পিএইচডির রেকর্ড

জ্ঞান সৃজন না সুনাম কোনটা প্রভাবক

মো. রবিউল ইসলাম

পিএইচডি নিয়ে পাশ্চাত্যের একটা মজার ট্রল হচ্ছে প্লাম্বিং-হিটিং-ড্রেন ক্লিনিং যদিও সেখানে শুধু মজার ছলে এমন অর্থ বের করা হয়েছে। আসলে পিএইচডি মূলত ডক্টর অব ফিলোসফির সংক্ষিপ্ত রূপ, যা উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি। ডিগ্রির দরকার হয় মূলত গবেষক, বিজ্ঞানী একাডেমিকদের। যারা শ্রমসাপেক্ষ গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন শাখা-প্রশাখার উন্মেষ ঘটাতে চায়। তাই তো, একটা পিএইচডি ডিগ্রি একজন পেশাজীবী গবেষকের বা একাডেমিকের সারা জীবনের সাধনার ফল। কারণ এটা শুধু একটা ডিগ্রি নয়, এর মাধ্যমে নতুন তত্ত্বের আবিষ্কার হয়, যা দেশ জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যে কেউ চাইলে এই ডিগ্রি নিতে পারে না। কারণ এটার জন্য যে যোগ্যতা, ত্যাগ, নিষ্ঠা, মেধা পরিশ্রম লাগে, তা সবার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। তাই বিদেশে শুধু হাতে গোনা কিছু ব্যক্তি এই ডিগ্রি লাভ করেন, যারা নিজেদের গবেষণায় বা শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োজিত রাখেন।

কিন্তু বাংলাদেশে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মতোই, পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সংখ্যায়ও মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। গত ১২ জানুয়ারি, বণিক বার্তায় খবর বেরিয়েছে যে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রায় ৬৪১ জন শিক্ষার্থী পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। করোনাকালে সবকিছু থেমে থাকলেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডির বাম্পার ফলন হয়েছে। এমন সংখ্যাধিক্য দেখলে পাশ্চাত্যের সেই ট্রলের কথা মনে পড়ে; পিএইচডি কি দেশে ডক্টর অব ফিলোসফি নাকি প্লাম্বিং-হিটিং-ড্রেন ক্লিনিং মার্কা এক ইন্টেলেকচুয়াল ট্রল!

আন্তর্জাতিক বিশ্বে র্যাংকিংয়ে ৫০০-এর মধ্যেও থাকা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে শুধু অ্যাডমিশন পেতে গেলে যে পরিমাণ কঠিন সব শর্ত পূরণ করতে হয় আর একাডেমিক পেপারস জমা দিতে হয়, তা অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বা গবেষকের পক্ষেও অনেক সময় সম্ভব হয় না। আর বিদেশী স্কলারশিপ পাওয়ার চ্যালেঞ্জের কথা আর না- বললাম। অথচ আমাদের দেশে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়া আর দেয়া নিয়ে যে তামাশা চলে, তা বর্ণনাতীত। খবরের কাগজে যেনতেন উপায়ে অথবা রিসার্চ চুরি করে ডিগ্রি নেয়ার খবর শোনা গেছে অনেকবার। মন চাইলেই দেশে পিএইচডির অ্যাডমিশন পাওয়া যায়, আবার নতুন কোনো বিষয়ে সিরিয়াস গবেষণা ছাড়াও ডিগ্রি পাওয়া যায়। কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেন আবার পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার এক নীরব প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অ্যাডমিশন, কোর্সওয়ার্ক, গবেষণা এবং ডিজারটেশন লেখার ক্ষেত্রে কতটুকু স্ট্যান্ডার্ড মানা হয়, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থাকলেও এই ডিগ্রির মান উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির যথেষ্ট তত্পরতা চোখে পড়েনি। এমনকি নিজের পিইচডি ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও অনেকে পিএইচডির সুপারভাইজার হয়ে বছরে বছরে অন্যকে পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে ফুলটাইম চাকরি করেও পিএইচডি শেষ করছেন যথাসময়ে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার!

এখন দেখা যাক, কারা পিএইচডি ডিগ্রি নিচ্ছেন? যদিও শিক্ষক আর গবেষকদের পিএইচডি ডিগ্রি থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে জাতি, ধর্ম আর পেশা নির্বিশেষে, অনেকেই শখের বশে ডিগ্রি নিয়ে থাকেন। রুটিন দায়িত্ব পালন করা বা শুধু ফাইল মেইনটেইন করা নির্বাহী চাকুরেরাও সময় পেলে করে নিচ্ছেন পিএইচডি। কেউ কেউ ওএসডি কালীন অবসর কাটাচ্ছেন পিএইচডি ডিগ্রি করে। পিএইচডি এখন দেশের সবচেয়ে বড় ফ্যান্টাসি! ডিগ্রি দেশে অনেক ক্ষেত্রেই এত সহজেই করা যায় যে, কোনো কোনো সময় মনে হয়, ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষাও বোধ হয় এর চেয়ে কঠিন ছিল। নামকাওয়াস্তে একটা টপিক ঠিক করে, আর সিরিয়াস গবেষণা বা বিজ্ঞানভিত্তিক মেথোডলজি ছাড়াই চলতে থাকে পিএইচডি অধ্যয়ন। দেশীয় পিএইচডির ছাত্র আর সুপারভাইজার কেউই তেমন চাপ নিতে চান না। তাদের দ্বিপক্ষীয় সুবিধার লেনদেনে চলতে থাকে পিএইচডি। কিছু সুপারভাইজার আবার হাই প্রোফাইল পিএইচডি ক্যান্ডিডেট নিয়ে, নিজের কানেকশন আর বৈষয়িক সুবিধা বাড়িয়ে নেন কয়েক গুণে। তাই অনেক ক্ষেত্রে পিএইচডি করে যে শুধু শিক্ষার্থী উপকৃত হন, তা নয়; বরং সুবিধাবাদী কিছু শিক্ষক-লেবাসধারী সুপারভাইজার পিএইচডি শিক্ষার্থী ভর্তি নিতে এবং তাদের ডিগ্রি দিতে অতি উৎসাহী থাকেন। তবে কিছু ভালো মানের পিএইচডি যে দেশে হয় না, তা বলা যাবে না। তবে সেগুলোর সংখ্যা নিতান্তই কম।

শুধু নামের আগে ডক্টর লেখার জন্যও দেশে পিএইচডি করা হয়। বিচিত্র দেশে, মানুষের যত বিচিত্র খেয়াল! যেন জাতে ওঠার এক অদ্ভুত চেষ্টা! বাংলাদেশ আসলে এমন নামসর্বস্ব ডক্টরেটদের দিয়ে কী করবে? দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানে, পিএইচডিধারী গবেষক আর বিজ্ঞানীদের যে ধরনের অবদান থাকার কথা ছিল, তার সিকিভাগও দেশ পায়নি। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে, ডিগ্রিধারী বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি শিক্ষার মান আর ডিগ্রির কার্যকারিতা। কেন যে কাউকে পিএইচডি করতে হবে? কেন এত কঠিন ডিগ্রি, এত সহজে দেয়া হবে? যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উন্নয়ন বলতে শুধু ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন বোঝে, সেখানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি কি আদৌ ডক্টর অব ফিলোসফি হতে পারছে, নাকি প্লাম্বিং-হিটিং-ড্রেন ক্লিনিং-এর মতো এক একাডেমিক ট্রল হয়ে যাচ্ছে? যদিও প্লাম্বিং-হিটিং-ড্রেন ক্লিনিং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে; কিন্তু নামের ডক্টরেট আমাদের কী কামে লাগবে?

 

মো. রবিউল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক

আইন বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন