রাশিয়া ইউক্রেনে সর্বাত্মক সামরিক হামলা চালিয়েছে। এ ন্যক্কারজনক ঘটনার অর্থনৈতিক ও আর্থিক পরিণাম আমাদের অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। সাম্প্রতিক দশকগুলোয় বিশ্বের নানা জায়গায় বেশকিছু ছোটখাটো সংঘাত চলেছে। সেগুলো থেকে ইউক্রেনে হামলা ভিন্নতর। এটা অন্য কোনো ছোট সংঘাত নয়; বরং স্নায়ুযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের একটা বড় উত্তরণ বৈকি। এর মাধ্যমে চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া এ চার সংশোধনবাদী শক্তি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর দীর্ঘদিনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে, যে ব্যবস্থাটি গড়ে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর।
বাজার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিশ্বব্যবস্থার এ পালাবদলের প্রভাব অবমূল্যায়ন করবেন কিনা, এটাই এখন বড় ঝুঁকি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে প্রথম হামলার দিন এ আশায় মার্কিন শেয়ারবাজারের সূচক বেড়েছিল যে চলমান যুদ্ধ ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বাড়ানোর বিষয়টি মন্থর করবে। যদিও বৃহত্তর অর্থনীতির দিক থেকে বর্তমানে একটি বৈশ্বিক স্থবিরতামূলক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলছেন, এ সংকট ও তার সৃষ্ট প্রভাব থেকে ফেড এবং অন্য প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো একটা নমনীয় অবস্থান নিতে পারে কিনা। আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অবস্থান যা-ই হোক না কেন, কেবল তাদের নীতি হস্তক্ষেপের ওপর আমাদের নির্ভর করলে চলবে না। প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও মূল্যস্ফীতি আরো বাড়িয়ে ইউক্রেনে চলমান সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিতে একটা ব্যাপকতর ঋণাত্মক সরবরাহ অভিঘাত সৃষ্টি করবে। সংঘাতটি এমন এক সময়ে ঘটছে, যখন মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশা এরই মধ্যে অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন।
আর্থিক বাজারে যুদ্ধের স্বল্পমেয়াদি প্রভাব এরই মধ্যে দৃশ্যমান। ব্যাপক স্থবিরতামূলক অভিঘাতের মুখে বৈশ্বিক ইকুইটিগুলো বিদ্যমান কারেকশন রেঞ্জ (-১০ শতাংশ) থেকে বিয়ার মার্কেট টেরিটরিতে (-২০ শতাংশ বা তারও বেশি) নেমে যেতে পারে। নিরাপদ সরকারি বন্ডের ইল্ড কিছুদিনের জন্য কমবে এবং তারপর মূল্যস্ফীতি কমে আসার পর বাড়বে। জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম আরো বাড়বে। ওই দুটি পণ্যের দাম প্রতি ব্যারেলে এরই মধ্যে ১০৫ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন কাঁচামাল ও খাদ্যের প্রধান রফতানিকারক হওয়ায় অন্য অনেক ভোগ্যপণ্যেরও দাম বাড়বে। সুইস ফ্রাঙ্কের মতো নিরাপদ আশ্রয়ের মুদ্রাগুলো শক্তিশালী হবে এবং স্বর্ণের দাম আরো বাড়বে।
যুদ্ধের অর্থনৈতিক ও আর্থিক পরিণামের সঙ্গে সৃষ্ট স্থবিরতামূলক অভিঘাত অবশ্যই রাশিয়া ও ইউক্রেনে বেশি হবে। এর পরের পর্যায়ে প্রভাব পড়বে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয়, রাশিয়ার গ্যাসের ওপর তাদের অতিনির্ভরতার কারণে। তবে যুক্তরাষ্ট্রও খুব একটা কম ভুগবে না। কারণ আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজার গভীরভাবে একীভূত। ফলে বৈশ্বিক জ্বালানি দামে উল্লম্ফন (ব্রেন্ট বেঞ্চমার্কের নিরিখে) মার্কিন অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম প্রভাবিত করবে। যুক্তরাষ্ট্র এখন নগণ্য নিট জ্বালানি রফতানিকারক দেশ হলেও অভিঘাতের সামষ্টিক বণ্টন হবে ঋণাত্মক। গুটিকয়েক জ্বালানি কোম্পানি বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারলেও পরিবার ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো একটা বড় ধরনের দামজনিত অভিঘাতের মুখোমুখি হবে, যা তাদের সার্বিক ব্যয় কমাবে।
এসব ডিনামিক্সের প্রেক্ষাপটে এমনকি অন্যভাবে শক্তিশালী মার্কিন অর্থনীতিও একটা তীব্র অধোগতিতে ভুগবে, যা দেশটিকে স্থবিরতামূলক প্রবৃদ্ধি মন্দার দিকে নিয়ে যেতে পারে। কঠোর আর্থিক পরিবেশ এবং ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থায় সৃষ্ট প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার হামলার ঋণাত্মক সামষ্টিক পরিণাম বাড়িয়ে তুলবে।
একইভাবে ভবিষ্যৎ নিবৃত্তির জন্য যতই আবশ্যক হোক না কেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো আবশ্যিকভাবে কেবল রাশিয়া নয়, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা দেশ ও উদীয়মান বাজারগুলোকেও ভোগাবে। তদুপরি কেউ এ সম্ভাবনা নাকচ করতে পারবে না যে পশ্চিমা অবরোধের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া নিজস্ব পাল্টামুখী পদক্ষেপ নেবে না। যেমন বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের দাম আরো বাড়াতে দেশটি লক্ষণীয় মাত্রায় তেল উৎপাদন কমানোর মতো পদক্ষেপ নিতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপে রাশিয়ার জন্য নিট সুফল বেশি হবে। এতে তেল রফতানিতে রাশিয়ার আর্থিক ক্ষতির চেয়ে বিশ্ববাজারে জ্বালানির বাড়তি মূল্যের ক্ষতি বেশি হবে, যতক্ষণ মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। পুতিন জানেন, পশ্চিমা অর্থনীতি ও বাজারের ওপর তিনি একটা অপ্রতিসম ক্ষতি করতে পারেন। কারণ তিনি গত এক দশকে মোট রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের একটা ভালো অংশই সামরিক-প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় ব্যয় করেছেন এবং এখন বাড়তি অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে একটি নিজস্ব আর্থিক সুরক্ষা ব্যূহ সৃষ্টি করছেন।
একটি গভীর স্থবিরতামূলক অভিঘাত কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য একটা শাঁখের করাতের মতো। এর প্রতিক্রিয়া দেখালেও তারা নিন্দিত হবে, আবার না দেখালেও নিন্দিত হবে। এমন এক পরিবেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে যেখানে রেখার পেছনে রয়েছে, সেখানে ধীরে ধীরে কঠোর নীতি গ্রহণ মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশার লাগামহীনতা আরো বেগবান করবে; যা অর্থনৈতিক স্থবিরতা আরো সম্প্রসারণ করবে বৈকি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি আগ্রাসী মনোভাবে থাকে (কিংবা আরো আগ্রাসী হয়) তাহলে বেড়ে চলা মন্দা আরো ভয়াবহ হবে।
মূল্যস্ফীতি প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আগ্রাসীভাবে মোকাবেলা করা উচিত হলেও তাদের বেশির ভাগই বোধহয় অনেকটা দায়সারাভাবে কাজটি করবে, যেমনটা ১৯৭০-এর দশকে তারা করেছিল। তারা বলবে যে সমস্যাটি সাময়িক এবং মুদ্রানীতি কোনো বহিঃস্থ ঋণাত্মক সরবরাহ অভিঘাত পাল্টাতে পারে না। শেষ পর্যন্ত যখন চূড়ান্ত মুহূর্ত আসবে, তারা সম্ভবত সাড়া দেবে। আরো ভয়াবহ মন্দা এড়াতে ধীর আর্থিক কঠোরতা নীতি গ্রহণ করবে। এটা মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশা আরো বেশি বল্গাহীন করে তুলবে।
রাজনীতিবিদরা অবশ্য ইত্যবসরে ঋণাত্মক সরবরাহ অভিঘাত প্রশমনের চেষ্টা করবেন। যুক্তরাষ্ট্রে নীতিনির্ধারকরা নিজস্ব কৌশলগত পেট্রোলিয়াম মজুদ কমিয়ে পেট্রলের মূল্যবৃদ্ধি হ্রাসের চেষ্টা করবেন এবং সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত করবেন। কিন্তু এসব পদক্ষেপের খুবই কম প্রভাব পড়বে। কারণ দামের আরো উল্লম্ফনের ব্যাপকতর শঙ্কা বৈশ্বিক জ্বালানি মজুদদারি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
এদিকে স্থবিরতামূলক অভিঘাতের প্রবৃদ্ধি হ্রাসকারী প্রভাব পরিবর্তনে পশ্চিমা দেশের নেতারা আর্থিক নীতিগুলোর ওপরও নির্ভর করতে পারবেন না। কেননা কভিডের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য উন্নত অর্থনীতিগুলোর আর্থিক হাতিয়ার প্রায় নিঃশেষিত হয়ে আসছে। তদুপরি আর্থিক (চাহিদা) প্রণোদনা স্থবিরতামূলক সরবরাহ অভিঘাত মোকাবেলায় কোনো সঠিক ব্যবস্থা নয়, ভুল পদক্ষেপ। অভিঘাতের ঋণাত্মক প্রভাব কমাতে পারলেও এটি মূল্যস্ফীতিমূলক চাপ বাড়ায়। আবার যদি অভিঘাতের প্রতিক্রিয়ায় নেতারা মুদ্রা ও আর্থিক উভয় নীতির ওপর নির্ভর করেন, তাহলে স্থবিরতামূলক পরিণাম আরো ভয়াবহ হবে এবং সেটি হবে মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশায় আরো বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলার মাধ্যমে।
আপাতত ভাবতে প্ররোচিত হচ্ছি যে বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থনৈতিক ও আর্থিক প্রভাব হবে সামান্য ও সাময়িক। সর্বোপরি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে রাশিয়ার অংশ মাত্র ৩ শতাংশ (এবং ইউক্রেনের আরো কম)। এটা একটা আশার দিক।
সন্দেহ নেই, পুতিনের যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতির আস্থায় বড় আঘাত হানবে, যখন নাজুক পুনরুদ্ধার এরই মধ্যে অনিশ্চয়তা ও বেড়ে চলা মূল্যস্ফীতিমূলক চাপের এক কালপর্বে ঢুকছে। আশা রাখি, ইউক্রেন সংকটের আসন্ন প্রভাব সাময়িক বৈ অন্য কিছু হবে না।
[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]
নুরিয়েল রুবিনি: নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক; সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও ফিনটেক-বিষয়ক কোম্পানি অ্যাটলাস ক্যাপিটাল টিমের মুখ্য অর্থনীতিবিদ
ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির