নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্রতিষ্ঠাকালে দেয়া অর্থের বহুগুণ তুলে নিয়েছেন ট্রাস্টিরা

সাইফ সুজন

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ) প্রতিষ্ঠায় একেকজন ট্রাস্টি সর্বোচ্চ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন। অলাভজনক অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় অর্থের বিপরীতে কোনো ধরনের সুবিধা নেয়ার সুযোগ নেই তাদের। যদিও গত এক দশকে বিভিন্ন ভাতা বাবদই ১৭ কোটি টাকার বেশি অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে তুলে নিয়েছেন কয়েকজন ট্রাস্টি। প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা নয়টি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেছেন নয়জন ট্রাস্টি। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি কেনাকে কেন্দ্র করে পাঁচজন ট্রাস্টি ৮১ কোটি ২৫ লাখ টাকা একটি হাউজিং কোম্পানি থেকে ঘুস নিয়েছেন বলে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক তদন্তে উঠে এসেছে। সে হিসেবে প্রতিষ্ঠাকালে দেয়া অর্থের বহুগুণ এরই মধ্যে তুলে নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির আর্থিক সুবিধা নেয়া এসব ট্রাস্টি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) সদস্য সংখ্যা ১৫। এর বাইরে আইনি পদাধিকারবলে উপাচার্য বিওটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিওটির ছয়-সাতজন সদস্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নেন। এর বাইরে কয়েকজন সদস্য মাঝেমধ্যে বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠানে অংশ নিলেও বাকিরা একেবারেই অনুপস্থিত থাকেন। সক্রিয় এসব সদস্যের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে অবৈধভাবে নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এনএসইউর ট্রাস্টিদের অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, আমি অনেক আগে থেকেই একটি কথা বলে আসছি, এখনো বলছি, যদি নর্থ সাউথের ট্রাস্টিরা নামে-বেনামে আর্থিক সুবিধা নেয়া বন্ধ করেন, তাহলে সেখানকার শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ফি দিয়ে পড়ালেখা করতে পারবেন। ট্রাস্টিরা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের জোগান দেবেন, তারা কেন সেখান থেকে মুনাফা নেবেন। আসলে ট্রাস্টের মূল দর্শনের বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনিয়োগকে বাণিজ্যিকভাবে দেখার কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আর জমি কেনায় যে অনিয়মের ঘটনা সামনে এসেছে, এটা খুবই লজ্জার। তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

একটি হিসাবে দেখা গিয়েছে, এনএসইউর সক্রিয় ট্রাস্টিরা গত এক দশকে ১৭ কোটি টাকার বেশি ভাতা তুলে নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে। এর মধ্যে কয়েকজন গড়ে দুই-আড়াই কোটি টাকা হারে ভাতা নিয়েছেন। এর মধ্যে অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে সভায় অংশ না নিয়েও ভাতা নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি করোনাকালে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সভায়ও মোটা অংকের সিটিং অ্যালাউন্স নেন এনএসইউ ট্রাস্টিরা। সিটিং অ্যালাউন্স নিতে নানা অপ্রয়োজনীয় কমিটি গঠনের অভিযোগও রয়েছে এনএসইউ ট্রাস্টের বিরুদ্ধে। এসব কমিটির মধ্যে রয়েছে প্রোগ্রাম রিভিউ কমিটি, প্রশাসনিক পদোন্নতি কমিটি, শিক্ষক পদোন্নতি কমিটি, লাইব্রেরি কমিটি, শিক্ষক অনুসন্ধান কমিটি, ডিগ্রি পর্যালোচনা কমিটি, ছাত্র ভর্তি কমিটি, নিড অ্যাসেসমেন্ট কমিটি, টেকনিক্যাল কমিটি, ক্রয় কমিটি, শিক্ষক ছুটি কমিটি, একাডেমিক রিভিউ কমিটি, কনফারেন্স ট্রাভেল রিসার্চ গ্র্যান্ট কমিটি, আইন সাংবিধানিক কমিটি, ছাত্র বৃত্তি কমিটি, ক্যাম্পাস উন্নয়ন কমিটি, অডিট কমিটি, ইন্টারন্যাশনাল প্রমোশন অ্যান্ড অ্যাফিলিয়েশন কমিটি অন্যান্য কমিটি। এসব কমিটিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের সভায় যেকোনো ট্রাস্টি অংশ নিতে পারবেন বলে রেজল্যুশন অনুমোদন করেছে এনএসইউ ট্রাস্ট। যদিও অনেক আগেই এসব কমিটিকে অবৈধ ঘোষণা করে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন।

শুধু ভাতা নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে নিজেদের জন্য বিলাসবহুল গাড়িও কিনেছেন ট্রাস্টিরা। বছর কয়েক আগে ল্যান্ড রোভারের রেঞ্জ রোভার ২০১৯ মডেলের নয়টি বিলাসবহুল গাড়ি কেনে এনএসইউ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি সদস্যরা গাড়িগুলো ব্যবহার করছেন। রেজিস্ট্রেশনসহ একেকটি গাড়ি কিনতে ব্যয় হয়েছে প্রায় কোটি টাকা। এমনকি গাড়ির জ্বালানি চালকের বেতনের অর্থও পরিশোধ করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে। জ্বালানি বাবদ প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা নিচ্ছেন ট্রাস্টিরা। আর চালকের বেতনও ২০-২৫ হাজার টাকা।

এনএসইউ ট্রাস্টিদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ওঠে রূপগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি কেনাকে কেন্দ্র করে। জমি কেনার সময় হাউজিং কোম্পানিকে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি মূল্য পরিশোধ করে পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে মোটা অংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। ঘটনার তদন্তে নেমে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণও পেয়েছে দুদক। সম্প্রতি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুদকের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গির, গুতিয়াব পিতলগঞ্জ মৌজায় জমি কেনার জন্য আশালয় হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপারস নামের কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে এনএসইউ। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৬ সালে ৮২৫০ ডেসিমল জমির জন্য ৫০০ কোটি টাকা কোম্পানিকে দেয়। ২০১৯-২১ সালের মধ্যে একই মৌজায় আরো ৮৪৬ দশমিক ৮৮ ডেসিমল ভূমির জন্য ৩৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। দুদক একই মৌজাসংলগ্ন জমির বিক্রয়মূল্য বিবেচনায় নেয় এবং দেখতে পায় যে বিশ্ববিদ্যালয় কোম্পানিকে প্রায় ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করেছে। তদন্তে দুদক পেয়েছে, আশালয় হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন মো. হিলালী এনএসইউ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদকে ১৩ কোটি, এমএ কাশেমকে ১৪ কোটি, বেনজীর আহমেদকে ২৮ কোটি, রেহানা রহমানকে ১৪ কোটি প্রয়াত ট্রাস্টি এমএ হাসেমকে ১২ কোটি ২৫ লাখ টাকা ঘুস দিয়েছেন।

অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে সম্প্রতি একজন প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতিষ্ঠাকালে আমাদের লক্ষ্যই ছিল, আমরা এখান থেকে কোনো সুবিধা নেব না। কিন্তু আমাদের কয়েকজন ট্রাস্টি, বিশেষ করে মোহাম্মদ শাহজাহান বেনজীর আহমেদ দুজন সবসময়ই আর্থিক সুবিধা নেয়ার পক্ষে ছিলেন। তারা সুবিধা নিতে অন্যদেরও ধীরে ধীরে তাদের পক্ষে নিয়ে আসেন। একপর্যায়ে আর্থিক সুবিধা নেয়ার বিভিন্ন পরিবেশ তৈরি করেন তারা। এখন আমরাসহ পুরো প্রতিষ্ঠানই ইমেজ সংকটে পড়ে গিয়েছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন