আলোকপাত

কুয়ো এবং পচা ব্যাঙ

আব্দুল বায়েস

এক.

বণিক বার্তার এক সংবাদে জনগণ জানতে পারে যে দেশে তীব্র ডলার সংকট থাকলেও বিদেশগামী উড়োজাহাজের কোনো ফ্লাইটে বিজনেস অথবা প্রথম শ্রেণীতে সিট ফাঁকা থাকে না; বাংলাদেশীরা উড়ছে বিদেশের দিকে, সঙ্গে থাকছে ডলার। অবশ্য যারা যাচ্ছে তাদের অনেকের ডলার বিদেশের ব্যাংকে রক্ষিত আছে হয়তো আন্ডার অথবা ওভার ইনভয়েসিং করেআর তা না হলে অন্যভাবে পাচার করে। গ্লোবাল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা জিএফআই বলছে, ‘USD 61.6 billion were siphoned out of Bangladesh between 2005 and 2014, which is equivalent to 25 percent of its GDP in FY 2016-17. Between 2008 and 2017, Bangladesh lost a staggering USD 7.53 billion per year on average to trade mis-invoicing, which accounted for 17.95 percent of Bangladesh’s international trade with all its trading partners during the period.’

এটা এখন পরিষ্কার যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পৃথিবী এখন এক ক্রান্তিকালে। করোনার ঘা শুকুতে না শুকুতেই বড় ধরনের আঘাতে বিপর্যস্ত বিভিন্ন দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা। মূলত যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতির ঊর্ধ্বগামী যাত্রা বন্ধ না হলেও বেশ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য সেবার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানে মূল্যস্ফীতি প্রায় দুই অংকের কাছাকাছি চলে এসেছে। দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি কিংবা চেরাগ বাতি ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা বেশ জোরেশোরেই প্রচারিত হচ্ছে বাংলাদেশে। অর্থনীতির চাহিদাসংক্রান্ত আলোচনায় প্রত্যাশা (Expectations) এবং ভয় (Panic) দুইয়ের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে প্রচুর আলোচনা আছে যা বর্তমান নিবন্ধের ছোট পরিসরে স্থান দেয়া গেল না। তবে সবচেয়ে অন্যতম আলোচিত একটা প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের রচনা; ভবিষ্যতে অন্যান্য ইস্যু আনার চেষ্টা করা হবে। বলে রাখা ভালো, সংকট নিপাতনে এরই মধ্যে গৃহীত বিগত দিনের সরকারি পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শ্রীলংকার মতো খাদের কিনারে নিতে পারেনি যদিও আরো অনেক কিছু করার বাকি রয়েছে।

ধরা যাক বাংলাদেশের বিদেশী দেনাপাওনা কিংবা ডলার সংকটের বিষয়টি। বাংলাদেশের বহিঃস্থ ঋণ পরিস্থিতি এবং আক্রমত্যা (Vulnerabilities) নিয়ে পেশাজীবী পরিমণ্ডলে প্রচুর উদ্বেগ লক্ষণীয়; ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় ভাসছে দেশটি। প্রথমত, শ্রীলংকার অতিসাম্প্রতিক পরিস্থিতি এবং দ্বিতীয়ত ২০২২ অর্থবছরের বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে চলতি হিসাবের স্ফীত ঘাটতি উত্কণ্ঠাকে আরো বেশি করে উসকে দিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, চলতি হিসাবে নজিরবিহীন ঘাটতি এরই মধ্যে  বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে বেশকিছু পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করেছে, স্বল্পমেয়াদি ধার বৃদ্ধি করেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ব্যাপক ধস নামিয়ে এনেছে। নাজুকতাকে অনেকে লেনদেনের ভারসাম্যে উদীয়মান ঝুঁকি এবং বহিঃস্থ ঋণের ওপর বিরূপ প্রভাব বলে ভাবছেন। আবার এও মনে করা হচ্ছে যে অবকাঠামো মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য নেয়া ধারদেনা পরিশোধ করতে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার হারে অতিরিক্ত চাপ অবস্থা আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিন.

এই বিতর্ক যেমন প্রাসঙ্গিক, প্রত্যাশিত এবং বিশেষত মুহূর্তে প্রয়োজনীয়  তেমনি মনে রাখতে হবে যে চলমান পরিস্থিতির অবাস্তব এবং খেয়ালি পর্যালোচনা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে; আলোচনা-সমালোচনার ভিত্তি হতে হবে  নির্ভরযোগ্য উপাত্ত এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ। আমরা যেন অনুমানের ওপর ভর করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা উপসংহারে উপনীত না হই। এমন একটা সময়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান . সাদিক আহমেদ পরিপুষ্ট তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতির সারমর্ম নিয়ে হাজির হলেন যেমন, বহিঃস্থ ঋণ পরিস্থিতির পর্যালোচনা এবং মূলগত বিষয় এবং বাংলাদেশের  চ্যালেঞ্জ যা পাঠকের প্রয়োজনে তুলে ধরা হলো (পিআরআই ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২) আবার তার উপস্থাপনা-যা হুবহু অনুবাদকৃত সরকারকেও সামস্তিক অর্থনীতি স্থিতিশীলকরণে উত্তম পন্থাটি বেছে নিতে সাহায্য করতে পারে।

প্রথাগতভাবে বাংলাদেশ তার বহিঃস্থ ঋণ বিচক্ষণতার সঙ্গে সামলেছে। চলতি হিসাবে হয় উদ্বৃত্ত, নয় নিম্ন ঘাটতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে; বাণিজ্য বিনিয়োগ প্রয়োজন মোকাবেলায় বাংলাদেশ মূলত নির্ভর করেছে সরকার-অর্থায়িত কম-খরচে মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ; স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবহার ছিল সামান্য। তৈরি পোশাক আর জনরফতানি সহযোগে বাংলাদেশের স্বল্প দীর্ঘকালীন বহিঃস্থ ঋণ নির্দেশকগুলোর অবস্থা স্বস্তিদায়ক।

কভিড-১৯ আবির্ভাব রফতানি আয় হ্রাস করে বাংলাদেশের বহিঃখাতে সমস্যার সৃষ্টি করে তবে খুব দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়। গবেষক . সাদিক বলেছেন, ২০২১ অর্থবছরে লেনদেনের ভারসাম্য এবং বহিঃস্থ ঋণ নির্দেশক স্বস্তিদায়ক সীমানায় অবস্থান নিয়েছিল যেমন দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সওয়া নির্দেশক জিডিপি-ঋণের অনুপাত, রফতানি-ঋণ অনুপাত, রফতানির অংশ হিসেবে ঋণ ইত্যাদি স্বস্তিদায়ক জোনে ছিল। স্ব্বল্পকালীন ঋণ নিয়ে সমস্যা তেমন ছিল না অর্থাৎ সুবিবেচক মাত্রায় ছিল।

চার.

২০২২ সালের মার্চ থেকে, মূলত ইউক্রেন যুদ্ধতাড়িত মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের বহিঃস্থ খাতে কিছুটা গভীর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে যার নমুনা আমদানির আকাশচুম্বী মূল্য। বাংলাদেশের বিনিময় হার খুব দ্রুত মান হারায় যেহেতু ডলারের অতিরিক্ত চাহিদা এবং তার সঙ্গে বৈশ্বিক বাজারে ডলারের উঁচু মূল্য টাকার অংকে ডলারের দাম ওপরের দিকে উসকে দেয়। আমদানি স্ফীতির জন্য ২০২২ অর্থবছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি দাঁড়ায় নজিরবিহীন ১৮ দশমকি বিলিয়ন ডলার। পর্বতপ্রমাণ ঘাটতি মেটাতে একদিকে স্বল্পমেয়াদি ধার নিতে হয় অন্যদিকে বড় মাপে রিজার্ভ হাতছাড়া হতে থাকে।

এসব পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব হিসাবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নির্দেশকের তীক্ষ অবনতি ঘটে। যেমন স্বল্পকালীন ঋণ পরিশোধ অনুপাত অর্থবছর ২০২১-এর ৩০ শতাংশ থেকে অর্থবছর ২০২২- ৫০ শতাংশে ওঠে। অন্যদিকে স্বল্পকালীন ঋণ এবং চলমান ঘাটতি-রিজার্ভ অবনতির দিকে ধাবিত হয় ৩৮-৯৪ শতাংশ! যা হোক, মধ্যম থেকে দীর্ঘকালীন ঋণজনিত নির্দেশক স্বস্তিদায়ক সীমানার ভেতরেই ছিল।

পাঁচ.

বর্তমান ঋণজনিত অবস্থা কতটুকু নাজুক? গবেষক মনে করছেন, রফতানি যদি স্থিতিশীল থাকে তাহলে মধ্যম থেকে দীর্ঘকালীন পরিপ্রেক্ষিতে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। প্রক্ষেপণ বলে দেয়, মধ্যম থেকে দীর্ঘকালীন টেকসই ঋণ নির্দেশক পরিণামদর্শী মাত্রার মধ্যে থাকে। আসছে কিছু বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধেরযেমন রূপপুর আণবিক শক্তি প্লান্ট, পদ্মা সেতু রেল লিংক, কর্ণফুলী টানেলপরও স্বস্তিদায়ক অবস্থান অপরিবর্তিত থাকতে পারে

তবে স্বল্পকালীন ঝুঁকি ঋণ অবস্থা বেশ দুরূহ এবং চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, ২০২২ সালে এসে স্বল্পকালীন ঋণ নির্দেশকগুলোর বেস দ্রুত অবনতি হতে থাকে যা উল্টানো এবং স্থিতিশীল করা উচিত। যদিও এরা সতর্ক নিয়মের রয়েছে (অনুপাত -এর নিচে), ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির সৃষ্ট অনিশ্চয়তার মুখে বাংলাদেশের উচিত হবে আরো পতনের মুখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা করা এবং চলতি হিসাব ঘাটতি এখনই কমিয়ে আনা।

প্রধান নীতি সংস্কারের মধ্যে রয়েছে সব লেনদেনের জন্য যথা আমদানি, রফতানি এবং রেমিট্যান্স-এর জন্য বাজারের চাহিদা জোগানভিত্তিক একই বিনিময় হার নির্ধারণ, রফতানি আয় রেমিট্যান্সের ওপর থেকে সব ভর্তুকি উঠিয়ে দেয়া, সুদের হার অবমুক্ত, রাজস্ব আহরণ বেগবান করার লক্ষ্যে কর ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, রাষ্ট্রীয় কলকারখানায় ক্রিয়াশীল ভর্তুকি তুলে দেয়া এবং সম্পদের জন্য একটা মুনাফাসম প্রাপ্তি এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি।

মোটকথা রাজস্ব, মুদ্রা এবং বৈদেশিক বাণিজ্য নীতির ন্যায্য ব্যবস্থাপনা চলমান সংকটে সাহায্য করতে পারে। যে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা যথা ডলারের দাম আকাশচুম্বী অথচ বিদেশগামী উড়োজাহাজের বিজনেস কিংবা ফার্স্ট ক্লাসে একটা সিটও ফাঁকা নেই, সে দেশে আরো কঠোর অবস্থান দরকার; দরকার অর্থ পাচার বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ।

 

আব্দুল বায়েস: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন অধ্যাপক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন