বাংলাদেশ
তার
সমপর্যায়ের
রাষ্ট্রগুলোর
মধ্যে
বিভিন্ন
দিক
থেকে
নেতৃত্ব
দিচ্ছে।
অর্থনীতির
বিভিন্ন
সূচক
ছাড়াও
সামাজিক
নানা
সূচকে
এ
অগ্রগতি
স্পষ্ট।
উন্নয়ন
দর্শন
বাংলাদেশের
এ
নেতৃত্বের
ভিত্তি।
এ
বছর
বাংলাদেশের
সুবর্ণজয়ন্তী
ও
জাতির
জনক
বঙ্গবন্ধু
শেখ
মুজিবুর
রহমানের
জন্মশতবার্ষিকী
উদযাপন
করা
হচ্ছে।
৫০
বছরে
এসে
বাংলাদেশ
তার
অবস্থানকে
আরো
সংহত
করতে
সক্ষম
হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক
তার
স্বীকৃতিও
দিয়েছে।
সুবর্ণজয়ন্তী
উপলক্ষে
আমাদের
প্রতিবেশী
দেশগুলোর
রাষ্ট্রপ্রধানরা
সশরীরে
উপস্থিত
হয়ে
বঙ্গবন্ধুর
তাত্পর্যময়
জীবনসংগ্রাম
ও
বাংলাদেশের
প্রগতিশীলতার
বিভিন্ন
দিকে
আলোকপাত
করেছেন।
আর
যারা
উপস্থিত
হতে
পারেননি,
তারাও
ভিডিও
কিংবা
লিখিত
বক্তব্য
দিয়ে
আমাদের
এ
অগ্রযাত্রায়
পাশে
থাকার
অঙ্গীকার
করেছেন।
জাতির
জনক
বঙ্গবন্ধু
শেখ
মুজিবুর
রহমানের
জন্মশতবার্ষিকীতে
তার
জীবনের
অনেক
অনুন্মোচিত
দিক
আমাদের
সামনে
গুরুত্ব
নিয়ে
উপস্থিত
হচ্ছে।
এটি
আমাদের
নতুন
করে
সমৃদ্ধ
করছে।
আমাদের
প্রতিবেশী
দেশগুলোর
রাষ্ট্রপ্রধানরা
এসে
উদ্দীপ্ত
বাংলাদেশ
দেখে
গেছেন।
আমাদের
আঞ্চলিক
বন্ধুত্বের
এ
উষ্ণতা
আমাদের
মুগ্ধ
করেছে।
আমার
ধারণা
এটি
আঞ্চলিক
যোগাযোগ
আরো
গতিশীল
করবে
এবং
আমাদের
আস্থা
আরো
বাড়িয়ে
তুলবে।
এই
আঞ্চলিক
অধিকতর
সংযুক্তি
আমাদের
আঞ্চলিক
ন্যায্যতা,
সামাজিক
সাম্য,
পরিবেশ
ও
বহুপক্ষীয়
স্বার্থসংশ্লিষ্ট
বিষয়
নিয়ে
নতুন
করে
ভাবার
সুযোগ
সৃষ্টি
করেছে।
কেবল
সহজে
পণ্য
পরিবহন—সেটি
সড়কপথ,
নৌপথ,
রেল
ও
আকাশপথে—নতুন
নতুন
রুট
চালুর
বিষয়ই
নয়,
এগুলো
তো
অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধির
ক্ষেত্রে
অবশ্যই
ভূমিকা
রাখবে,
তবে
যেদিকটি
এখানে
কিছুটা
উপেক্ষিত
থাকছে,
আমি
এখানে
সেদিকটি
সম্পর্কে
কিছুটা
আলোকপাত
করতে
চাই।
এখন
দরকার
জনগণের
পর্যায়ে
সংযোগ
ও
ন্যায্যতার
ধারণার
বিস্তৃতি।
আমাদের
দেশের
বুদ্ধিবৃত্তিক
ও
নৈতিকতার
চর্চায়
সবকিছুকে
আপেক্ষিক
ধারণা
হিসেবে
বোঝানোর
চেষ্টা
করা
হয়।
এটিকে
আমরা
সাংস্কৃতিক
বিচ্ছিন্নতাবাদ
বলতে
পারি।
ঘটনা
হলো
এক
সংস্কৃতির
বিতর্ক
ও
যুক্তি
অন্য
সংস্কৃতির
ওপর
প্রভাব
ফেলে।
পারস্পরিক
এ
আদান-প্রদানকে
সাংস্কৃতিক
বিচ্ছিন্নতাবাদীরা
গ্রহণ
করতে
চান
না।
তারা
নিজস্বতা
ও
বিশুদ্ধতার
মেকি
দাবি
তোলেন।
উত্তরাধুনিকতাবাদ,
উত্তর-উপনিবেশবাদ
এবং
এ
ধরনের
সমগোত্রীয়
অনেক
তত্ত্বচর্চার
ফলে
আমাদের
বুদ্ধিবৃত্তিক
এক
ধরনের
বন্ধ্যত্ব
সৃষ্টি
হয়েছে।
বাংলাদেশের
ভৌগোলিক
ও
আর্থসামাজিক
অবস্থান
ও
অবস্থা
সেখানে
বিবেচ্য
নয়।
আমাদের
মুক্তিযুদ্ধ,
স্বাধীনতার
ইতিহাস
ও
মনন
সে
চিন্তায়
অনুপস্থিত।
অর্থাৎ
আমাদের
বাংলাদেশ
সেই
বুদ্ধিবৃত্তিক
চর্চায়
নেই।
এর
সঙ্গে
যুক্ত
হলো
ধর্মীয়
উগ্রবাদ।
ফলে
বাংলাদেশ
সামনের
দিকে
কীভাবে
এগোতে
পারে,
তার
সম্ভাবনাগুলো
কীভাবে
কাজে
লাগাতে
পারে
আর
বাধাগুলো
কীভাবে
অতিক্রম
করতে
পারে,
সে
বিবেচনাগুলো
তাদের
চর্চায়
একেবারে
অনুপস্থিত।
বুদ্ধিবৃত্তিক
শ্রম
দিয়ে
যেন
তারা
দেশের
প্রগতির
পথে
অবদান
রাখার
কথা
মনে
আনছেন
না।
বন্ধ্যত্ব
আরো
আছে।
যেকোনো
পশ্চিমা
দার্শনিকের
বক্তব্য
শোনা-বোঝার
ক্ষেত্রে
তার
চিন্তার
জন্ম
কোন
ভূখণ্ডে,
সেটিই
যেন
তাদের
কাছে
শেষ
কথা।
ফলে
সে
চিন্তার
বিরোধিতা
করাই
ফ্যাশনে
পরিণত
হয়েছে।
এখানে
বরং
গুরুত্বপূর্ণ
হলো
চিন্তাগুলো
কীভাবে
রূপান্তর
হয়েছে
এবং
নতুন
প্রেক্ষাপটে
এর
প্রাসঙ্গিকতা
কতখানি
তার
বিচার
করা।
প্রথম
কথা
হলো,
মানুষে
মানুষে
সম্পর্ক
ও
যোগাযোগের
কেন্দ্রীয়
বিষয়
হলো
ন্যায্যতা
ও
সমদর্শিতার
ভাবনা।
এ
বিষয়ে
আলোচনায়
আমি
প্রায়
এক
দশক
আগে
অধ্যাপক
অমর্ত্য
সেনের
ডেভিড
হিউম
স্মারক
বক্তৃতার
দিকে
সবাইকে
দৃষ্টিপাত
করতে
বলব।
পঞ্চাশোর্ধ্ব
বাংলাদেশের
সামনে
একুশ
শতকে
যেসব
নতুন
সমস্যা
ও
সংকট
রয়েছে,
তার
জন্য
নতুন
বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি
নির্মাণে
জ্ঞানের
গুণগত
রূপান্তরের
প্রয়োজন
আমরা
অনুভব
করি।
আর
তার
ভিত্তি
হবে
ন্যায্যতা
ও
সমতাধর্মী
বাংলাদেশ
নির্মাণ।
কথাটি
লক্ষ্যের
দিক
থেকে
বলা
হলেও
এটি
মূলত
জোর
দিয়ে
বলা
মাত্র।
সত্যিকারের
ন্যায্য
বাংলাদেশ
নির্মাণ
করতে
গেলে
যুক্তি
দিয়েই
প্রতিষ্ঠিত
করতে
হবে।
আর
বাংলাদেশ
নির্মাণের
নতুন
রাস্তা,
পথ
ও
পদ্ধতির
জন্য
অত্যন্ত
ধৈর্যশীলভাবে
এগোতে
হবে।
ন্যায্য
বাংলাদেশের
জন্য
যেকোনো
জ্ঞান
নির্মাণ
ও
প্রচেষ্টা
অসম্পূর্ণ
হতে
পারে,
এটিতে
লজ্জার
কিছু
নেই।
কারণ
অসম্পূর্ণতাকে
ব্যর্থতা
হিসেবে
দেখার
প্রচলিত
দৃষ্টিভঙ্গি
আমাদের
উদ্যম
নষ্ট
করতে
পারে।
সুতরাং
অসম্পূর্ণতাকে
ব্যর্থতার
বাতাবরণে
দেখলে
চলবে
না।
কারণ
কখনো
কখনো
অসম্পূর্ণতাকে
ন্যায্যতা
অর্জনের
ত্রুটি
হিসেবে
দেখা
হয়।
অসম্পূর্ণতাকে
অধিকতর
ন্যায্যতার
পথে
সুচিন্তিত
ও
শক্তিশালী
ভূমিকা
দেয়া
যেতে
পারে।
সর্বোপরি
ন্যায্যতা
কোনো
একমাত্রিক
বিষয়
নয়।
ন্যায্যতার
যুক্তির
বহুত্ব
ও
বৈচিত্র্য
আমাদের
স্বীকার
করতে
হবে।
যেমন
ভালো
চিকিৎসা
ব্যবস্থা
কিংবা
ভালো
মানের
শিক্ষা
থেকে
অধিকাংশ
মানুষ
বঞ্চিত
হলে
স্পষ্টভাবে
ব্যর্থতা
ফুটে
উঠছে,
যা
থেকে
অতিসত্ব
উত্তরণ
প্রয়োজন।
আর
তা
সম্ভব
হলে
ন্যায্যতাকেও
এগিয়ে
নিয়ে
যাওয়া
যায়।
এশিয়ার
মধ্যে
দক্ষিণ
কোরিয়া
ও
ভিয়েতনাম
দেশ
দুটো
বহুদূর
অগ্রসর
হয়েছে।
বাংলাদেশের
অবস্থার
উন্নয়নে
বিদ্যাচর্চার
অবদান
আছে—এটির
বিশ্বাসের
ওপর
ভর
করেই
এগোতে
হবে।
ন্যায্য
বাংলাদেশের
সৌন্দর্য
ফুটে
উঠবে
যখন
আমরা
যুক্তি
প্রয়োগে
নিষ্পক্ষতা
ও
প্রয়োগযোগ্যতা
বিবেচনায়
রাখব।
কথা
আরো
আছে।
ভৌগোলিক
অবস্থানগত
কারণে
বাংলাদেশ
আঞ্চলিক
যোগাযোগের
কেন্দ্রে
রয়েছে।
বিশেষ
করে
বাংলাদেশকে
কেন্দ্রে
রেখে
ভারত,
নেপাল
ও
ভুটানের
আঞ্চলিক
যোগাযোগের
যে
নতুন
ক্ষেত্র
তৈরি
হয়েছে—বিবিআইএন
চুক্তি,
নতুন
নৌপথের
রুটগুলো,
চট্টগ্রাম
বন্দরের
ব্যবহার—এসবের
সম্ভাবনা
অসীম।
এতে
পণ্য
পরিবহন
খরচ
কেবল
কমে
আসাই
নয়,
বিভিন্ন
দেশের
মানুষের
মধ্যেও
সমৃদ্ধ
সংস্কৃতির
আদান-প্রদান
সহজতর
হবে।
এসব
যোগাযোগ
কেবল
সরকার
পর্যায়েই
নয়,
এসব
দেশের
মানুষে
মানুষে
যে
সংযোগ
ও
ভাবনাচিন্তার
আদান-প্রদান
ঘটবে,
তারই
পরিপ্রেক্ষিতে
কতগুলো
জরুরি
বিষয়
এখানে
তুলে
ধরছি।
আঞ্চলিক
যোগাযোগের
ক্ষেত্রে
আমাদের
দেশের
মানুষ
সহজে
ভিন্ন
ভিন্ন
দেশের
মানুষের
সঙ্গে
অধিকতর
ভাবনা-চিন্তা
আদান-প্রদানের
সুযোগ
পেতে
যাচ্ছে,
ফলে
ন্যায্যতা
বিষয়ে
ভাবনার
পরিধি
প্রশস্ত
করা
অত্যন্ত
প্রয়োজন।
এখানে
বাহাত্তরের
সংবিধানের
চারটি
মূলনীতি
বিশেষভাবে
প্রণিধানযোগ্য:
জাতীয়তাবাদ,
গণতন্ত্র,
ধর্মনিরপেক্ষতা
ও
সমাজতন্ত্র।
আমাদের
মূলনীতিগুলোর
একটি
বৈশ্বিক
আবেদন
রয়েছে,
যেগুলো
আমাদের
শহীদরা
অত্যন্ত
দূরদৃষ্টির
সঙ্গে
প্রতিষ্ঠা
করে
গেছেন।
এ
মূলনীতিগুলোকে
আসলে
প্রত্যেক
নাগরিকের
মূল্যবোধে
পরিণত
করার
লক্ষ্যে
আমাদের
জোরালো
সাংস্কৃতিক
আন্দোলন
গড়ে
তুলতে
হবে।
আগেই
বলেছি
অন্যান্য
মানুষের
সঙ্গে
সম্পর্ক
ন্যায্যতার
ভিত্তিতে
হওয়া
অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ।
এটি
আমার
কথা
নয়,
অমর্ত্য
সেনের
কথা।
ন্যায্যতার
পরিসর
বিস্তৃত
করার
ক্ষেত্রে
সার্বভৌম
রাষ্ট্রের
সীমানার
ভেতর
তাকে
সীমিত
করার
হবসীয়
(দার্শনিক থমাস
হবস)
ভাবনা
তার
সঙ্গে
তিনি
একমত
হতে
পারেননি।
অমর্ত্য
সেন
কেন
ন্যায্যতা
বিষয়ে
ডেভিড
হিউমের
দূরদৃষ্টি
পছন্দ
করেছেন,
তা
তিনি
ব্যাখ্যা
করেছেন।
হিউমের
চিন্তার
ব্যাপক
গুরুত্ব
থাকার
পরও
কেন
তা
অবহেলিত,
সে
ব্যাপারে
আক্ষেপ
করেছেন
অমর্ত্য
সেন।
তিনি
বলেছেন,
তার
অন্তর্দৃষ্টি
কেবল
দূরদূরান্তে
যারা
বসবাস
করছে,
শুধু
সেক্ষেত্রেই
বিবেচ্য
নয়;
বরং
আন্তঃপ্রজন্মের
ক্ষেত্রেও
প্রযোজ্য।
অমর্ত্য
সেনের
ভাষায়,
‘হিউমের অন্তর্দৃষ্টির
মধ্যে
একটা
হচ্ছে
নৈতিক
বিষয়গুলোকে
ভালোভাবে
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
করার
ক্ষেত্রে
তথ্য
ও
জ্ঞানের
গুরুত্ব
স্বীকার
করা।
অন্য
একটি
ব্যাপার
হচ্ছে,
মানবসংবেদনের
(সেন্টিমেন্টস) জোরালো
ভূমিকাকে
অগ্রাহ্য
না
করেও
যুক্তির
গুরুত্ব
মেনে
নেয়া।
তাছাড়া
তার
অন্তর্দৃষ্টি
আমাদের
শেখায়,
যারা
এ
পৃথিবীর
অন্যত্র,
আমাদের
থেকে
বহু
দূরে
বাস
করেন,
এমনকি
যারা
এখনো
জন্মাননি,
ভবিষ্যতে
এ
পৃথিবীর
বাসিন্দা
হবেন,
তাদের
কথা
ভাবাও
আমাদের
দায়িত্ব।’
আমাদের
আঞ্চলিক
যোগাযোগের
ক্ষেত্রে
ন্যায্যতার
বিস্তৃত
ধারণাটি
পেতে
হিউমের
চিন্তা
কীভাবে
সাহায্য
করতে
পারে,
সেটি
অমর্ত্য
সেন
বেশ
জোর
দিয়েই
বলেছেন।
তার
ভাষায়,
“১৭৫১ সালে
প্রকাশিত
‘অব জাস্টিস’
প্রবন্ধ।
প্রবন্ধটি
পরে
তার
অ্যান ইনকোয়ারি কনসার্নিং দ্য
প্রিন্সিপালস অব
মোরালস
গ্রন্থে
অন্তর্ভুক্ত
হয়।
হিউমের
সময়টা
ছিল
বিশ্বায়নের
শুরুর
সময়—তখনকার
পৃথিবীতে
আবিষ্কার
হয়ে
চলেছিল
নতুন
নতুন
বাণিজ্যপথ,
বিশ্বের
বিভিন্ন
প্রান্ত
আর্থিক
সম্পর্কে
যুক্ত
হয়ে
চলেছিল।
আমরা
ভিন্ন
প্রান্তের
মানুষ
সম্পর্কে
বেশি
করে
জানতে
পারছিলাম
এবং
তাদের
সঙ্গে
সম্পর্ক
স্থাপন
করছিলাম।
ঠিক
এ
কারণে
হিউম
ন্যায্যতার
ধারণাটিকে
নতুন
আলোকে
দেখার
ক্রমবর্ধমান
প্রয়োজনটার
কথা
তুলে
ধরেন।”
এক্ষেত্রে
অমর্ত্য
সেন
হিউমের
অব
জাস্টিস
বা
ন্যায্যতা
প্রসঙ্গে
প্রবন্ধ
থেকে
উদ্ধৃতি
দেন।
হিউমের
ভাষায়,
‘আবার ধরা
যাক,
আলাদা
আলাদা
সমাজ
পারস্পরিক
সুবিধা
ও
সুযোগের
ভিত্তিতে
নিজেদের
মধ্যে
বিশেষ
ধরনের
আদান-প্রদানে
লিপ্ত
হচ্ছে।
এই
সূত্র
ধরে
মানুষের
দৃষ্টির
ব্যাপকতা
এবং
তাদের
পারস্পরিক
সংযোগের
জোর
যেমন
যেমন
বেড়ে
চলেছে,
ন্যায্যতার
পরিধিও
তেমন
তেমন
প্রসারিত
হচ্ছে।
ইতিহাস,
অভিজ্ঞতা
ও
যুক্তি
আমাদের
নানা
বিষয়ে
ভালোমতো
আলোকিত
করে:
আমরা
শিখি
যে
মানবসংবেদনগুলোর
(সেন্টিমেন্টস) স্বাভাবিক
ক্রমপ্রসারণ
ঘটে
এবং
ন্যায্যতার
শুভ
ফলগুলো
সম্পর্কে
আমরা
যতই
জানতে
থাকি
ততই
ন্যায্যতার
প্রতি
আমাদের
শ্রদ্ধা
বাড়তে
থাকে।’
মহামারীর এ সময়টায় টিকার যে হাহাকার চলছে, তার পেছনে অনেক কারণ থাকলেও সব মানুষ বা সব রাষ্ট্রের নাগরিকদের সমদৃষ্টিতে দেখার অভাবও একটি বড় কারণ। টিকায় কেবল ধনী রাষ্ট্রের নাগরিকদেরই অগ্রাধিকার আর অন্যদিকে গরিব রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি অবহেলার দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক ন্যায্যতার পথে বিরাট অন্তরায়। আর এ কারণেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের প্রতি কভিড টিকাকে বিশ্বপণ্য (গ্লোবাল প্রডাক্ট) হিসেবে ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন। যেসব পণ্যের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যই এমন যে আমি কনজিউম করলে আমার তো প্রয়োজন পূরণ হলোই, সঙ্গে অন্যেরও উপকার হচ্ছে, সেসব ভোগ্যপণ্য বাজারের মাধ্যমে বিতরণের চেয়ে ‘ফ্রি’-তে বা বিনা মূল্যে বিতরণ করলে বেশি সুফল পাওয়া যায়। কারণ এটি নিশ্চিত করতে হবে যে সমাজে যেন এটি বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অধিকাংশকে (ধরা যাক ৮০ ভাগ জনগোষ্ঠীকে) ভ্যাকসিনেটেড বা টিকাকরণ করতে পারলে সমাজ অধিক মাত্রায় সুরক্ষিত হবে। তবে এক্ষেত্রে টিকা সুরক্ষা কেবল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সীমানার ভেতরেই সীমিত রাখতে হবে নাকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতিও—আমাদের পড়শি নাগরিকের মতো—একই যুক্তির কর্তব্যদায় রয়েছে, সে আলোচনাটা শুরু করা দরকার। আবার কেউ বলতে পারেন, ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’, কিন্তু কভিডের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এ যুক্তি ভ্যাকসিন র্যাশনালিটি নয়।
ভ্যাকসিন র্যা শনালিটি মূলত সমাজকে ভ্যাকসিন ক্যাপাবিলিটি বা টিকাকরণের সক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে যাবে। আর এ ভ্যাকসিন ক্যাপাবিলিটি আমাদের ভ্যাকসিন ফ্রিডম বা টিকাসংক্রান্ত স্বক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। কারণ সমাজে টিকাকরণের যুক্তি যত বেশি ন্যায়ানুগভাবে ব্যবহার হবে ততই সমাজের উন্নয়ন ঘটবে। সমাজে বিদ্যমান অসহনীয় রকমের বৈষম্য, অন্যায় ও বঞ্চনা কিছুমাত্র কমাতে সক্ষম হলে সমাজে মানুষে মানুষে বন্ধন দৃঢ় হবে। এতে আমরা আগের তুলনায় একটি গ্রহণযোগ্য সংহতিপূর্ণ সমাজ পাব। এ মহামারীর চরম সংকটে বিনা মূল্যে বিপুল হারে সবাইকে টিকাকরণের আওতায় আনা গেলে সমাজের ভ্যাকসিন ফ্রিডম বা টিকাসংক্রান্ত স্বক্ষমতা বাড়বে। আর যদি তা করতে আমরা ব্যর্থ হই, তবে সমাজে টিকাকেন্দ্রিক নতুন মেরুকরণ বা নতুন টিকাশ্রেণী সৃষ্টি হতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। করোনা-পরবর্তী বিশ্বে ভ্যাকসিন ভিসা কিংবা ভ্যাকসিন পাসপোর্টের প্রচলন হলে টিকাবঞ্চিত মানুষের স্বক্ষমতা বা ফ্রিডম আরো বেশি করে সংকুচিত হবে। সবাইকে টিকাকরণ করতে না পারলে টিকাসংক্রান্ত অধীনতা বা ভ্যাকসিন আনফ্রিডমের পরিণতি আমাদেরই বহন করতে হবে, যেটি মানুষের বিদ্যমান অধিকারের অবস্থা আরো খর্ব করবে। এতে সমাজে নয়েজও বেড়ে যাবে। সুতরাং বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভ্যাকসিন আনফ্রিডম দূর করতে হলে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ হতে হবে। সম্প্রতি ভারতে আনন্দবাজার পত্রিকায় এক সাক্ষাত্কারে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিষয়ে চিন্তার অভাব, আরেকদিকে অর্থনৈতিক, সামাজিক বিচারে সব লোকের প্রতি সমদৃষ্টির অভাব। এর একটা পরিণাম তো স্পষ্টই দেখা যায়। ভারতবর্ষ অন্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন তৈরি করে, অথচ ভ্যাকসিনের ঘাটতি আমাদের দেশে (ভারতে) প্রচণ্ড রকম।’
দেশের পরিধি পেরিয়ে আঞ্চলিক অন্যান্য দেশের মানুষের সঙ্গে কেবল যুক্তির ভিত্তিতেই আদান-প্রদান হলে যথেষ্ট হবে না। অধ্যাপক সেন বলেছেন, “ন্যায্যতার ধারণায় যে বিষয়টির ওপর খুব বড় রকমের গুরুত্ব দেয়া হয় তা হলো, অন্যদের সঙ্গে ন্যায্যতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের এবং অন্যদের সম্পর্কে যথাযথ সংবেদন পোষণ করার প্রয়োজনীয়তা। বিদ্যমান ব্যবস্থাপনাগুলোর মধ্যে কী কী অন্যায্যতা আছে সেগুলো চিহ্নিত করার কাজটিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা করতে গিয়ে আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রচলিত সীমানাটা বদলে ফেলতে হবে—এ চিন্তা থেকেই ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে হিউমের দৃঢ় অবস্থানটা গড়ে উঠেছিল (তিনি তো একবার এমনও বলেছিলেন যে ‘আমি সেই দিনটার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছি, যেদিন আমেরিকা ও ইস্ট ইন্ডিজ সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত বিদ্রোহে নেমে পড়বে’)। কিংবা এটা হয়তো হিউমের বিশ্বন্যায্যতার চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত: বিদেশের সঙ্গে যেভাবে আমাদের বাণিজ্য বিস্তার ঘটে চলেছে, তার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সংবেদন ও যুক্তি প্রয়োগকেও এ কথাটা হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে যে ‘ন্যায্যতার পরিধিটা ক্রমে বিস্তৃত হয়ে চলেছে’। ন্যায্যতা কেবল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের লোকদের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, এমন কোনো চিন্তায় আটকে থাকা চলে না।” প্রতিবেশী দেশগুলোর ভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য জানা আমাদের কেবল ন্যায্যতাই নয়, নৈতিক আচরণেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। কারণ ন্যায্যতার সীমারেখা বর্ধিত করার সঙ্গে নৈতিকতার ভিত্তি যে যুক্তিচর্চা বিবর্জিত হবে না, তা অমর্ত্য সেন বেশ জোরেশোরে মনে করিয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “প্রথমত, হিউমের সাধারণ যুক্তিটা ছিল এই যে আমরা কী জানি তার ওপর ন্যায্যতার অনুধাবন নির্ভর করে, অর্থাত্ নৈতিকতার ধারণা জ্ঞানতত্ত্ব-নিরপেক্ষ হতে পারে না, তাকে জ্ঞানতত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। আমাদের ব্যবহূত উদ্ধৃতিটি হিউমের এই সাধারণ যুক্তিটার সঙ্গে ভলোভাবে খাপ খায়। যখন বৈশ্বিক যোগাযোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ‘ন্যায্যতার প্রতি উত্তরোত্তর আমাদের শ্রদ্ধা বেড়ে চলে’, তখন এ দিকটিকে আমরা হিউমের দৃষ্টির সঙ্গে যুক্তভাবে দেখতে পাই: পরস্পর সম্পর্কে এবং বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের যে জানা, নৈতিকতাকে তার থেকে আলাদা, স্বাধীন একটি ক্ষেত্র হিসেবে দেখা চলে না। যদি আমরা কোনো একটি জনগোষ্ঠী সম্পর্কে কিছুই বা প্রায় কিছুই না জানি, তবে তাদের প্রয়োজন, স্বত্বাধিকার ও স্বক্ষমতা নিয়ে কোনো কিছুই বলতে পারব না। অন্যদিকে তাদের সঙ্গে সংযোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবন সম্পর্কে আমাদের বোধও বাড়বে। সেই কারণে অন্যদের জীবনের ব্যাপারে মনোযোগ দেয়ার কারণ আছে।”
আমরা যখন প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্কে আরো তথ্য ও জ্ঞানের দিকে অগ্রসর হব তখন যেকোনো অসম্পূর্ণতা যে ন্যায্যতা ও যুক্তিচর্চার ক্ষেত্রে বাধা নয় বা এতে আমাদের হীনম্মন্যতার কোনো কারণ নেই, সেদিকটি নিয়ে অমর্ত্য সেন আলোচনা করেছেন বেশ জোরের সঙ্গেই। অধ্যাপক সেন বলেন, ‘যুক্তি তখনই কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে যখন নাকি তার দ্বারা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ-সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান করা যাবে—এ পূর্বধারণা সমকালীন সিদ্ধান্ত তত্ত্ব (ডিসিশন থিওরি) ও যুক্তিশীল-চয়নতত্ত্বের (থিওরি অব র্যাশনাল চয়েস) বিরাট ক্ষতি করেছে। বস্তুত, মানব যুক্তি প্রয়োগের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পৃথিবী সম্পর্কে সুবিন্যস্ত তথ্যের যে অসম্পূর্ণতা আছে তার অনুধাবন। একইভাবে আমাদের কাছে কর্মপ্রণালির বিভিন্ন বিকল্প থাকে। তাদের একটি স্পষ্ট—অসম্পূর্ণ হলেও—ক্রমতালিকা তৈরি করার ব্যাপারটাও এ যুক্তি প্রয়োগের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। আধুনিক সামাজিক চয়নতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আংশিক সমাধানের ওপর নির্ভর করতে শেখার মতো বড় একটি ব্যাপার। এ দিকটায় হিউমীয় চিন্তার সুস্পষ্ট প্রভাব আছে। যুক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের সামনে থাকা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারব, তবেই তার কার্যকারিতা প্রমাণ হবে—এমন নয়।’
হবস কেন ন্যায্যতাকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিধির ভেতর ভেবেছেন? হবসের ন্যায্যতাকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভেতর ভাবার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, ন্যায্যতা সম্পর্কে ধারণাটিকে সম্পূর্ণ বা যথার্থ হতে হবে—সব অন্যায্যতাকে দূর করতে না পারলে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যাবে না। যেহেতু পৃথিবীতে অনেক রাষ্ট্র রয়েছে, তাই তার হয়তো মনে হয়েছিল বিশ্বের সর্বত্র ন্যায্যতার কথা বললে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা আওতার বাইরে চলে যাবে। ন্যায্যতা সম্পর্কে এ রকম ইউটোপীয় প্রকল্পের কোনো মানে হয় না। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন হবসের চিন্তার সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে বলেছেন, ‘হবসের বক্তব্য, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র ছাড়া ন্যায্যতা সম্পর্কে সুসামঞ্জস্যভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। ফলে সমসাময়িক পৃথিবীতে ‘বিশ্ব ন্যায্যতা’ নিয়ে কিছু বলাটা ‘অলীক কল্পনামাত্র’। এটা অন্য একটি ধারণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত: যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো ধারণা আমাদের পরিচিত সব রকম অন্যায্যতাকে দূর করতে পারবে ততক্ষণ তাকে ন্যায্যতার ধারণা বলে মেনে নেয়া যাবে না। এই ‘হয় পুরোটা হবে, নয় কিছুই হবে না’ দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিলে দুর্ভিক্ষ ও গণহত্যা প্রতিরোধ বা নারীদের বন্দিত্ব মোচনের মধ্য দিয়ে ন্যায্যতার প্রসার ঘটানো যায় না; ন্যায্যতা তখনই বহাল হতে পারে যখন নাকি বিশ্বজুড়ে একটি কার্যকর সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তা বৈশ্বিক ন্যায্যতার জন্য যে যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনগুলো আছে সেগুলো সব মেটাবে। এ দৃষ্টিকোণটি হিউমের ‘ন্যায্যতার পরিধি’র ক্রমেই প্রশস্ত হয়ে ওঠার প্রত্যাশার বিপরীত। অথচ যেসব পরিকীর্ণ অন্যায্যতা আমাদের এ পৃথিবীকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে সেগুলো দূর করার ব্যাপারে হিউমের এ চিন্তা খুবই প্রাসঙ্গিক।’
উত্তরাধুনিকবাদী বা উত্তর উপনিবেশবাদী চিন্তাভাবনার সংকীর্ণ পথ, যেখানে মেটান্যারেটিভ বা মহাআখ্যানের বিষয়ে যেসব আলোচনা ধারা রয়েছে, সেগুলো কেন সমর্থনযোগ্য নয়, তা অমর্ত্য সেনের কথায় ফুটে উঠেছে। তার ভাষায়, “আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি, যেখানে আমাদের দৃষ্টির বৈশ্বিক প্রসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ন্যায্যতার পরিধি প্রসারিত করা, নৈতিকতার চর্চায় জ্ঞানের গুরুত্ব, মানুষের যুক্তি প্রয়োগের বিবিধ রূপ পরিগ্রহসহ যেসব বিষয়ে হিউম জোর দিয়েছেন, দৃষ্টির বৈশ্বিক প্রসারণে সেগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। হিউমের সময়কার পৃথিবী এখনকার তুলনায় অনেক কম সংহত ছিল, কিন্তু তার মধ্যেই তিনি সমস্যাটাকে যেভাবে চিহ্নিত করেছিলেন, সেদিক দিয়ে বিচার করলে একটা জিনিস স্পষ্ট ধরা পড়ে: মানুষের স্বতন্ত্র জীবনের কারণে সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্ন সীমানার মধ্যে (‘সার্বভৌম ঋণ’ বিষয়ে চিন্তা করা হোক বা না-হোক) ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কাজটা আদৌ যথেষ্ট নয়—প্রয়োজনটা এক্ষেত্রে অনেক বেশি জোরদার। তার বন্ধু অ্যাডাম স্মিথের মতোই হিউমও সমসাময়িক নৈতিক চিন্তাচেতনাকে কীভাবে প্রশস্ত করা যায় তা নিয়ে খুবই ভাবিত ছিলেন। আজও কাজটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অন্যদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান যতই বিস্তৃত হচ্ছে, ন্যায্যতার অনুধাবনটিকে প্রশস্ততর করে তোলার প্রয়োজনটিও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
বাজারনির্ভর ন্যায্য বণ্টনের ভাবনায় যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, অমর্ত্য সেন সেটি বেশ স্পষ্ট করেই দেখিয়েছেন: ‘অধিকতর ন্যায্য একটি পৃথিবীর দিকে এগোনোর চেষ্টায় আমরা হিউমের এ দিকনির্দেশ থেকে লাভবান হতে পারি। এটি কেবল বিভিন্ন রকমের সাহায্য ও সহায়তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, অর্থনীতিক প্রগতিসহ উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ভূমিকা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও এটা খাটে। বাজার অর্থ ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, তা কী কী অর্জন করতে পারে বা পারে না, সেসবের মূল্যায়নেও প্রায়োগিক অনুধাবন খুবই কাজে লাগে। বাজার কখনো মুখ থুবড়ে পড়তে পারে না—এ বিশুদ্ধ তত্ত্বটি ২০০৮-এর অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অন্তত অংশত দায়ী। বাজার প্রকৃতপক্ষে কীভাবে কাজ করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি, সে সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞানের গুরুত্ব কতখানি, তা এ ঘটনা থেকে জোরালোভাবে উঠে আসে।’
ন্যায্যতার প্রশস্ত পথে হাঁটতে রাষ্ট্রীয় সীমা অতিক্রম করা কেন জরুরি, অমর্ত্য সেন তা পরিবেশের সংকটের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন। তার মতে, “দূরের বাসিন্দাদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান যত বাড়বে ‘ন্যায্যতার পরিধি’ তত প্রসারিত হবে—হিউমের এ দিকনির্দেশক চিন্তাটির প্রভাব বর্তমান ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মের পারস্পরিক সম্পর্কে নিহিত নৈতিকতার ওপরও ভালোভাবে পড়ছে। বিশেষ করে আমাদের আজকের পরিবেশবিষয়ক আচরণ ভবিষ্যত্ পৃথিবীর মানুষদের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে, সে সম্পর্কে একটি পরিষ্কার অনুধাবনের ব্যাপারে হিউমের এ চিন্তা খুবই কার্যকর। পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে—ধরা যাক লাগামছাড়া পরমাণু শক্তির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে—ভবিষ্যত্ পৃথিবীর বাসিন্দাদের জীবন ও সমস্যা সংকুলতা সম্পর্কে আমরা যত বেশি করে জানতে পারব, জ্ঞান যত বৃদ্ধি পাবে, ‘ন্যায্যতার পরিধি’ প্রসারিত করে তোলার দাবিটাও তত বেশি জোর পাবে। নীতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে জ্ঞানতত্ত্বের গুরুত্ব আগে এত জোরালোভাবে উঠে আসেনি। এর উদাহরণ হিসেবে আমরা নিতে পারি বর্তমান ‘বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি’ এবং তার পেছনে মানুষের আচরণ কতখানি দায়ী, এ-সম্পর্কিত সাম্প্রতিক আলোচনাগুলোর কথা, যা এর আগে শোনা যেত না। সমকালীন পৃথিবীতে অর্থনীতির কার্যকারণ সূত্র থেকে পরিবেশগত অবক্ষয় পর্যন্ত ন্যায্যতা সম্পর্কিত নানা বিষয়ে প্রাসঙ্গিক জ্ঞানের অনুসন্ধান কিছুটা বিপদের মুখে পড়েছে এবং সে কারণে এ দিকটিতে জোর দেয়ার বিশেষ কারণ আছে।”
এ বিষয়ে অমর্ত্য সেন হিউমের বরাতে যুক্তিশীলতা ও সংবেদনশীলতার দৃঢ় আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তার ভাষায়, ‘হিউমের যুক্তিতে এ বোধটি কেবল বিদ্যাচর্চার একটি শাখা হিসেবে নীতিশাস্ত্রের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমাদের থেকে যারা অনেকটা দূরে বসবাস করেন তাদের সম্পর্কে ক্রমে বেশি বেশি করে জানার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের জীবন নিয়ে আরো বেশি ভাবিত হব কিনা, সেই ধারণার ওপরেও এ বোধের প্রভাব পড়ে। হিউম স্পষ্টত মনে করতেন যে মানুষের সংবেদনে অন্যদের জীবন সম্পর্কে চিন্তার প্রতিফলন ঘটবে, এটা বাস্তবিকই একটি যুক্তিসম্মত: দূরদেশের বাসিন্দাদের সম্পর্কে বেশি বেশি করে জানতে পারাটা মানুষের সংবেদনের ওপর স্বভাবতই প্রভাব ফেলবে। বস্তুত, হিউমের মতে, আমাদের চিন্তাভাবনার পরিসর বাড়ানোর ব্যাপারটা কেবল যুক্তির দাবি মেনেই ঘটে এমন নয়, আমাদের সংবেদনগুলো কিসের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, সেটাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।’ এ বিষয়ের কাছাকাছি অন্য একটি বিষয়ে হিউম বলেন, ‘যেসব জিনিস আমাদের প্রভাবিত করে সেগুলোকে আমরা অলীক কল্পনা বলে মেনে নিতে পারি না। এবং যেহেতু আমাদের সংবেদনগুলো কোনো না কোনো একটা দিকে কাজ করে, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা মনে করি যে প্রশ্নটা আমাদের বোঝার আওতার মধ্যেই আছে। এ ধরনের অন্য ব্যাপারগুলোয় আবার আমাদের নানা সংশয়ও থাকতে পারে।’ হিউমের উদ্ধৃতিটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অমর্ত্য সেন বলেন, “যুক্তি ও সংবেদনের এমন যুগল বন্ধন যে সহজেই ঘটতে পারে, এ কথাটা দুটো কারণে আমাদের মাথায় রাখা দরকার। প্রথমত, হিউমের অনেক আলোচনায় এ যুগল বন্ধনের ব্যাপারটি আসেইনি (অন্তত স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসেনি)। দ্বিতীয়ত, ‘সংক্ষেপে ডেভিড হিউম’-এর নামে যেসব ব্যাখ্যা চালু আছে সেগুলোয় প্রধানত হিউমের সেই মন্তব্যগুলোকেই তুলে ধরা হয়, যেগুলোয় তিনি নৈতিকতার ক্ষেত্রে যুক্তির ভূমিকাকে অবজ্ঞা করে সংবেদনের ভূমিকাকেই প্রধান বলে তুলে ধরছেন; কিন্তু হিউম যে এ দুটোকে পরস্পর-সম্পর্কিত হিসেবে দেখছেন সেদিকটা অনুল্লিখিত থেকে যায়।” যুক্তি কীভাবে করে এবং যুক্তি ও ভাবাবেগের বিষয়টি নিয়ে অমর্ত্য সেন বলেন, “হিউম স্পষ্টভাবে বলছেন: ‘নৈতিকতাই আবেগকে (প্যাশনস) উদ্দীপ্ত করে এবং এটিই কর্মকে সচল কিংবা নিষ্ক্রিয় করে। এই সুনির্দিষ্ট সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তি একান্ত নিজের জোরে কিছু করে উঠতে পারে না।’ আমি হিউম ‘একান্ত নিজের জোরে’ বলে যে শর্তটি রাখছেন, তার দিকে নজর দিতে বলব। হিউম এখানে এমন দাবি করছেন না যে নৈতিকতা কিংবা কর্মে উদ্দীপনার জন্য যুক্তি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার বক্তব্যটা হলো এই যে যুক্তি কেবল নিজের জোরেই এটা অর্জন করতে পারে না।” নৈতিকতা ও যুক্তিশীলতার সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী অথচ অনেকে ভাবাবেগের সঙ্গে নৈতিকতার ‘স্বাভাবিক’ সম্পর্ক হিসেবে মেনে নেন। এ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘আমাদের জীবনে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যুক্তি কতটা প্রভাবশালী হতে পারবে সেটা নির্ভর করবে মানুষের প্রকৃত ভাবাবেগ যুক্তির দ্বারা কতখানি আন্দোলিত হতে পারছে তার ওপর (এ বিষয়েও হিউমের অনেক আলোচনা আছে)। যুক্তি প্রয়োগ কীভাবে কাজ করতে পারে, সেটি নির্দিষ্ট করে দেয়ার প্রেক্ষাপটে আমরা এ অনুধাবনটিকে দেখতে পারি। নৈতিকতায় যুক্তির যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, নির্দিষ্টকরণের কাজ বা প্রক্রিয়া তাকে খাটো করে না এবং আমরা আসলে কতটা জানি, আমাদের প্রকৃত সংবেদনগুলো (সেন্টিমেন্টস) কী কী কিংবা বিশ্লেষণভিত্তিক নিরীক্ষার পর সেগুলো কী রূপ নিতে পারে ইত্যাদি ব্যাপারে যুক্তিভিত্তিক মতপ্রকাশের ভূমিকাকেও অস্বীকার করে না।’
যুক্তিচর্চা যে কেবল কাঠখোট্টা শুষ্ক জমি নয়, সেকথা তিনি হিউমের বরাত দিয়ে বেশ গুরুত্বসহকারে আলোচনা করেছেন অমর্ত্য সেন—যে বিষয়ে আমাদের সামাজিক পরিসরে চর্চার বেশ ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘যেখানেই বিবেচনাপ্রসূতভাবে কাজে লাগানো সম্ভব, সেসব ক্ষেত্রেই হিউম জোরের সঙ্গে যুক্তিকে ব্যবহার করেছেন। তার জীবনের সব কাজ যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণের এক সমৃদ্ধ ছবি। এটা ঠিকই, হিউম এ ব্যাপারে তার হতাশা লুকিয়ে রাখেননি যে ‘নিজেদের এবং আত্মীয়স্বজনের জন্য ধনসম্পদ আহরণের লিপ্সা’ হয়তোবা ‘অন্তহীন, চিরকালীন, সর্বজনীন এবং সমাজের পক্ষে সরাসরি ধ্বংসাত্মক’ প্রতিপন্ন হতে পারে। আবার ন্যায্যতাবিষয়ক চিন্তার ক্ষেত্রেও মানুষ যে প্রায়ই আত্মস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়, সে ব্যাপারেও তার হতাশার সীমা ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি জোর দিয়েই বলছেন যে যুক্তির সাহায্যে মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারলে সমাজে ‘পরিমিতিবোধ ও মিতাচার’ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতে পারে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলছেন, যেমনভাবে ‘লোকে নৌকার দাঁড় টানে একটা সাধারণ স্বার্থে, সাধারণ রীতি মেনে, সেখানে কোনো প্রতিশ্রুতি বা চুক্তির দরকার পড়ে না’, তেমনি লোকেদের ভেতর ন্যায্যতাবোধ গড়ে ওঠে ‘সাহচর্য ও কথোপকথন’ থেকে। পারস্পরিক সাহচর্যের মধ্য দিয়ে মানুষের ব্যবহারিক যুক্তি প্রয়োগ বাড়িয়ে তোলার প্রবল স্বীকৃতি মেলে হিউমের প্রায় ২০০ বছর পর লেখা আন্তনিও গ্রামশির ল’অরডিনে ন্যুভো (L’Ordine Nuovo) প্রবন্ধে। মোদ্দাকথা হলো, সাহচর্যের মধ্য দিয়ে মানুষের যুক্তি প্রয়োগের স্বীকৃতি যুক্তি প্রয়োগের ভূমিকাকে খাটো করে দিচ্ছে না, বরং কীভাবে যুক্তি প্রয়োগ কাজ করে সেটা বুঝতে সাহায্য করছে।”
বাংলাদেশ একটি নতুন জগতে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে অর্ধশতাব্দী পূর্ণ করেছে। আজ বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সামনে একটি নতুন ভবিষ্যত্ দেখা দিচ্ছে। এ ভবিষ্যতের দিশারি হতে পারে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে যেসব পুরনো ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, সেখান থেকে তাদের মুক্ত করতে না পারলে ন্যায্য ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের নির্মাণ সম্ভব নয়। এই নবতর যাত্রার ভিত্তি কী হবে তার জন্য বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সামাজিক যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে লক্ষ্য নির্ধারণ করা দরকার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধান পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ শহীদরা নিজেদের জীবন উত্সর্গের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের স্থায়ী ক্ষেত্র তৈরি করে গেছেন। তার ফলই আমাদের এ জায়গায় নিয়ে এসেছে। এ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই উল্লিখিত আলোচনার আলোকে আমাদের সৃজনশীলতার ও নতুন জ্ঞানগত কাঠামোর প্রয়োজন পড়বে।
আহমেদ জাভেদ: দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি