অকার্যকর হওয়ার পথে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ৪৩% গভীর নলকূপ

উৎপাদন বাড়াতে যন্ত্র ও অবকাঠামো সংস্কার করা হোক

রাজশাহী রংপুর বিভাগে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫ হাজার ৫১৭টি গভীর নলকূপের একটি বড় অংশের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছর পেরিয়েছে। সংস্কার ছাড়া এসব নলকূপের প্রায় ৪৩ শতাংশের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গভীর নলকূপের জীবনকাল অতিক্রম করায় নলকূপ নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে পানির সঙ্গে বালি পাথর নির্গত হচ্ছে। নলকূপের পাম্প হাউজগুলো দীর্ঘদিন মেরামত সংস্কার না করার কারণে ঘরের দেয়াল, ছাদ বিম ভেঙে পড়ছে। এছাড়া পাম্প ট্রান্সফরমার অনেক পুরনো হয়ে যাওয়ায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে সেচ কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। যদিও গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করায় আলোচ্য অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট গভীর নলকূপ তাই অনেক সময়ই কাজ করছে না। এক্ষেত্রে সেচের বিকল্প ব্যবস্থা করা জরুরি। যতদিন পর্যন্ত সেচের পানির বিকল্প ব্যবস্থা না হচ্ছে ততদিন গভীর নলকূপগুলো যাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় ব্যবহার করা যায়, তার জন্য সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোর দ্রুত সংস্কার করা দরকার। নইলে আলোচ্য অঞ্চলে ফসল উৎপাদনে প্রভাব পড়বে, যা দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। সরকার দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিনিয়ত নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের মাধ্যমে ধান চাষের জন্য বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলিত হচ্ছে। উদ্দেশ্য একটিই, ধান উৎপাদন বৃদ্ধি করা। তাই অঞ্চলের কৃষকদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে সেচনির্ভর বোরো ধানবীজ। ধানবীজে যেমন রাসায়নিক সার কীটনাশকের প্রয়োজন হয়, তেমনিভাবে বেশি প্রয়োজন হয় সেচের পানি, যা মাটির নিচের পানি উত্তোলন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কেননা কম বৃষ্টিপাত, নদী, পুকুর, জলাশয়ে জলশূন্যতা, খরার প্রকোপ এমনিতেই এলাকায় মাটির উপরিভাগে পানি প্রাপ্যতা কম। তাই বেশি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য মাটির নিচের পানি উত্তোলন করতে হচ্ছে। গবেষকদের মতে, এভাবে যদি বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থের পানির ব্যবহার চলতে থাকে তাহলে হয়তো আর ১০-১৫ বছর পর পানি পাওয়া যাবে না। প্রতি বছর বৃষ্টির পানি যে হারে জমা হয়, তার চেয়ে গভীর নলকূপের সাহায্যে বেশি পানি তুলে নিলে ভূগর্ভস্থ পানির অভাব দেখা দেয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি রক্ষা করতে হলে পানি কম প্রয়োজন হয় এমন ধরনের খাদ্যশস্য আবাদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

২০১৩ সালের পর থেকেই অঞ্চলে গভীর নলকূপ বসানোর অনুমোদন দিচ্ছে না কৃষি মন্ত্রণালয়। আবার সেচের কাজে ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারের সুযোগও যথেষ্ট পরিমাণে সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো চাষ কমছে বলে খবর মিলছে। এক্ষেত্রে সরকারি পরিকল্পনা জানা আবশ্যক। কর্তৃপক্ষ যদি সংশ্লিষ্ট এলাকায় গভীর নলকূপ বন্ধ করে দিতে চায়, তাহলে সেচের বিকল্প ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। নইলে দেশের খাদ্যের জোগানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরই মধ্যে বৃষ্টির পানি ধরে রাখাসহ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। কিন্তু এর ফলাফল এখনো অজানা। এতে ধান বা ফসলের আবাদ কতটুকু বাড়ানো যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশেই আবহাওয়া, জলবায়ু, পানির প্রাপ্যতা প্রভৃতি বিবেচনায় নিয়ে ফসল আবাদে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে। আমাদের এখানেও ফসল উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য সুপেয় পানি অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড যে কৃষি, তার মূল উৎস পানি। পানি ছাড়া কোনো ফসল হয় না বললে চলে। মিঠা পানি দিয়েই কৃষক চাষাবাদ করছেন। অপরিকল্পিত ব্যবহার এবং অপব্যবহার পানির গুণগত মান দ্রুত কমিয়ে দিচ্ছে। এটিও দুশ্চিন্তার কারণ বৈকি।

বলাই বাহুল্য, ভূগর্ভস্থ পানি সংকটের কারণে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বহু সাধারণ নলকূপ সেচের গভীর নলকূপে এখন আর পানি খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক গভীর নলকূপ বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি নতুন করে গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমতি দেয়া যাচ্ছে না। এতে খাবার পানি সংকটের পাশাপাশি কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এমনকি ভূগর্ভস্থ পানি না পাওয়ায় অনেক এলাকায় আবাদি জমি খালি ফেলে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক, যা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে দেশের জন্য স্পষ্ট হুমকি। অস্বীকার করার উপায় নেই, কেবল পান করার কারণেই পানির আরেক নাম জীবন নয়, কৃষি থেকে শিল্প উৎপাদন সবকিছুই পানির ওপর নির্ভরশীল। ফলে বিষয়টি নিয়ে হেলাফেলার সুযোগ নেই। ভূগর্ভস্থ পানি যেহেতু অফুরন্ত নয়, তাই এর ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বৃষ্টি ভূপৃষ্ঠের পানি সংরক্ষণ করে শিল্প সেচে ব্যবহার করা গেলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে বলে আশা করা যায়। ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়, এতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বা ইকোসিস্টেমে ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়। প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো, পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ার ফলে পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণের ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। মাটির নিচ থেকে অতিরিক্ত পানি তোলা চলতে থাকলে ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ে। উভয় প্রকার ঝুঁকির কথা আমাদের সবারই জানা আছে। এখন ক্ষতি রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন