আলোচনা সভায় বক্তারা

দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের সহযোগী হতে পারে এনবিএফআই খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক

দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ শীর্ষক আলোচনা সভায় অতিথিরা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উন্নত যোগাযোগের অভাবে এতদিন শিল্পায়নে বেশ পিছিয়ে ছিল যশোরসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চল। তবে পদ্মা সেতুসহ সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা নানা অবকাঠামোর কারণে উদ্যোক্তাদের কাছে অঞ্চল হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয়। দক্ষিণাঞ্চলকে ঘিরে উন্নয়নের যে অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তা বাস্তবায়নে প্রয়োজন বড় আকারের বিনিয়োগ। এক্ষেত্রে বড় সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) যদিও এক্ষেত্রে এনবিএফআই খাতের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। যশোরের হোটেল ওরিয়ন ইন্টারন্যাশনালের সম্মেলন কক্ষে গতকাল অনুষ্ঠিত দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনা চ্যালেঞ্জ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা কথা বলেন।

বণিক বার্তা আয়োজিত দিনব্যাপী এনবিএফআই মেলা-যশোরের অংশ হিসেবে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী . শামসুল আলম। সম্মানিত অতিথি ছিলেন যশোর- আসনের সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) ডা. নাসির উদ্দিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন যশোর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক . মো. আনোয়ার হোসেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মমিনুল ইসলাম। বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিইও খাজা শাহরিয়ার, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিইও মো. কায়সার হামিদ, ডিবিএইচ ফাইন্যান্স পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিইও নাসিমুল বাতেন, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আবুল আহসান, লংকান অ্যালায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সিইও কান্তি কুমার সাহা, আইডিএলসি ফাইন্যান্সের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ জাভেদ নূর, বাংলাদেশ ব্যাংক খুলনা কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক শাহরিয়ার রহমান, যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. রফিকুল হাসান।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী . শামসুল আলম বলেন, যশোরে এনবিএফআই মেলার আয়োজন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। কিন্তু কৃষিসমৃদ্ধ এলাকাটি সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও এখানকার মানুষ দরিদ্র। আবার এখানে ঋণের পরিমাণও কম। তার মানে এখানে প্রয়োজনীয় ব্যাংক-সহযোগিতা আসেনি অতীতে। আমি মনে করি এনবিএফআই সঠিক সময়ে এগিয়ে এসেছে। তারা বিষয়টা বিবেচনায় নেবে। আজকের বাংলাদেশের উন্নতির মূলে আমরা বেসরকারি খাতকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। সরকার ব্যক্তি খাতে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, যার কারণে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি প্রযুক্তিগত বা ব্যবহারিক শিক্ষা বাড়াতে। যেখানে লাভ থাকে সেখানে উদ্যোক্তা ঠেকিয়ে রাখা যাবে না মন্তব্য করে প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, সবসময় মধ্যস্বত্বভোগীদের দোষ দেয়া যাবে না। সবজির ক্ষেত্রে অনেক পচে যায়। আবার নষ্ট হয়। ফলে ঢাকার বাজারে দাম বেশি থাকবে এটা স্বাভাবিক।

নন-ব্যাংকিং খাতকে লোকজনের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে যশোর- আসনের সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, ঋণের প্রতিবন্ধকতাগুলো সহজ করতে হবে। গবেষণা বাড়াতে হবে। এর মাধ্যমেই উন্নয়ন হবে। লক্ষ্য থাকতে হবে মানুষের উপকার করা। আপনারা (এনবিএফআই) যে ঋণ দেবেন তার পদ্ধতিও হতে হবে অনেক সহজ। এছাড়া এনবিএফআইকে আরো বেশি ডিজিটালাইজ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে।

যশোর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক . মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, যবিপ্রবি এখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভালো ভূমিকা রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য হলো দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা। আমাদের অঞ্চলে মাছের উৎপাদন বেশি। তাই কীভাবে মাছের উন্নয়নে মাঠপর্যায় থেকে কাজ করা যায় শিক্ষার্থীদের সেটা শেখানো হয়। আমাদের ছোট প্রযুক্তি থেকে বড় প্রযুক্তি সবকিছু পরিচালনায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

মূল প্রবন্ধে মমিনুল ইসলাম বলেন, এসএমই খাতে শতকরা ৯০ ভাগই জামানতবিহীন ঋণ। ব্যাংকগুলো সাধারণত সারা বিশ্বে চলতি মূলধনে ঋণ দিয়ে থাকে। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে। এরা মূলত পণ্য সেবা খাতে ঋণ দেয়। তিনি বলেন, ঢাকা চট্টগ্রামের বাইরে -ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচিতি কম। সাধারণ মানুষের সঙ্গে গণসংযোগ কম। ক্ষুদ্র মাঝারি অনেক উদ্যোক্তা -ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের ঋণ সম্পর্কে জানেন না। অথচ নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, বেশির ভাগ উদ্যোক্তাকে টিন, ট্রেড লাইসেন্সসহ এসব বিষয়ে অনেক ভোগান্তি পেতে হয়। ট্রেড লাইসেন্স মাঝে ডিজিটালাইজড করা হয়েছিল কিন্তু এখন ফিজিক্যালি নিচ্ছে। এক্ষেত্রে ভোগান্তি কমিয়ে আনতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আরো কার্যকরভাবে দক্ষিণাঞ্চলের অপার সম্ভাবনার সহযোগী হতে চাইলে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, গবেষণার অভাব রয়েছে। এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলে খাতভিত্তিক উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বিনিয়োগ করতে হবে। পদ্মা সেতু আমাদের জন্য এক সম্ভাবনার করিডোর।

খাজা শাহরিয়ার বলেন, এনবিএফআই রিটেইল, করপোরেটসব ধরনের বিজনেসের সঙ্গেই কাজ করে। তবে ঢাকার বাইরে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য খুব ভালোভাবে কাজ করছে। তাই নারী উদ্যোক্তাদের বলব, আপনারা এনবিএফআইদের কাছে যান, কারণ তারা সুলভ ইন্টারেস্টে মাত্র শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। আর নতুন নারী উদ্যোক্তারা জামানতবিহীন ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন। দক্ষিণাঞ্চলের নারীদের সুযোগ নিতে বলব। তিনি আরো বলেন, আমরা যত দ্রুত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর হতে পারব তত দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব। প্রযুক্তির মাধ্যমে খরচ কমে যাবে। আর দ্রুতগতিতে সেবাগ্রহীতার দোরগোড়ায় পৌঁছে যেতে পারব।

মো. কায়সার হামিদ বলেন, এর আগে যারা ঋণ নেননি তারা কিন্তু শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারবেন। এজন্য আমরা প্রক্রিয়াকরণটাও সাধারণ করেছি, মাত্র এক পাতার বাংলায় ফরম পূরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু ব্যবসায়িক দোকানের হিসাব দেখালেই হয়। নারী উদ্যোক্তারা ৫০ লাখ পর্যন্ত মাত্র শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন। এছাড়া তিনি যদি সময়মতো ঋণ পরিশোধ করেন, তাহলে শতাংশ ইন্টারেস্টের ওপর ভর্তুকি পাবেন লোন পরিশোধের পর। এছাড়া কৃষিভিত্তিক পণ্যকে প্রক্রিয়া করে আপনার যদি কোনো শিল্প গড়ে তুলতে চান সেখানে ১৪ কোটি টাকার রিফাইন্যান্সিং স্কিম আছে, যা আপনারা পেতে পারেন শতাংশ সুদে। সরকার সিএসএমইতে ২৫ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা দিয়েছে সেটাও আমরা দিয়ে যাচ্ছি শতাংশ সুদে। যারা আমদানি করছেন তারাও সহজ শর্তে ঋণ পাবেন। অঞ্চলের সবাইকে তিনি সঞ্চয়ের দিকেও মনোযোগ দিতে বলেন, তাহলে স্বল্প সময়ে তাদের একটা ভালো পুঁজি তৈরি হবে।

নাসিমুল বাতেন বলেন, আবাসন ঋণের ক্ষেত্রে এনবিএফআইয়ের ঋণ আছে। আবাসন লোনে আমরা শুধু অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য লোন দিচ্ছি তা না, আমরা সেমিপাকা বাড়ি বানানোর জন্যও লোন দিচ্ছি। যাদের নিজেদের জমি আছে বা গ্রুপ কনস্ট্রাকশন করতে চাচ্ছেন সব ক্ষেত্রেই আবাসন ঋণের সুবিধা রয়েছে। আবার পরিবেশ ফ্রেন্ডলি এবং ৭০০ স্কয়ার ফিটের মধ্যে ইউনিসাইজ হতে হবে, সেক্ষেত্রে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ শতাংশ সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। আবাসনের যে বিশাল সম্ভাবনা তার মূল্যায়ন যথাযথ হয় না। আবাসনে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলে জনগণ উপকৃত হবে।

মোহাম্মদ আবুল আহসান বলেন, আমরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করি। আমরা সবসময় যে ঝুঁকির মুখোমুখি হই তা হলো ফাইন্যান্সিয়াল রেকর্ডস সংরক্ষণ সক্ষমতা যাচাই করা। এখানে উদ্যোক্তাদের শিক্ষিত করার কাজ আমরা এনবিএফআইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে করতে পারি। তিনি বলেন, এখনো আমাদের ব্যাংক অ্যাসেট জিডিপির ৬০ শতাংশ যেখানে ভারতে ১০০ শতাংশের অধিক এবং চীনের ২০০ শতাংশের বেশি তার মানে আমাদের এখানে অনানুষ্ঠানিক ক্রেডিট এখনো আধিপত্য বিস্তার করছে। তার মানে এখানে কাজের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রান্তিক অঞ্চলে নিয়ে যেতে হবে। ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যারা কাজ করি তাদের মধ্যে একটা অংশকে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে।

কান্তি কুমার সাহা বলেন, অঞ্চলে তিন কোটি মানুষ, ২১টি জেলা। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অনেক দেশের জনসংখ্যাও নেই। তাই এটি সম্ভাবনার। ক্লাইমেট ফ্রেন্ডলি ব্যবসা খাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সুদের হারও অনেক কম।

সৈয়দ জাভেদ নূর বলেন, আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ আছে কিন্তু সরকার ডিজিটাল কাঠামোতে যে বিনিয়োগ করেছে তা অ্যানালাইসিস করে আমাদের খরচ অনেক কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পর্যন্ত অনেক ভালো করেছে। আমাদের এখানে ন্যাশনাল হাউজিং ব্যাংক নেই, এমনকি ভারতেও আছে যার হাউজিংয়ের রিফাইন্যান্সিং করে। আমাদের জন্য বড় সমস্যা হচ্ছে হাউজিংয়ের লোন দিতে হয় ১৫ বছরের জন্য আমাদের দায়বদ্ধতা নয় মাস থেকে এক বছরের জন্য। যদি কোনোভাবে ন্যাশনাল হাউজিং ব্যাংক করা যায়, তাহলে এর অবদান বাড়ানো সম্ভব। এখানে অনেক কর্মসংস্থান তৈরিরও সুযোগ রয়েছে।

শাহরিয়ার রহমান বলেন, সম্প্রতি আমরা নারী উদ্যোক্তাদের ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় কাগজপত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। কারণে তারা ঋণ পান না। তবে চেষ্টা করা হয় যেন, নারী উদ্যোক্তারা ঋণ পান। এছাড়া তারা ব্যাংক অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে দেখে যে লোন কত আদায়যোগ্য।

মো. রফিকুল হাসান বলেন, যশোর কৃষিতে অনেক এগিয়ে। এখানে কৃষি খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াকরণে উন্নয়ন কীভাবে করা যায় সেখানে নজর দিতে হবে। যশোরে ভবদহ অঞ্চলের মানুষ বেশ কষ্টে থাকে, সেখানের মানুষকে কীভাবে ভালো রাখা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব চামড়া রাজারহাট বাজারে আসে, চামড়ার কোনো দামই পাওয়া যায় না। সেদিকটা আপনারা দেখবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন