উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিধিমালা রয়েছে, কিন্তু সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যয়ের খাত পর্যালোচনায় বারবার অস্বচ্ছতার দিকটি উঠে এসেছে। এজন্য সরকারের গৃহীত জাতীয় শুদ্ধাচার কর্মপরিকল্পনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রেও মেনে চলার কথা বলা হচ্ছে। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় শৃঙ্খলা আনয়ন এবং জনগণের সেবার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ফল পেতে জাতীয় শুদ্ধাচার কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক অনুশাসন মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।
২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার যে মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে, সেজন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার বিষয়ে ইউজিসির পক্ষ থেকে জোর দেয়া হয়েছে। কেননা সুশাসনের ঘাটতি থাকলে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হবে। এর ফলে বৈশ্বিক শ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েটদের পক্ষে সম্ভব হবে না বলে ইউজিসি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচার কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা তৈরি এবং তা ওয়েবসাইটে আপলোড করার বিষয়টি ইউজিসির সাম্প্রতিক ভার্চুয়াল কর্মশালায় উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা কার্যকর বাস্তবায়নেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে ইউজিসির পক্ষ থেকে
আহ্বান জানানো হয়েছে।
নৈতিকতা, সততা ও আচরণগত মানদণ্ড ঠিক রেখে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবাই দায়িত্ব পালন করলে প্রতিষ্ঠানের কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে স্ব স্ব কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলেই শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম প্রতিরোধ সম্ভব হবে বলেও ইউজিসির আলোচনায় উঠে আসে।
দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারি বিধিমালা মেনে না চলার প্রবণতা রয়েছে, এতে প্রতিষ্ঠানের আওতাভুক্ত সবাইকে ভুক্তভোগী হতে হয়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আর্থিক অনুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। মূলত দুর্নীতির যে ছায়া জাতীয়ভাবে সর্বত্র বিরাজ করছে তার প্রভাব থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও মুক্ত থাকেনি। যার ফলে আমরা নিকট-অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নানা অনিয়মের চিত্র দেখতে পেরেছি। এর প্রভাব থেকে বের হতে না পারায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে পারছে না এমন অভিযোগও উঠে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বিশ্বমানের নাগরিক তৈরি করা। এজন্য নিয়মিত পাঠদানের পাশাপাশি যথাযথ সময়ে পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মননশীলতা বিকাশের নিমিত্তে পর্যাপ্তসংখ্যক অবকাঠামো নির্মাণ করে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হয়। নিয়মিত কাজ হিসেবেই শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্ব, কিন্তু এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তরিকতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এর পেছনে আর্থিক সংস্থানের যে প্রসঙ্গ উঠে আসে, সেক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশাসনের জন্য জরুরি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ের খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। ২০১৯ সালে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাসভবনে আসবাবপত্র কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তখন গণমাধ্যমে ‘উপাচার্যের উপআশ্চর্য কাজ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আসবাব বিক্রি করা প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, তাদের কাছে এত দামি আসবাব নেই। তাহলে কীভাবে এত দামি আসবাব ক্রয় করা হলো? এ প্রশ্নের উত্তরে সংশ্লিষ্ট এক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, হয়তো মূল দামের সঙ্গে পার্সেন্টেজ যোগ করে এ দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পার্সেন্টেজ বা লভ্যাংশের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যয় বেড়ে যায়। আর এ অতিরিক্ত ব্যয় হওয়া টাকাগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ খাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে।
শিক্ষার্থীদের বসবাসের জন্য টেন্ডার
পেতে প্রভাবশালীদের ঘুস দিয়ে কাজ পাওয়ার অভিযোগ
আছে। যে কারণে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে কাজ সম্পন্ন করার
প্রমাণও বহুবার
মিলেছে। খাবারের
অতিরিক্ত মূল্য
নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর খাবার
সরবরাহ করা হয় না। এমনকি বিশেষ
দিনের খাবারেও
উপযুক্ত খাবার
প্রদান করা হয় না। আবাসন সমস্যার
ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হাতে কোনো
নিয়ন্ত্রণ নেই।
এভাবে পুষ্টিকর
খাদ্যের ঘাটতি
ও আবাসন
সংকটের কারণে
শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো
পড়ালেখা করতে
পারেন না। তার চেয়েও
দুঃখজনক হচ্ছে
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একশ্রেণীর শিক্ষক সঠিকভাবে
পাঠদান করেন
না। ফলে শিক্ষার্থীরা তুমুল
ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির
সুযোগ পেলেও
শিক্ষকদের কাছ থেকে যথাযথ
শিক্ষাপ্রাপ্তি থেকে
বঞ্চিত হন। দেখা যায়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণীর শিক্ষক সকালে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে নিজ ক্যাম্পাসে ফিরে
ক্লান্ত শরীরে
শিক্ষার্থীদের দুপুর
বেলা বা বিকালে পাঠদান
করান। পাঠদানে
আকর্ষণ না থাকায় এতে শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে
মনোযোগ দিতে
পারেন না। মূলত অতিরিক্ত
অর্থ উপার্জনের
জন্যই কিছু
শিক্ষক সরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস
কার্যক্রম পরিচালনায়
এভাবে অবহেলা
প্রদর্শন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু খোদ শিক্ষকরাই অভিযোগ করেন যে গবেষণার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়, তা দিয়ে কাগজ কেনার টাকাই হয় না। মূলত সরকারের বাজেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বরাদ্দ দেয়া হয় তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের পেছনেই অধিকাংশ অর্থ ব্যয় হয়ে যায়। বাকি অর্থ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। মোদ্দাকথা, শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলার ক্ষেত্রে যে বিনিয়োগ করার কথা, সেটি সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে অর্থ সংকটের কথা বলা হলেও সরেজমিন অনুসন্ধানে দুর্নীতির বিষয়গুলোই উঠে আসে। সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বরাদ্দে ঘাটতি হতে পারে, কিন্তু যতটুকু বরাদ্দ করা হয় সেটি ব্যয়ের ক্ষেত্রে যদি স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে প্রয়োজনমাফিক আরো অর্থ বরাদ্দ করা হলে সেটি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা পূরণ করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই সত্যিকারার্থে আমাদের দেশের গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অবশ্যই আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য দুর্নীতি রোধে আর্থিক অনুশাসন মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।