ে ক্যাশলেস সোসাইটি তৈরির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এজন্য ক্যাশলেস অর্থনীতি বা ক্যাশলেস সোসাইটি আলোচনা বহুদিন ধরে চলে আসছে একাডেমিক পর্যায়ে।  ক্যাশলেস সোসাইটি বা সমাজের অন্যতম দৃষ্টান্ত বর্তমানে নর্ডিক দেশ সুইডেন, যেখানে এখন নগদ অর্থের ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বলা চলে, মাত্র ১০ শতাংশের কম সংখ্যক মানুষ এখন ক্যাশ ব্যবহার করে। একই পথে হাঁটছে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্কসহ ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কে প্রায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ এখন ক্যাশলেস ব্যবস্থার আওতায় চলে গেছে। বিশেষজ্ঞের মতে, সুইডেন হয়তো পৃথিবীর প্রথম দেশ হবে যারা কিনা সম্পূর্ণ ক্যাশলেস সোসাইটিতে রূপান্তরিত হবে। এর মধ্যে ক্যাশলেস পেমেন্টের পথিকৃৎ রূপে পরিচিত চীন তাদের দেশের আলি পে, উইচ্যাট পে, টেনসেন্ট মোবাইল পেমেন্টের মাধ্যমে বহু আগের মোবাইল পেমেন্ট দিয়ে ক্যাশলেস যাত্রা চালু করেছিল। কভিডের পরবর্তী সময়ে চীন তাদের প্রথম জাতীয় ডিজিটাল মুদ্রা তৈরি করেছে। চীন আগামী কয়েক বছরের মাঝে সম্পূর্ণ স্পর্শবিহীন ক্যাশলেস লেনদেন রূপান্তরের কাজে রয়েছে। এ বছর চীনের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ  মোবাইলের মাধ্যমে লেনদেন করবে বলে আশা করছে দেশটি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ডিজিটাল লেনদেনের বাস্তবিক প্রয়োগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ভারতে ২০১৬ সালের নোট বাতিলের পরে, ভারতে ডিজিটাল পেমেন্ট ল্যান্ডস্কেপ সম্পূর্ণ রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছে। চলতি বছর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে ভারতের কেন্দ্রীয় আইটি, টেলিকম ও রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানান, গত বছর ভারতের ডিজিটাল পেমেন্ট লেনদেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সের সম্মিলিত ডিজিটাল পেমেন্টের চেয়ে বেশি ছিল।

মূলত ক্যাশলেস ব্যবস্থা আধুনিক অর্থনীতির বিকাশের একটা নতুন অধ্যায়। ক্যাশলেস ব্যবস্থা ব্যবহারের অনস্বীকার্য অনেক সুবিধা আছে যেমন ক্যাশলেসের ব্যবস্থার মাধ্যমে যেকোনো সময়, জায়গা থেকে সহজে ও দ্রুত লেনদেন সম্পন্ন করা যায়, ক্যাশলেস ব্যবস্থায় টাকা তৈরির খরচ কম আসে, অতিরিক্ত টাকা সঙ্গে না রাখার জন্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়, আর্থিক অপরাধ সংখ্যা কমে যায়, এ ব্যবস্থায় কর ফাঁকি দেয়ার সম্ভাবনা নেই, প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড রাখা সম্ভব, নকল বা জাল টাকার জালিয়াতি থেকে সুরক্ষিত, হাতে ধরা টাকাপয়সার আদান-প্রদান বন্ধ হওয়ার কারণে রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ কম থাকে এবং সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব নগদবিহীন লেনদেন ব্যবস্থায় বিশ্বে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে সহায়তা করে। 

ক্যাশলেস লেনদেন ব্যবস্থার আলোচনায় নানান উদ্বেগপূর্ণ বিষয় উঠে আসে, যেমন এ ধরনের লেনদেনে জনসাধারণের প্রাইভেসি কম থাকে, ডিজিটাল হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি পরিচয় চুরির ঝুঁকি আছে। অতিমাত্রার প্রযুক্তিনির্ভরতার জন্য হ্যাকিংয়ের সম্ভাবনা থাকে যায়, সমাজের অর্থনৈতিক অসমতা স্পষ্ট রূপে ফুটিয়ে তোলে। যাদের মোবাইল ব্যবহারের আর্থিক অবস্থা নেই তারা বঞ্চিত থেকে যায়। সমাজে যারা খুব বেশি প্রযুক্তিসচেতন নন বা বয়স্ক ব্যক্তিরা ক্যাশলেস সমাজের ধারণাটি অনিরাপদ ও জটিল মনে করেন। নগদবিহীন লেনদেনে ভোক্তাদের জন্য বাজেট বানিয়ে চলা বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে যায়, কারণ এখানে হাতে টাকা থাকে না। ক্যাশলেস ব্যবস্থায় টাকা বা অর্থ যেহেতু থাকে ডিজিটাল রূপে আর সেটা হাতে ধরাছোঁয়া যায় না তাই ক্যাশলেস ব্যবস্থা ব্যবহারের ফলে মানুষের কেনাকাটার অভ্যাসেও পরিবর্তন দেখা যায়।

বর্তমানে কভিড ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা এবং দেশের আর্থিক অবস্থার কারণে নগদ অর্থের নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, গত বছরের শেষ পর্যন্ত জনগণের হাতে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের মোট প্রচলিত মুদ্রা থেকে ব্যাংকে জমাকৃত টাকা বাদ দিয়ে জনগণের হাতে কত টাকা আছে সেই তথ্য বের করে থাকে। ব্যাংক থেকে টাকা জনগণ হাতে নেওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ব্যাংকের আমানতে মুনাফা কম, মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার তীব্র ব্যয় বৃদ্ধির জন্য ব্যাংক থেকে সাধারণ মানুষেরা নিজেদের হাতে টাকা রেখে দিচ্ছে। বর্তমানে দেশের মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এমন অবস্থা ক্যাশলেস সোসাইটি তৈরির চিন্তাকে কিছুটা হলেও ধীর করবে। তাই দেশের সার্বিক আর্থিক অবস্থা উন্নয়ন সর্বপ্রথম প্রয়োজন।

ক্যাশলেস সোসাইটির নানান উদ্বেগজনক দিক থাকলেও আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন পরিবর্তন সময়ের অন্যতম বাস্তবতা, যাকে অস্বীকার করা যায় না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবার সঙ্গে আমাদের দেশও এগিয়ে যাচ্ছে আগামীর পথে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্যাশলেস বা নগদবিহীন ব্যবস্থা অত্যন্ত যুগোপযোগী পদক্ষেপ প্রমাণিত হতে পারে, যদি প্রকৃতপক্ষে ধারাবাহিকভাবে সামগ্রিক আকারে আমরা সেটা বাস্তবায়ন করতে পারি। ক্যাশলেস ব্যবস্থার সুফল আমাদের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে করবে সহজ ও নিরাপদ এটাই প্রত্যাশা। ক্যাশলেস ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থায় সমাজ রূপান্তর সহজ ও দ্রুত করতে জনসাধারণের আস্থা ও বিশ্বাস অবশ্যই অর্জন জরুরি। যারা ক্যাশলেস ব্যবস্থাকে নিয়ে সংশয়বাদী তাদেরসহ সবাইকে ডিজিটাল লেনদেন কীভাবে নিরাপদ করা যায় সে সম্পর্কে শিক্ষিত করা উচিত। ক্যাশলেস লেনদেন ব্যবস্থায় যেন সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় এবং অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জে ভোগান্তি সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে কর্তৃপক্ষকে। নগদবিহীন ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা রাতারাতি যে নগদ অর্থের ব্যবহার মিটিয়ে ফেলবে সেটা নয়। বরং ধাপে ধাপে প্রয়োগের মাধ্যমে এটা নগদ অর্থনির্ভরতার চাপ কমানোয় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আমাদের দেশের জনগণের বিরাট একটা অংশ এখন পর্যন্ত কোনো প্রকার ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তার অন্যতম কারণ ব্যাংকের বিভিন্ন দাপ্তরিক কাগজপত্রের প্রক্রিয়াগত কার্যক্রম অনেকেই ঝামেলা মনে করে ব্যাংক থেকে দূরে থাকেন। প্রযুক্তি এখন সেই সমস্যাকে সমাধানের সুযোগ করে দিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে গত এক দশকে দেশের প্রায় সব মানুষের হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে গেছে। মোবাইল ফোনকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল পেমেন্ট পরিষেবার আওতায় সাধারণ জনগণকে আনতে পারলে তবেই সফল হবে ক্যাশলেস স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন।


মো. আবিদ মঈন খান: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন