নওগাঁয় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ঘর

বছর না পেরোতেই ফাটল ধসে পড়ার শঙ্কা বাসিন্দাদের

আরমান হোসেন রুমন, নওগাঁ

নওগাঁর মহাদেবপুরের বাগধানা গ্রামে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ঘর ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

নওগাঁর মহাদেবপুরে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ- প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ভূমিহীন গৃহহীন ৭৬টি পরিবারকে দেয়া ঘর নির্মাণে অনিয়ম, অবহেলা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে এসব ঘর নির্মাণ করায় হস্তান্তরের এক বছর পার না হতেই দেয়াল মেঝেতে দেখা দিয়েছে ফাটল। উপহারের নিরাপদ বাসস্থানে থাকতে এসে এখন নিজেদের জীবনের ঝুঁকির মুখে পড়েছেন উপকারভোগীরা। সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে গৃহ নির্মাণে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে আশ্রয়ণ প্রকল্প--এর আওতায় ২০২০-২১ ২০২১-২২ অর্থবছরে মহাদেবপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে তিনটি পর্যায়ে কোটি ২৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১৬২টি ঘর ভূমিহীন গৃহহীন পরিবারের মাঝে হস্তান্তর হয়েছে। যেখানে দ্বিতীয় পর্যায়ের ৭৬টি ঘর নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল কোটি ৪৪ লাখ টাকা। লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব ঘরের প্রতিটিতে দুটি শয়নকক্ষ, একটি টয়লেট, রান্নাঘর, কমন স্পেস একটি বারান্দা রয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে চেরাগপুর ইউনিয়নের বাগধানা গ্রামে নয়টিসহ ওই ইউনিয়নে মোট ২৩টি ঘর নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে উপজেলায় চতুর্থ পর্যায়ে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন করে আরো ২৫টি ঘরের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।

সরেজমিন দেখা যায়, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে গত বছরের ২০ জুন সারা দেশে আশ্রয়ণ প্রকল্প--এর আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের জমিসহ ঘর আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হলেও নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের বাগধানা গ্রামে নির্মাণকাজ বিলম্বিত হওয়ায় ঘর হস্তান্তর করা হয় ১৯ জুলাই। পবিত্র ঈদুল আজহার দুদিন আগে আধাপাকা ঘরে উঠতে পেরে বেশ খুশিই হয়েছিলেন উপকারভোগী ভূমিহীনরা। তবে তাদের খুশি বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়নি। নতুন ঘরে ওঠার তিন মাস পর থেকেই মেঝে দেয়ালে দেখা দিতে থাকে ফাটল। বর্তমানে সেখানকার নয়টি ঘরের প্রতিটি শয়নকক্ষের দেয়াল, মেঝে দরজার লিন্টেলে বৃহৎ ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। সারা দেশে মুজিব বর্ষের ঘর নির্মাণে অনিয়মের তদন্ত চলায় দুই সপ্তাহ আগে নিজেদের দোষ ঢাকতে তড়িঘড়ি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার মাধ্যমে মিস্ত্রি পাঠিয়ে ঘরগুলোতে সিমেন্টের পুডিং রং ব্যবহার করিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এতে ফাটল ঢাকলেও ঘরগুলো যেকোনো মুহূর্তে ধসে পড়ার শঙ্কা রয়ে গেছে। বর্তমানে সেখানকার বাসিন্দারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারে এসব ঘর নির্মাণ করায় এত দ্রুত ফাটল দেখা দিচ্ছে বলছেন উপকারভোগীরা।

চেরাগপুর ইউনিয়নের বাগধানা গ্রামে মুজিব বর্ষের ঘরের বাসিন্দা সুমি আক্তার বলেন, আমাদের নিরাপদ বাসস্থান দিতে প্রধানমন্ত্রী ঘর উপহার দিয়েছেন। অথচ ঘরে ওঠার পর থেকেই প্রতিনিয়ত অনিরাপদভাবে জীবনযাপন করছি। ঘরের মেঝে দেয়ালগুলোতে এমনভাবে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে যে এটা দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় এখানে কর্তৃপক্ষের তদারকিতে অবহেলা ছিল। লিন্টেলে ফাটলের কারণে দরজা বন্ধ করতে গেলেই আটকে যাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে ঘর ধসে যেতে পারে। আমরা হতদরিদ্র। দিন আনি, দিন খাই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে চাতাল শ্রমিক স্বামীর পক্ষে দৈনিক খাবারের জোগান দেয়াটাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ঘর মেরামতের এত টাকা আমি কোথায় পাব। ঘরগুলো দ্রুত সঠিকভাবে মেরামত করে দেয়ার দাবি জানান তিনি।

মুজিব বর্ষের ঘরের আরেক বাসিন্দা ডেইজি বেগম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া উপহারের ঘরে উঠেছি এখনো এক বছর হয়নি। এরই মধ্যে ঘরের মেঝে, দেয়াল দরজার লিন্টেলে বড় বড় ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। কিছুদিন আগে ইউএনও অফিস থেকে লোক এসে তাড়াহুড়ো করে ফাটলগুলো ঢেকে রাখতে সামান্য সিমেন্টের পুডিং এবং রং করে গেছে। ফাটলগুলো আবারো বেরিয়ে আসছে। উপহারের ঘরে থাকতে এসে এখন দিনমজুর স্বামী শিশু নাতিকে নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছে। প্রকল্পে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

একই অভিযোগ করেন উপকারভোগী পরী বেগম, রেহেনা বেওয়া, রায়হান ইসলামসহ অন্য বাসিন্দারা। প্রধানমন্ত্রীর মহৎ উদ্যোগকে পুঁজি করে যেসব অসাধু কর্মকর্তা প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করেছেন, সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তারা।

বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মুলতান হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ঘর নির্মাণে কোথাও কোনো নিম্ন মানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়নি। ডিজাইনে সমস্যা থাকার কারণে বাগধানা গ্রামের ঘরগুলোতে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে।

বরাদ্দ বাড়ানোর পরেও কেন ঘর নিম্নমানের হলো বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, প্রথম পর্যায়ের চেয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘরগুলোতে ১৯ হাজার টাকা করে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল ঠিকই। তবে ওই সময় তাত্ক্ষণিক ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়নি। এজন্য ঘরগুলোতে ফাটল দেখা দিচ্ছে।

মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, মুজিব বর্ষের গৃহ নির্মাণে উপজেলার কোথাও কোনো অনিয়ম করা হয়নি। মাটির সমস্যার কারণে দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মিত বাগধানা গ্রামের ঘরগুলোতে বছর না পেরোতেই ফাটল দেখা দিয়েছে। এটা স্বাভাবিক ফাটল। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লোক পাঠিয়ে এরই মধ্যে ঘরগুলোর দেয়াল মেঝেতে পুডিং দিয়ে মেরামত করে দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে আবারো ফাটল সৃষ্টি হলে সেগুলোও তাত্ক্ষণিক মেরামত করে দেয়া হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন