সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যা, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা

বণিক বার্তা অনলাইন

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছেন সুনামগঞ্জবাসী। ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুরে হাজার হাজার বসত ঘরে বানের পানি ঢুকে পড়েছে। জেলা শহরসহ এসব উপজেলায় বসত ঘরের নিচতলা কোমর পানিতে ডুবে আছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত থেকে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ-দিঘলী এলাকায় সড়ক প্লাবিত হয়েছে। এতে করে এ সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হওয়ার সুনামগঞ্জের সঙ্গে সারাদেশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেনও বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

বন্যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন জেলার বাসিন্দারা। শহরসহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে জেলা শহরে বিদ্যুৎ নেই। আজ  শুক্রবার সকাল ৯টার দিকেও বিদ্যুৎ ছিল না। দুর্ভোগে মাত্রা যোগ করেছে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কহীনতা। জেলা শহরে গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৩টা থেকে নিরবচ্ছিন্ন মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।

এদিকে টানা বৃষ্টির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছেন। দীর্ঘ ১৫ দিন ধরে আয় রোজগার বন্ধ রয়েছে। বানভাসী মানুষ উচ্চ মূল্যে নৌকা ভাড়া করে শহরের প্রাণকেন্দ্রে যাতায়াত করছেন। শহরের সবকটি শপিং মল প্লাবিত হয়েছে। হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে আছে। গ্রামের মানুষ গবাদিপশু, হাস, মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।

স্থানীয়রা জানান,জানমাল রক্ষায় তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্ত উজানের ঢল ও দিনভর ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে হু হু করে পানি ঢুকছে বসত ঘরে। সাংসারিক জিনিসপত্র চৌকি বা খাটের উপরে তুলে রেখেও শেষ রক্ষা করতে পারছেন না। টিভি, ফ্রিজসহ কোটি কোটি টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী এখন বানের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। পুরো সুনামগঞ্জ শহরের ৯০ ভাগ বসত ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। ছাতক শহরের শতভাগ এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। সুনামগঞ্জ ও ছাতক পৌর এলাকার প্রধান সড়ক হাঁটু পানি থেকে কোমর পানিতে ডুবে আছে। শহরের প্রধান সড়কগুলোতে অনায়াসে নৌকা চলাচল করছে।

৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পাঁচটি স্থান কোমর পানিতে ডুবে থাকায় সুনামগঞ্জের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছে। জেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ছাতক, তাহিরপুর দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভপুর উপজেলা। এসব এলাকার প্রধান সড়ক এখন সাঁতার কাটার মতো নিমজ্জিত। নৌকা ছাড়া এসব উপজেলায় যাওয়ার বিকল্প কোনও বাহন নেই। সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া, সাহেব বাড়ির ঘাট, উকিলপাড়া, নুতনপাড়া, শান্তিবাগ হাছননগর, পাঠানবাড়ি জেলরোড, মধ্যবাজার, পশ্চিমবাজার, বড়পাড়া, আরপিনগর, মল্লিকপুর ওয়েজখালী, হাজীপাড়া, নবীনগরসহ ৯টি ওয়ার্ডের পাঁচ শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ডুকে পড়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার ব্যবসায়ী।

বন্যায় সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের গোবিন্দগঞ্জ-দিঘলী এলাকা প্লাবিত হয়ে সারাদেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যার কারণে সুনামগঞ্জ শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বসতবাড়ির শত শত বিদ্যুতের মিটার পানিতে ডুবে গেছে।

ছাতকের শহরজুড়ে এখন থইথই পানি। শহরের এমন কোনও এলাকা ও সড়ক নেই যেটি বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়নি। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের আলফাত স্কয়ার থেকে শুরু করে নবীনগর পর্যন্ত পানি আর পানি। কোথাও হাঁটু, কোথাও এর চেয়ে বেশি পানি। কাজীর পয়েন্ট এলাকায় পানি বেশি থাকায় সেখানে নৌকায় যাতায়াত করেছেন লোকজন।

তাহিরপুরে বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। বন্যাদুর্গত মানুষজন তাদের গৃহপালিত গবাদিপশুসহ পরিবার পরিজন নিয়ে পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। সেই সঙ্গে বন্যার চরম অবনতি হওয়ার পরও উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকায় স্কুলপড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট নৌকায় স্কুলে যাচ্ছে। 

তাহিরপুর উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান শেখ জানান, উপজেলার ১৪৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশিরভাগই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে আটটি বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করায় সেগুলোতে পাঠদান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জেলা সদর সুনামগঞ্জের সঙ্গে গত ৪/৫ দিন ধরে তাহিরপুর উপজেলার সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রয়েছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম জানান, জেলার ৮০ শতাংশ অঞ্চল পানিতে ডুবে গেছে। শহরের প্রায় সব বাসাবাড়িতে পানি ঢুকেছে। তিনি জানান, শুক্রবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে সুরমা পয়েন্টে বন্যার পানি বিপৎসীমার ১০৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।পাউবোর এ কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার পানির স্তর ছিল ৮.২৪, যা শুক্রবার বেড়ে হয় ৮.৮৫। প্লাবিত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভারতের মেঘালয়ে আকস্মিক ভারী বর্ষণের কারণে সুনামগঞ্জ জেলা প্লাবিত হয়েছে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বন্যার পানিতে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ-দিঘলী এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সড়ক প্লাবিত হওয়ায় সেখান দিয়ে কোনো দূরপাল্লার গাড়ি আপাতত যেতে পারবে না। তবে সময় যত বাড়ছে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। 


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন