নৌ-ধর্মঘটে বিঘ্নিত পণ্য পরিবহন, দুদিন পর প্রত্যাহার

এমন ধর্মঘট পণ্যবাজারকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলবে

বাংলাদেশে সড়কপথের তুলনায় নৌপথের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম। সড়কের তুলনায় নদীতে ধর্মঘটের হারও অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী ব্যাপক। বস্তুত নৌপথে যাত্রীবাহী নৌযানের তুলনায় পণ্যবাহী নৌযান ধর্মঘটের তাত্পর্যও গভীর। বড় কোম্পানি থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র এবং শিল্প থেকে কৃষি সব পণ্যই নৌপথে কমবেশি পরিবহন হয়ে থাকে। নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে নৌপথ সংকুচিত হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন সময়ে নাব্যতা সংকটে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্তও হচ্ছে। এর মধ্যেই গত শনিবার মধ্যরাত থেকে নৌ-ধর্মঘটের কারণে পণ্য যাত্রী পরিবহন বন্ধ ছিল। এতে উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিকল্প পথে পণ্য আনা-নেয়া করতে গিয়ে বাড়তি ব্যয়ের পাশাপাশি ঝক্কিও পোহাতে হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ব্যাহত। ডলার সংকট, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে দেশে পণ্যের উচ্চমূল্য বিদ্যমান। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এর সঙ্গে নৌ-ধর্মঘট যোগ হয়ে পণ্যমূল্য আরো বাড়িয়ে তোলার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর আগেও একাধিক দফায় বিভিন্ন দাবিতে নৌ-ধর্মঘট হয়েছে, কর্তৃপক্ষ সচেতন হলে যার অধিকাংশই এড়ানো যেত। ধর্মঘটের কারণে বিভিন্ন স্থানে পণ্য খালাস পরিবহনে যে জট লেগেছে, তার প্রভাব বাজারেও পড়ার শঙ্কা রয়েছে। ধর্মঘট শুরুর আগেই শ্রমিক মালিক পক্ষকে নিয়ে সরকার যদি আলোচনায় বসতে পারত, তাহলে বিড়ম্বনা নিশ্চয়ই এড়ানো যেত। সম্পাদকীয় লেখার সময় শ্রমিক-মালিক শ্রম মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার বৈঠকের পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় শ্রম মন্ত্রণালয় আগেই যথাযথ পদক্ষেপ নিত তাহলে অর্থনীতি বাণিজ্যের ক্ষতি হতো না। আগামীতে ধর্মঘটের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার আগেই সমস্যাগুলোর সুরাহার ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে প্রত্যাশা।

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটে নেমেছিলেন নৌ-শ্রমিকরা। শনিবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া কর্মবিরতিতে স্থানীয় দূরপাল্লার রুটের নৌযান চলাচল ছিল বন্ধ। ধর্মঘটীদের দাবির মধ্যে ছিল নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক প্রদান সর্বনিম্ন মজুরি ২০ হাজার টাকা নির্ধারণসহ ১০ দফা। পূর্বনির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হওয়ায় রাত ১২টা থেকে লাগাতার কর্মবিরতি শুরু করেন শ্রমিকরা। কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বরিশাল, চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের সব নৌপথে ধর্মঘট চলেছে। তাদের দাবির মধ্যে আরো রয়েছে বালিবাহী বাল্কহেড ড্রেজারের রাত্রিকালীন চলাচলের ওপর ঢালাও নিষেধাজ্ঞা শিথিল, নৌপথে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ডাকাতি বন্ধ, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন নীতিমালা শতভাগ কার্যকর করে সব লাইটারিং জাহাজকে সিরিয়াল মোতাবেক চলাচলে বাধ্য করা, চরপাড়া ঘাটে ইজারা বাতিল নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সব ধরনের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা বন্ধ করা। ধর্মঘটের মধ্যে বড় জাহাজ অলস বসে থাকায় ডলারে ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে। আর ছোট জাহাজের জন্য টাকায় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের একাধিক জেলায় পরিবহন ধর্মঘট হয়েছে, এবার এর সঙ্গে যোগ হলো নৌ-ধর্মঘট। এর প্রভাব বাজারে পড়েছে। কৃষি শিল্প উভয় পণ্যের দাম বাড়ছে। বিদ্যুৎ গ্যাস সংকটের পাশাপাশি ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদনে তার প্রভাব পড়েছে। প্রতিটি পণ্যের দাম এক মাসের ব্যবধানেই বাড়ছে। এর সঙ্গে ধর্মঘট, চাঁদাবাজি রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে উঠলে পণ্যবাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর বোঝা জনগণকেই বহন করতে হবে, যা কাম্য নয়।

দেশের যাত্রীদের ৩০ শতাংশ হলেও পণ্যের ক্ষেত্রে ৪৪ দশমিক শতাংশ পরিবহন হয় নৌপথে। সেখানে ধর্মঘট চললে গোটা পরিবহন উৎপাদন ব্যবস্থাই যে ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়, তা বোঝার সক্ষমতা সংশ্লিষ্টদের নিশ্চয়ই রয়েছে। এটাও ভুলে যাওয়া চলবে না, নৌপথে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে পোশাক শিল্পসহ রফতানিমুখী বাণিজ্যের রয়েছে সরাসরি সম্পর্ক। তার মানে, এর ফলে অনেক সময় বিদেশে বাংলাদেশের বাজার বিঘ্নিত হতে পারে। এমনকি অতীতে ধর্মঘটের কারণে কর্মাদেশ বাতিল হওয়ার মতো গুরুতর পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছিল। তার পরও পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের মতো বিষয়কে মালিক পক্ষ সরকারি কর্তৃপক্ষ কেন গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে না, এটা ভাবনার বিষয় বৈকি। সময়ে এসে পরিবহন সরবরাহ ব্যবস্থার যেকোনো খাতে অদূরদর্শিতার ফল হতে পারে অনেক ক্ষতির। শিল্পের কাঁচামাল নৌপথে পরিবহন হয় বলে ধর্মঘটের জের ধরে অতীতে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার খবরও পাওয়া যায়। কৃষিপণ্যের সরবরাহও বাধাগ্রস্ত হয়েছে নৌ-ধর্মঘটে। এতে বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে উঠতে পারে। এভাবে প্রায় প্রতি বছরই ধর্মঘটের পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সেজন্য আগাম ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন এবং নৌ-শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণ ঐক্য পরিষদের ডাকা ধর্মঘটের দাবিগুলো সবার জানা। এগুলো যৌক্তিক হলে দ্রুত মেনে নেয়া এবং না হলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করা প্রয়োজন।

একসময় নৌপথই দেশের প্রধানতম পরিবহন মাধ্যম থাকলেও গত কয়েক দশকে ক্রমাগত সড়কপথে বিনিয়োগ মনোযোগের কারণে খাত নীতিনির্ধারক শ্রেণী তো বটেই, সাধারণ নাগরিকেরও মনোযোগ হারিয়েছে। খাতে কর্মরত শ্রমিকদের ব্যাপারেও কারো যেন কোনো গরজ নেই। কয়েক বছর আগেও ধর্মঘট করেছেন নৌযান শ্রমিকরা। কিন্তু নৌযান ধর্মঘট যে মানে কেবল নদীপথ নয়, এর সঙ্গে যে বহির্নোঙরে থাকা মূল জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে বন্দরে পৌঁছানো লাইটারেজ জাহাজগুলোও জড়িত, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম প্রায় স্থগিত হওয়ার পর তা অন্যদের নজরে এসেছিল। নৌ-খাতে আসলে কতটি শ্রমিক সংগঠন কর্মরত, সে তথ্যও ছিল বিরল। ঠিক কতগুলো নৌযান রয়েছে, কত শ্রমিক খাতের সঙ্গে যুক্ত; সেটাও পাওয়া সহজ নয়। ফলে তাদের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, তারও কোনো পরিকল্পনা নেই। তাছাড়া শ্রমিকরা যে দাবি জানাচ্ছিলেন, সে ব্যাপারে সরকারি পর্যায় থেকে সাড়া আসতেও সময় লাগছে। সড়কপথে ধর্মঘট একদিন যেতে না-যেতেই যেখানে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকে তা নিরসনের ব্যবস্থা নেয়ার, নৌপথের ধর্মঘটের ক্ষেত্রে পুরোই যেন উল্টোরথে যাত্রা। যাত্রী পরিবহন যা- হোক, পণ্য পরিবহনের একটি বড় অংশ এখনো নৌপথনির্ভর, তখনই কেবল সংশ্লিষ্টদের টনক নড়েছে। সময় গোটা পরিবহন উৎপাদন ব্যবস্থা ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীও নৌপথে কাঁচামাল আটকে থাকায় তাদের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কথা জানিয়েছে। নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের ব্যাপারে কেবল তাদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিই আলোচনায় এসেছে। অথচ নিজেদের বেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি তারা নৌপথের নিরাপত্তা বৃদ্ধি, নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা রক্ষার দাবি জানিয়েছে। বস্তুত দেশের একদা সমৃদ্ধ নৌপথ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা আমলে নিচ্ছে না। এদিকে নৌ-শ্রমিকরা বছরের পর বছর নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, অধিকাংশের স্বাচ্ছন্দ্যময় বেতন কাঠামো নেই, নিয়োগপত্র নেই, ঝুঁকি স্বাস্থ্য ভাতা নেই। বিভিন্ন সময়ে নৌপথের নিরাপত্তা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে বটে, সেটা যাত্রীদের দিক চেয়ে। নৌপথে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতা নিয়ে কেবল অভিযোগই করা হয়েছে, তাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি চোখে পড়েনি কারো।

সরবরাহ পরিবহন ব্যবস্থা সদা সচল রাখার স্বার্থেই সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে নৌপথে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। সড়কপথে ধর্মঘটের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ যতটা তত্পর হয়, নৌপথেও ততটাই হতে হবে। অস্বীকারের অবকাশ নেই, নৌযান শ্রমিকদের বেতন-ভাতা এখনো অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের তুলনায় কম। যদিও গত কয়েক বছরে কয়েক দফা ধর্মঘটে এক্ষেত্রে খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় এখনো পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ। গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অব্যবস্থাপনা দূর করতেই হবে। একই সঙ্গে শ্রমিকদেরও ভাবতে হবে ধর্মঘটের বিকল্প বিষয়ে। এভাবে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা জিম্মি করে দাবি আদায়ের পথ পরিহার করাই উত্তম। তবে সক্রিয় হতে হবে সরকারকেই; শ্রমিক মালিক দুই পক্ষের সঙ্গে আন্তরিক আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর পথ বের করা কঠিন হতে পারে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন