সহজ গণপরিবহন ও উন্মুক্ত স্থানের অপ্রতুলতা

সবচেয়ে বেশি সংকট কুমিল্লা ও গাজীপুরে

আল ফাতাহ মামুন

সহজ গণপরিবহন উন্মুক্ত স্থানের অভাবে দেশের বড় শহরগুলোয় নাগরিক জীবনে দুর্ভোগ বাড়ছে। শহরগুলোয় হেঁটে চলাচল করার মতো নাগরিকবান্ধব সুবিধাও নেই পর্যাপ্ত মাত্রায়। অপরিকল্পিত লক্ষ্যহীনভাবেই সম্প্রসারণ এবং শিল্পায়ন ঘটছে নগরগুলোয়। জাতিসংঘসহ বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর নানা পর্যবেক্ষণেও বলা হয়েছে, সহজ গণপরিবহন উন্মুক্ত স্থানের মতো অপরিহার্য নাগরিক সুবিধার অপ্রতুলতা নিয়েই নগরায়ণ ঘটছে বাংলাদেশে। এদিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে দেশের বড় শহর শিল্প এলাকাগুলো। জাতিসংঘের মানববসতি সংস্থার (ইউএন হ্যাবিটাট) ওয়ার্ল্ড সিটিজ রিপোর্ট ২০২২ প্রতিবেদনে তুলে ধরা এমনই এক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, সহজ গণপরিবহন উন্মুক্ত স্থানের সুবিধার দিক থেকে কুমিল্লা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ রাজধানী ঢাকার অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোর প্রায় সবই সম্প্রসারণ হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। জনসাধারণের জন্য সহজ গণপরিবহন উন্মুক্ত স্থানের মতো নাগরিক সুবিধাগুলো এসব শহরের উন্নয়ন ভাবনায় তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। যদিও নগরবাসীর শারীরিক মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য সুবিধাগুলো নিশ্চিত করার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই তুলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নগরে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থানের অভাব অনুভূত হচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। এসব সুবিধার অভাবে নগরগুলোর পরিবেশ যেমন অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে, তেমনি দুর্ভোগের মাত্রাও বেড়েছে নাগরিকদের।

গণপরিবহনের সহজপ্রাপ্যতা উন্মুক্ত স্থানের পর্যাপ্ততাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতি বছরই নাগরিক সুবিধার সূচক প্রকাশ করছে ইউএন হ্যাবিটাট। সংস্থাটির বছরের সূচকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বড় শহরগুলোর মধ্যে সহজ গণপরিবহনের সুবিধায় সবচেয়ে পিছিয়ে কুমিল্লা নগরী। এখানে সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকার মাত্র ১৯ দশমিক শতাংশ বাসিন্দা হাঁটার দূরত্বে গণপরিবহনের সুবিধা পাচ্ছে। গাজীপুর ময়মনসিংহে হার যথাক্রমে ২২ ৩৫ দশমিক শতাংশ। রাজধানী ঢাকায় হাঁটার দূরত্বে গণপরিবহন পাচ্ছে ৪৪ দশমিক শতাংশ। এছাড়া বরিশালে ৫৮ দশমিক শতাংশ, বগুড়ায় ৩৭ দশমিক , চট্টগ্রামে ৬২, খুলনায় ৬৮ দশমিক , রাজশাহীতে ৫৯ দশমিক সিলেটে ৫৬ দশমিক শতাংশ নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে।

ঢাকার নাগরিকরা এখন চাইলেও হেঁটে গন্তব্যস্থলে যেতে পারে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক . খন্দকার সাব্বির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশের বড় শহরগুলো, বিশেষ করে ঢাকা বেশ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। এখানে হাঁটার সুযোগ খুব কম। নাগরিকরা চাইলেই হেঁটে গন্তব্যে যেতে পারে না। একটু হাঁটার পর বসার জায়গা, রাস্তায় পানি খাওয়া ইত্যাদি সেবার ব্যবস্থা যদি সিটি করপোরেশন নাগরিকদের জন্য রাখতে পারত, তাহলে শহরে গাড়ির পরিমাণ কমত। কার্বন নিঃসরণও কম হতো।

বাংলাদেশে হাঁটার পথকে গুরুত্ব দিয়ে নগরী সাজানো সম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্প্রতি আমরা রাজশাহী শহর নিয়ে একটি কাজ করেছি। সেখানে আমরা দেখিয়েছি, হাঁটার পথকে প্রাধান্য দিয়ে নগরীটি গড়া সম্ভব। এভাবে শহর সাজাতে পারলে বাসযোগ্যতাও নিশ্চিত হবে।

শুধু ঢাকা বা খুলনা নয়, দেশের বড় শহরগুলোর নাগরিকরা একই সমস্যায় ভুগছে। গণপরিবহনের মতো হাঁটার দূরত্বে উন্মুক্ত স্থানের সুবিধার দিক থেকেও সবচেয়ে পিছিয়ে কুমিল্লা গাজীপুরের বাসিন্দারা। কুমিল্লা শহরের মাত্র ২৫ দশমিক শতাংশ গাজীপুর শহরের মাত্র ২৬ দশমিক শতাংশ নাগরিক হাঁটা দূরত্বে উন্মুক্ত স্থানের সুবিধা পাচ্ছে। ময়মনসিংহ শহরের ক্ষেত্রে হার ২৯ দশমিক শতাংশ। ঢাকার বাসিন্দাদের ৩১ দশমিক শতাংশ নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে। এছাড়া বরিশালের ৫৯ দশমিক শতাংশ, বগুড়ার ৭৯ দশমিক , চট্টগ্রামের ৬৪ দশমিক , খুলনার ৬৫ দশমিক , রাজশাহীর ৮৩ দশমিক সিলেটের ৭১ দশমিক শতাংশ মানুষ সুবিধা পাচ্ছে।

ওয়ার্ল্ড হ্যাবিটাটের সূচকে খুলনার অবস্থান তুলনামূলক ভালো দেখালেও সেখানকার নাগরিকরাও খুব একটা ভালো নেই। নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. শুভ বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিপরীতে এখানে গণপরিবহন অপ্রতুল। নেই উল্লেখ করার মতো উন্মুক্ত স্থানও। এমন নগরীতে বসবাসের অভিজ্ঞতা অস্বাস্থ্যকর। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে আছি দীর্ঘদিন। চিকিৎসক নিয়মিত হাঁটার পরামর্শ দিলেও নগরীতে তেমন কোনো সুবিধা নেই। রাস্তায় বেরোলে বাধ্য হয়ে অটোয় চড়তে হয়। হাঁটতে গেলে ভয় হয়, গায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চলে যাবে।

খুলনায় নাগরিক সুবিধার অপর্যাপ্ততার কথা স্বীকার করলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। তিনি বলেন, আমার নগরীতে নাগরিক সুবিধা যেভাবে থাকা উচিত, সেভাবে নেই। এর বড় কারণ নগরীটি অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। তবে খুলনা সিটি করপোরেশন নিয়ে মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে একটি বাসযোগ্য পরিকল্পিত নগরী গড়ার কাজ চলছে।

শহুরে রাস্তায় নাগরিকদের হাঁটার জন্য পর্যাপ্ত স্থানের সংস্থান রাখার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই তুলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। দেশের প্রধান শহরগুলোয় ফুটপাত থাকলেও প্রায় ক্ষেত্রেই এসব স্থান বেদখল হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই ফুটপাতগুলোর গঠন বৃদ্ধ, শিশু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের চলাচলের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী করা নেই। কোনো কোনো স্থানে আবার ফুটপাতের মধ্যেই গড়ে তোলা হয়েছে প্রতিবন্ধকতা, যা সবার চলাচলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

নগরবাসীর জন্য হাঁটার স্থানের সংস্থানকে মেগাসিটির অন্যতম শর্ত উল্লেখ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, একটি মেগা সিটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সেখানে সাধারণ মানুষের চলাচলের জায়গা থাকবে। গণপরিবহন পর্যাপ্ত থাকবে। বিকালে হাঁটাচলার জন্য ওয়াকওয়ে বা পার্ক থাকবে, শিশুদের জন্য খেলার মাঠ থাকবে ইত্যাদি। কিন্তু জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি, অবৈধ দখলসহ বিভিন্ন কারণে চট্টগ্রামে নাগরিকদের যে সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, সেটি পর্যাপ্ত নেই। বাণিজ্যিক নগরীর মেয়র হিসেবে আমি দায়িত্ব নেয়ার পরে ওয়াকওয়ে বা ফুটপাত দখলমুক্ত এবং সংস্কারের কাজ করছি। চলাচলের জন্য নতুন সড়ক নির্মাণে প্রকল্পভিত্তিক কাজ করছি। এমনকি নগরীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে চসিকের পক্ষ থেকে ১৮ সদস্যের একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করা হয়েছে। স্ট্রাইকিং ফোর্স নগরীজুড়ে দখল অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের বিষয়গুলো আমাদের জানালে আমরা অবৈধ স্থাপনা দখলমুক্ত করেছি।

নগরীতে হাঁটার দূরত্বে উন্মুক্ত স্থান কিংবা গণপরিবহন সুবিধার কথা বারবার বলা হলেও সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না উল্লেখ করে স্থপতি ইকবাল হাবিব বণিক বার্তাকে বলেন, নীতিনির্ধারকরা আমাদের কথা আমলে নিচ্ছেন না। কারণ তারা সবাই চলাচল করেন গাড়িতে। গরিব মানুষের পথচলা নিয়ে তারা খুব একটা ভাবেন না। অথচ একটি আদর্শ নগরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ হাঁটার জায়গা থাকা জরুরি।

তবে কথার সঙ্গে একমত নন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, পুরান ঢাকা নিয়ে কাজ করা মুশকিল। তা সত্ত্বেও বর্তমান মেয়র ফুটপাত দখলমুক্ত করার পাশাপাশি নতুন ফুটপাত নির্মাণের ব্যাপারে জোর দিচ্ছেন। গুলিস্তান, বাংলামোটর, বৌদ্ধ মন্দির এলাকায় এর নজির রয়েছে। একইভাবে নগরীতে উন্মুক্ত স্থান বাড়ানোর ব্যাপারেও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তবে নতুন নগরীকে যেভাবে পরিকল্পনামাফিক সাজানো যায়, পুরনো শহরকে সেভাবে সাজানো অনেক চ্যালেঞ্জিং।

দেশের বড় শহরগুলোয় নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত স্থান ব্যবহারের সুযোগ আরো শোচনীয়। ইউএন হ্যাবিটাটের সূচকের তথ্য অনুযায়ী, এদিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে ময়মনসিংহ গাজীপুর। নগর দুটির মোট আয়তনের মধ্যে সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য উন্মুক্ত স্থান রয়েছে যথাক্রমে মাত্র দশমিক দশমিক শতাংশ। বরিশাল শহর এলাকায় নাগরিকদের জন্য ব্যবহূত উন্মুক্ত স্থান মাত্র শতাংশ। অন্যান্য শহরের মধ্যে বগুড়ায় দশমিক শতাংশ, চট্টগ্রামে দশমিক , কুমিল্লায় দশমিক , ঢাকায় দশমিক , খুলনায় দশমিক , রাজশাহীতে দশমিক সিলেটে দশমিক শতাংশ স্থান সব নগরবাসীর ব্যবহারযোগ্য উন্মুক্ত স্থান হিসেবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র তৌফিক বকস লিপন প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, নগরায়ণের ফলে উন্মুক্ত ভূমি নেই বললেই চলে। সড়কের পাশে উন্মুক্ত কোনো জায়গা থাকলেও দেখা যায় অবৈধ গাড়ির স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে।

ঢাকা গাজীপুরের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে স্বীকার করে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) ২০১৬-২০৩৫ প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকা আশপাশের শহরে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান নেই। ফলে শহরের মানুষ শারীরিক মানসিক রোগে ভুগছে বেশি। ড্যাপে আমরা পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থানের সুপারিশ করেছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন