দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের সেবার মান নিয়ে গ্রাহক অসন্তুষ্টির অভিযোগ বেশ পুরনো। গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে অপারেটরদের সেবার মান ক্রমেই কমছে। বৈশ্বিক মোবাইল কানেক্টিভিটি নিয়ে ওপেন সিগনালের করা এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবার এ দৈন্যদশা উঠে এসেছে। গ্রাহক সংখ্যায় শীর্ষ দুই প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন ও রবি সেবার দিক দিয়ে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে গ্রাহক সংখ্যায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রবি আজিয়াটা সেবাসংশ্লিষ্ট অধিকাংশ সূচকেই পিছিয়ে রয়েছে।
মোবাইল সেবার সার্বিক অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনও (বিটিআরসি)। বর্তমানে সেবার মান বৃদ্ধি নিয়ে কমিশনের দুটি কমিটি কাজ করছে বলে বিটিআরসি সূত্রে জানা গিয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের মোবাইল সেবার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেশের চার টেলিযোগাযোগ অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি আজিয়াটা, বাংলালিংক ও এয়ারটেলের র্যাংকিং করেছে ওপেন সিগনাল। এ নিয়ে সম্প্রতি ‘মোবাইল এক্সিপেরিয়েন্স অ্যাওয়ার্ড’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছে। চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত সময়ে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে র্যাংকিংটি করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ভিডিও, গেমস, ভয়েস অ্যাপ ও ডাউনলোড স্পিডের অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে বাংলালিংক। এছাড়া আপলোড স্পিডের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি গ্রামীণফোনের সঙ্গে যুগ্মভাবে শীর্ষে অবস্থান করছে। ফোরজি প্রাপ্যতার ভিত্তিতে যুগ্মভাবে শীর্ষে রয়েছে গ্রামীণফোন, এয়ারটেল ও রবি। ফোরজি কাভারেজের ক্ষেত্রে অবশ্য সবার ওপরে রয়েছে গ্রামীণফোন।
এর আগে গত বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত ওপেন সিগনালের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ওই সময় ভিডিও, গেমস, ভয়েস অ্যাপ, ডাউনলোড স্পিড ও আপলোড স্পিডের অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে শীর্ষে ছিল বাংলালিংক। ফোরজি প্রাপ্যতার ভিত্তিতে যুগ্মভাবে শীর্ষে ছিল গ্রামীণফোন ও এয়ারটেল। এছাড়া ফোরজি কাভারেজ হিসেবে শীর্ষে ছিল গ্রামীণফোন।
এ বছরের জুলাই শেষে দেশে মোট মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ৬৯ লাখে। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ৮ কোটি ২৪ লাখ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রবি আজিয়াটার গ্রাহক সংখ্যা ৫ কোটি ১৮ লাখ। বাংলালিংকের গ্রাহক সংখ্যা ৩ কোটি ৬৫ লাখ আর রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটকের গ্রাহক রয়েছে ৬০ লাখ ৯০ হাজার। গ্রাহক সংখ্যায় শীর্ষ দুই টেলিযোগাযোগ অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে রবি গত বছর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে।
ওপেন সিগনালের র্যাংকিংয়ে আগের বছর ভিডিও সেবার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে শীর্ষে থাকা বাংলালিংক এবার ১০০-এর মধ্যে ৫৬ দশমিক ৭ পয়েন্ট পেয়েছে। গত বছর এ ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৫৩ দশমিক ৮। দ্বিতীয় স্থানে থাকা এয়ারটেলের পয়েন্ট ৫১ দশমিক ৪। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৪৯ দশমিক ৯। ৪৮ দশমিক ৩ পয়েন্টের ভিত্তিতে গ্রামীণফোন এবার তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৫২ দশমিক ১। চতুর্থ অবস্থানে থাকা রবি এবার ৪৬ দশমিক ৩ পয়েন্ট পেয়েছে। গতবার প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৪৮ দশমিক ১।
গেমস সেবার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এবার র্যাংকিংয়ে ৩৮ দশমিক ৫ পয়েন্টের ভিত্তিতে শীর্ষে রয়েছে বাংলালিংক। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৩৮ দশমিক ৬। ৩৬ দশমিক ১ পয়েন্টের ভিত্তিতে এ বছর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এয়ারটেল। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৩৭ দশমিক ২। গেমস সেবার ক্ষেত্রে চলতি বছর রবি ৩৫ দশমিক ৭ পয়েন্টের ভিত্তিতে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৩৬ দশমিক ২। চতুর্থ স্থানে থাকা গ্রামীণফোনের এবারের অর্জিত পয়েন্ট ৩৫ দশমিক ৩। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৩৫ দশমিক ২।
ভয়েস অ্যাপ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এ বছর র্যাংকিংয়ে ৭০ দশমিক ৮ পয়েন্টের ভিত্তিতে শীর্ষে রয়েছে বাংলালিংক। যেখানে গত বছর প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৭২ দশমিক ১। এ ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এয়ারটেল। প্রতিষ্ঠানটির এবারের পয়েন্ট ৬৭ দশমিক ৫। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৬৮ দশমিক ৪। গ্রামীণফোন ৬৫ দশমিক ৩ পয়েন্টের ভিত্তিতে ভয়েস অ্যাপ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ের র্যাংকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৬৩ দশমিক ৯। চতুর্থ স্থানে থাকা রবির পয়েন্ট হচ্ছে ৬৪ দশমিক ৯। গত বছরের জুলাই শেষে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৬৮ দশমিক ৪।
গেমস সেবার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এ বছরের র্যাংকিংয়ে ৩৮ দশমিক ৫ পয়েন্টের ভিত্তিতে শীর্ষে রয়েছে বাংলালিংক। গত বছর এ ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৩৮ দশমিক ৬। ৩৬ দশমিক ১ পয়েন্টের ভিত্তিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এয়ারটেল। গত বছরের জুলাইয়ের র্যাংকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৩৭ দশমিক ২। গেমস সেবার ক্ষেত্রে এবার ৩৫ দশমিক ৭ পয়েন্টের ভিত্তিতে তৃতীয় স্থানে রয়েছে রবি। গত বছরের র্যাংকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৩৬ দশমিক ২। চতুর্থ স্থানে থাকা গ্রামীণফোনের পয়েন্ট হচ্ছে ৩৫ দশমিক ৩। গত বছরের জুলাই শেষে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৩৫ দশমিক ২।
ডাউনলোড সেবার অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে এবার ৯ দশমিক ৭ পয়েন্ট নিয়ে সবার ওপরে রয়েছে বাংলালিংক। গত বছরের জুলাইয়ের র্যাংকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৮ দশমিক ২। এ ক্যাটাগরিতে ৭ দশমিক ৪ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গ্রামীণফোন। গত বছরের জুলাইয়ের র্যাংকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৭ দশমিক ১। ৭ দশমিক ২ পয়েন্টের ভিত্তিতে এ ক্যাটাগরিতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এয়ারটেল। যেখানে গত বছর প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৬ পয়েন্ট ৫। এ ক্যাটাগরিতে সবার শেষে থাকা রবির পয়েন্ট হচ্ছে ৫ দশমিক ৮। যেখানে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৬ দশমিক ৪।
আপলোড স্পিড অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এবার র্যাংকিংয়ে ৩ দশমিক ৪ পয়েন্টের ভিত্তিতে শীর্ষে রয়েছে বাংলালিংক। গত বছরের জুলাইয়ে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ২ দশমিক ৯। ৩ দশমিক ৩ পয়েন্টের ভিত্তিতে এ ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে গ্রামীণফোন। গত বছরের জুলাইয়ের র্যাংকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ২ দশমিক ৭। আপলোড স্পিডের ক্ষেত্রে বাংলালিংক ও গ্রামীণফোন যুগ্মভাবে শীর্ষে অবস্থান করছে। এক্ষেত্রে এ বছর এয়ারটেল ৩ পয়েন্ট পেয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ের র্যাংকিংয়ে এ ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ২ দশমিক ৫। একই ক্যাটাগরিতে রবির পয়েন্ট হচ্ছে ২ দশমিক ৮। গত বছরের জুলাই শেষে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ২ দশমিক ৫।
ফোরজি প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে এবারের র্যাংকিংয়ে ৮০ দশমিক ৬ পয়েন্ট পেয়েছে এয়ারটেল। গত বছরের জুলাইয়ে এ ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৮১ দশমিক ১। এ ক্যাটাগরিতে ৭৯ দশমিক ৮ পয়েন্ট অর্জন করেছে রবি। গতবার প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৭৮ দশমিক ৬। ফোরজি প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে এবার গ্রামীণফোনের অর্জিত পয়েন্ট ৭৮ দশমিক ৯। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৮০ দশমিক ৩। ফোরজির প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে যুগ্মভাবে শীর্ষে রয়েছে গ্রামীণফোন, এয়ারটেল ও রবি। এ ক্যাটাগরিতে থাকা বাংলালিংকের পয়েন্ট ৭৫ দশমিক ২। গত বছরের জুলাই শেষে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৭৫ দশমিক ৭।
ফোরজি কাভারেজের দিক দিয়ে ৭ দশমিক ২ পয়েন্ট নিয়ে এবারের র্যাংকিংয়ে সবার ওপরে রয়েছে গ্রামীণফোন। গত বছরের জুলাইয়ের র্যাংকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৬ দশমিক ১। এ ক্যাটাগরিতে ৬ দশমিক ৬ পয়েন্ট পেয়েছে রবি। গতবারের র্যাংকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৫ দশমিক ৮। ফোরজি কাভারেজের ক্ষেত্রে ৬ দশমিক ৬ পয়েন্ট পেয়েছে এয়ারটেল। গতবার প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৫ পয়েন্ট ৮। এ ক্যাটাগরিতে বাংলালিংকের পয়েন্ট হচ্ছে ৪ দশমিক ২। গতবার প্রতিষ্ঠানটির পয়েন্ট ছিল ৩ দশমিক ১।
মোবাইল অপারেটরদের সেবা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের অন্ত নেই। গত দুই বছরে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে বিটিআরসির কাছে সাড়ে ৪২ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে সেবার মানে অসন্তুষ্টি নিয়ে অভিযোগ এসেছে ২৫ হাজার ৯৫টি। সিম বার, এমএনপি, ডাটা স্পিড নিয়ে অভিযোগ এসেছে ১৭ হাজার ৪৯২টি। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দুই বছরে এ অভিযোগ বিটিআরসির কাছে জমা পড়েছে। দেশের মোবাইল অপারেটরদের বিভিন্ন ধরনের সেবা নিয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মোবাইল সেবার মান পর্যবেক্ষণ ও অপারেটরদের কার্যক্রম তদারক করার জন্য মনিটরিং সিস্টেম স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বিটিআরসি। এজন্য কানাডাভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যন্ত্রপাতি কেনার চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এসব সরঞ্জাম কেনায় ৭৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় হবে।
সার্বিকভাবে দেশে মোবাইল অপারেটরদের সেবার মানের বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সেবার মান নিয়ে আমরাও অসন্তুষ্ট। তবে টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগের সুফল আসতে কিছুটা সময় লাগে। সম্প্রতি অপারেটরগুলো স্পেকট্রাম বরাদ্দ নিয়েছে। এ বিনিয়োগের সুফল গ্রাহকরা এখনই পাবেন না, কিছুটা সময় লাগবে। মোবাইল গ্রাহকেরা হটলাইন, অনলাইন কিংবা লিখিতভাবে আমাদের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। আমরা সেগুলো সমাধানের জন্য অপারেটরদের নির্দেশনা দিই। দেশে মোবাইল সেবার মানের বিষয়ে দুটি কমিটি কাজ করছে। তাদের প্রতিবেদন পাওয়ার পর সমস্যা কোথায় এবং কীভাবে সেগুলোর সমাধান করা হবে সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হবে।’
গ্রাহক সেবার বেশির ভাগ সূচকেই পিছিয়ে পড়ার কারণ জানতে রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলমের সঙ্গে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।