সাত-সতেরো

ঘৃণার কারবারি!

মো. আব্দুল হামিদ

বছর দশেক আগের কথা। আমাদের দেশে তখন অধিকাংশ ফেসবুক ব্যবহারকারী ছিল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। নতুন প্রযুক্তি হাতে পেয়ে অনেকেই ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিল, যা খুশি তা লেখার স্বাধীনতা (তখন এত নিয়মকানুনও ছিল না) অনেককে বেপরোয়া করে তুলছিল। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকের অতিব্যবহারের সম্ভাব্য কুফল ব্যাখ্যা করে বণিক বার্তায় একটা নিবন্ধ লিখলাম। ছাপা হওয়ার পরে ফেসবুকেও সেটা শেয়ার দিলাম। পাঠকেরা নিজের মতো করে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকল। খুব সম্ভবত পেশাগত পরিচয়ের কারণেই আমার পোস্টে সাধারণত কেউ আক্রমণাত্মক মন্তব্য করে না। কিন্তু সেবার ঘটল এক ব্যতিক্রম ঘটনা। 

আমার ডিপার্টমেন্টের এক ছোট ভাই, সেও নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়ওই লেখার নিচে ফেসবুকের পক্ষ নিয়ে বাজে (অশ্লীলও বটে) একটা মন্তব্য লিখল। সেটা পড়ে বেশ ধাক্কা খেলাম। ভাবলাম শক্ত এক জবাব দিই। পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করলাম। কাছের মানুষ জানতে চাইল, ওই কমেন্ট ডিলিট করে দিচ্ছি না কেন? জবাবে বললাম, ওটা রেখেছি এজন্য যে তার ছাত্রছাত্রীরা দেখুক তাদের স্যার পাবলিক প্লেসে কতটা নিকৃষ্টতম ভাষা ব্যবহার করতে পারে! কারণ ওই মন্তব্য তার ব্যক্তিত্বকেই রিপ্রেজেন্ট করে। তখন সে ফেসবুকে অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিল এবং সম্ভাব্য কুফলগুলো হজম করতে সম্ভবত খুব কষ্ট হয়েছিল!

সেদিন জাকারবার্গের এজেন্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তার কী লাভ বা অর্জন হয়েছিল তা জানি না। তবে এখনো সাক্ষাতে বা তার কোনো পোস্ট চোখে পড়া মাত্রই সেই মন্তব্যটার কথা স্মরণ হয়। বৈশিষ্ট্যগতভাবেই নেতিবাচক বিষয়গুলো আমি মাথায় নিয়ে বেড়াই না। অনেক বড় সমস্যাও বেশ দ্রুত ভুলতে পারি। তার পরও বিশেষ মুহূর্তে সেই ঘটনা স্মরণ হয়। তাহলে যারা অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখান, তাদের অবস্থা কেমন হয়? এত বছর পর ঘটনাটি সামনে আনলাম কারণে যে সেদিন তার মত প্রকাশের সুযোগের অপব্যবহার থেকে কিছুটা ঘৃণা ছাড়া অন্য কিছু অর্জন হয়েছে কি?

এবার ভাবুন তো নিত্যদিন আমরা এভাবে সোস্যাল মিডিয়ায় ঠিক কতজনকে আঘাত করছি? এখনকার প্রজন্মের অনেকেই জানে না যে মাত্র এক দশক আগে ব্লগ জিনিসটা শিক্ষিত-সচেতন মহলের কাছে কতটা আকর্ষণীয় ছিল! প্রথম দিকে শুধু পড়তাম, দারুণ সব কনটেন্ট পড়ে মুগ্ধ হতাম। ২০১০ সালে ডেনমার্কে পড়তে গিয়ে অবসর সময়ে নিজেও লিখতে শুরু করলাম। সেখানে একটা বড় গোষ্ঠী ছদ্মনামে লিখত। তবে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা ভ্রমণ কাহিনী টাইপের লেখার কারণে আমি প্রকৃত নামেই লিখতাম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই খেয়াল করলাম, সেখানে কিছু ব্লগার গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে চায়!

যেমন একটা পোস্ট লিখলাম ডেনমার্কের পুলিশ ড্রাইভারদের কাছে কেমন সৌজন্যমূলক আচরণ পেয়েছি তার ওপর। ব্যাস, তারা উঠেপড়ে লাগল এটা প্রমাণ করার জন্য যে ওই আচরণগুলো ফেইক। আরো লিখল, কিছুদিন থাকেন বুঝবেন তারা কতটা ইতর! যখন বেশকিছু উদাহরণ দিলাম যে পর্যন্ত আমার অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। তখন তারা আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু করল। অর্থাৎ আমি তাদের দালালি করছি, তাদের ইমেজ বৃদ্ধিতে কাজ করছি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত কেউ কেউ এমন উপসংহারে পৌঁছে গেল যে তারা আমাকে বৃত্তি দিয়ে নিয়ে গেছে। তাই আমি তাদের এজেন্টে পরিণত হয়েছি, বোঝেন ঠ্যালা!

অথচ আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্কলারশিপ নিয়ে তিনটি দেশে পড়ার অংশ হিসেবে সেখানে গিয়েছি তথ্যটাও তারা জানা প্রয়োজন মনে করেনি। সেদিন আমার একটা কোর্সের পরীক্ষা ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই এমন এক মন্তব্য পড়ে মেজাজ এতটাই খারাপ হলো যে তার জবাবে লম্বা এক পোস্ট লিখলাম। মনে অস্থিরতা নিয়েই পরীক্ষা দিলাম। বাসায় ফেরার পথে একা একা হাঁটছিলাম। হঠাৎ মনে হলোআচ্ছা, যাদের ওপর বিরক্ত হয়ে আমার পরীক্ষার দিনটাও মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটছে, আমি তো তাদের চিনিও না, জানিও না। তাছাড়া আমার তথ্য যুক্তিগুলো সেই মানুষগুলো গ্রহণ বা বর্জনে আমার কিছু যায়-আসে না! তাহলে আমি কার ওপর রাগ করে নিজের ক্ষতি করছি?

তার চেয়ে বড় কথা হলো, তারা যুক্তি শুনতে চায় না। বরং তারা যেটা বিশ্বাস করে, সেটা আমার ওপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে! তাহলে আমি অযথা কেন তাদের কনভিন্স করার জন্য এতটা মনোযোগ সময় নষ্ট করছি? বাসায় পৌঁছতে প্রায় তিন কিলোমিটার হাঁটতে হতো। পথিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিলামএই পণ্ডশ্রম আর না। সেদিন রুমে ফিরে ব্লগের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিলাম। তারপর আর কখনো ব্লগে লেখা তো দূরের কথা, পড়তেও ঢুকিনি। কারণ কেন যেন আমার মনে হয়েছিল, সেখানে সুন্দর-মননশীল চর্চাকারীদের তুলনায় ঘৃণা ছড়ানো গোষ্ঠী অনেক বেশি সক্রিয় সংঘবদ্ধ। পরবর্তীকালে ব্লগ-ব্লগার-অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ইস্যুতে দেশে অনেক কিছু হয়েছে, তা কমবেশি সবাই জানি।

ইদানীং ফেসবুক ইউটিউবে কেন যেন সেই ধারার পদধ্বনি শুনছি। মত প্রকাশের সুযোগকে সুন্দর গঠনমূলক কাজে ব্যবহারের পরিবর্তে অন্যদের ওপর আক্রমণ অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ ব্যাপকভাবে বাড়ছে। এমনকি অসংখ্য ফেক অ্যাকাউন্টধারীকে অনেকে স্থায়ী শত্রুতে পরিণত করছে। অথচ যে তরুণ দিনে এমন অসংখ্য অচেনা-অজানা প্রতিপক্ষকে ল্যাং মারতে তার মেধা-শ্রম-সময় বিনিয়োগ করছে, তার মাধ্যমে নিজের অর্জনটা কীতা মোটেই স্পষ্ট নয়। শোনা যায়, কিছু লোক নাকি এসব করেই পেট চালায়। তাদের কথা আলাদা। পেটের দায়ে জগতে মানুষ অনেক কিছুই করে। কিন্তু যারা বিনা পারিশ্রমিকে, কোনো কিছুর প্রত্যাশা ছাড়াই রকম একেক পক্ষের লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করছে, তারা আসলে কী অর্জন করতে চায়?

ইন্টারনেটের মতো শক্তিশালী প্রযুক্তির ব্যবহার করে কীভাবে অন্যদের তুলনায় নিজেকে এগিয়ে নেয়া যায়, তা নিয়ে ভাবা দরকার ছিল। কিন্তু রাজপথের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের কালচার ভার্চুয়াল জগতে আমদানি ব্যাপকভাবে তার বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। বিষয়গুলো আমার সাম্প্রতিক বই মস্তিষ্কের মালিকানা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। পাঠকদের প্রতিক্রিয়া বলছে, অনেক অভিভাবকও বিষয়টা নিয়ে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। হঠাৎ করে তাদের সন্তানরা যেন বড় মানুষ হয়ে যাচ্ছে। নিজেরা যা বুঝে তা দিয়ে সবাইকে বিচার করছে, নানা রকম রায়ও দিয়ে বসছে! অতি আবেগী পোস্ট লিখছে, নানা পক্ষের প্রতি তাদের আক্রমণাত্মক আচরণ ক্রমেই বাড়ছে। বিষয়টা অভিভাবকদের পীড়িত করছে কিন্তু তারা অসহায়। 

একজন শিক্ষিত যুবক নিজের বর্তমান ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পুরোপুরি উদাসীন থেকে, বিশেষ কোন পক্ষের হয়ে, অনেকের সঙ্গে শত্রুতা বাড়াচ্ছে। নিজের ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা-দীক্ষা, পারিবারিক এতিহ্যের কথা ভুলে যাচ্ছে। মা-বাবা বোঝাতে গেলে তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করছে। নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ ভাবছে। অথচ তারা জানে না, সত্যিকার জ্ঞানী ব্যক্তি নিজেকে কখনই পণ্ডিত মনে করে না। নিজেকে অনেক জ্ঞানী মনে করা কাণ্ডজ্ঞান পোক্ত না হওয়ার লক্ষণ কথাটা তাদের কে বোঝাবে? চারপাশের সবাই তার সীমাবদ্ধতাগুলো জানে কিন্তু কেউ কিছু বলে নাকারণ নোংরা জিনিস কেউ ঘাঁটাতে চায় না!

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় অনেকের পোস্ট, কমেন্ট, পাল্টা কমেন্ট দেখে মনে হচ্ছে সেই ব্লগের যুগেই বুঝি ফিরে গেছি। এমনকি ব্যক্তিজীবনে ধর্মকর্ম পালনকারীদের অনেকেই পাবলিক প্লেসে মন্তব্য করতে গিয়ে সীমা অতিক্রম করছেন। সুমহান ধর্মের এমন প্রচার সত্যিই কি কল্যাণ বয়ে আনতে পারে? সবচেয়ে বড় কথা হলো, যাদের বোঝানোর জন্য আপনি নিজেকে নিচে নামাচ্ছেন, তারা তো বুঝতে চায় না! জেগে জেগে ঘুমানো মানুষকে আপনি জাগাবেন কীভাবে? বরং এর মাধ্যমে তারা যা চায়, সেটা অর্জনে আপনি সাহায্য করছেন। নিজেকে পরিচিতজনদের কাছে সস্তা হাস্যকর মানুষে পরিণত করছেন।

সারা দিন কঠোর পরিশ্রমের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটু দম ফেলার জায়গা হওয়া উচিত ছিল। পরিচিত জনেরা কে কোথায় কী করছে, কেমন আছেএকনজরে তা দেখার সুযোগই ফেসবুককে এতটা জনপ্রিয় করেছিল। শুরুর দিকে আমরা তেমন সেবাই পেতাম। কিন্তু ব্যবসায়ীরা ক্রমেই এটার ওপর নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় এরই মধ্যে ফেসবুক অনেকটা পানসে হয়ে গেছে। তার ওপর এমন কাদা ছোড়াছুড়ির মাধ্যমে পরিবেশটা বিষময় করে তুলছে। ফেসবুক খুব সম্ভবত অল্প দিনেই ব্লগের পরিণতি বরণ করবে; নইলে ভাঙা হাটের অবস্থা হবে। কিন্তু একটা স্ট্যাটাস বা কমেন্টের মাধ্যমে আপনি যাদের মনে কষ্ট দিচ্ছেন, তারা ভুলবে কি? নিজের মেধা-শ্রম-সময় ব্যয় করে এত ঘৃণা ক্রয় করা খুব কি দরকার?

প্রতিনিয়ত চেনাজানা মানুষগুলোর করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর পাচ্ছি। অনেকের হাসপাতালের বেডে নাকে-মুখে নল লাগানো ছবি দেখছি। অসংখ্য প্রিয়মুখ এরই মধ্যে আমরা হারিয়েছি। আগে বয়স্করা আক্রান্ত বেশি হলেও এখন তরুণ এমনকি শিশুদের আক্রান্তের হার বাড়ছে। মুরব্বিদের (অন্যান্য কারণেও) মৃত্যুর হার আগের তুলনায় বেড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। চারপাশের এত কষ্ট দেখে মাঝে মাঝে প্রকৃতিও বুঝি বড় বিষণ্ন হয়ে উঠছে।

অথচ আমরা সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে মেতে আছি পারস্পরিক আক্রমণ-প্রতি আক্রমণে! ঘৃণার চাষবাস তাকে জাগরূক রাখা আমাদের পরম কর্তব্য ভাবছি। কথা মাথায় আসছে না যে ফেসবুকে প্রতিদিন দেখা অসংখ্য মৃত্যুর খবরের তালিকায় আমার নামটিও যুক্ত হতে কতক্ষণ? তাছাড়া যারা ঘৃৃণার কারবারি, তারা কী ভেবে, কোন ঘুঁটি, কখন চাল দেয়, তা ধরার মুরোদ থাকলে অন্যের লাঠিয়াল না হয়ে আমরা নিজের কাজে মনোযোগী হতাম। তাই অন্যদের স্বনিয়োজিত প্রতিনিধি হয়ে লম্পঝম্প কম করি, তাতে আখেরে নিজেরই কল্যাণ!

 

মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক একটা কিছু করো, প্লিজ... বইয়ের লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন