বীমা শিল্পকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন

মো. কাজিম উদ্দিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। তিনি ১৯৮৭ সালে ন্যাশনাল লাইফে এন্ট্রি লেভেল থেকে কাজ শুরুর মাধ্যমে বীমা পেশায় কর্মজীবন শুরু করেন এবং সর্বশেষ ২০১৪ সাল থেকে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদেসহ সুদীর্ঘ ৩৩ বছর ন্যাশনাল লাইফের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। বীমা দিবসকে সামনে রেখে বণিক বার্তার এক সাক্ষাত্কারে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন হুমায়ুন কবির

করোনার চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবেলা করেছেন?

করোনাকালে বিশ্ব অর্থনীতি থমকে গেছে। সারা বিশ্বে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ২৫ মার্চ থেকে সরকারিভাবে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো। পর্যায়ক্রমে সারা দেশ লকডাউনে চলে গেল। ওই সময়ে স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে ব্যাংক-বীমা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সব যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ হয়ে গেল। এমন মুহূর্তে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় ২১ জুন আমাদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা জামাল এম নাসের মৃত্যুবরণ করেন। তারপর ২২ জুন চেয়ারম্যান ও পরিচালনা বোর্ড আমাকে এত বড় একটা দায়িত্ব দেন। এ অবস্থায় আমি যখন দায়িত্ব পেলাম তখন কর্মকর্তা ও কর্মীদের মধ্যে ভীতি কাজ করছিল। আমি তখন মনোবল না হারিয়ে কাজ চালিয়ে যাই।

২০২০ সালে আমরা ১০৭৮ কোটি টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছি। ২০১৯ সালে আমরা দাবি পরিশোধ করেছিলাম ৭৩৪ কোটি টাকা। ২০২০ সালে আমি দায়িত্ব নেয়ার পর ৭৯২ কোটি টাকা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে।

আপনি দায়িত্ব নেয়ার পর প্রতিষ্ঠানের কোথায় পরিবর্তন এসেছে?

যে কোম্পানি তার গ্রাহকদের দাবি সময়মতো পরিশোধ করতে পারবে তারাই ব্যবসা এগিয়ে নিতে পারবে। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি দাবি পরিশোধ করায়। করোনার কারণে চার মাস যখন অফিস বন্ধ ছিল তখন তেমন দাবি পরিশোধ করা হয়নি। যখন আমি দায়িত্ব পেয়েছি তখন আমি কর্মকর্তা-কর্মীদের প্রতিটি পর্যায়ে বীমা দাবির চেক পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়েছি। 

নোয়াখালী লক্ষ্মীপুরের কুয়েত প্রবাসী এক গ্রাহক ২ লাখ টাকার এক বীমা পলিসি করিয়ে ১৬ হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিয়েছিল। বীমার মেয়াদ ছিল দুই বছর। বীমা করার কয়েক সপ্তাহের মাথায় তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়।

২০১৯ সালে আমাদের ফার্স্ট ইয়ার প্রিমিয়াম সংগ্রহ ছিল ৩১৭ কোটি টাকা, ২০২০ সালে আমরা ফার্স্ট ইয়ার প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছি ৩৪২ কোটি টাকা। 

বীমা দিবস উপলক্ষে আপনার ভাবনা কী?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬০ সালের ১ মার্চ আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগদান করেন। তিনি বীমা পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন সারা বাংলাদেশ ঘুরে দেখার জন্য। তখন রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার কারণে তিনি বীমা পেশাজীবীর ছদ্মবেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে তার কর্মীদের সংগঠিত করতেন। ২০২০ সালের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার বাবা বীমা পেশায় কাজ করার কারণে আমি বীমা পরিবারের একজন গর্বিত সন্তান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় গত বছর ৭৯ বীমা কোম্পানির সব কর্মী সারা দেশে জেলা ও থানাভিত্তিক জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপারকে সঙ্গে নিয়ে শোভাযাত্রা করেছে। 

বীমা খাতে সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা কতদূর?

বিগত দিনে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো ১৯৩৮ সালের আইনে বীমা অধিদপ্তরের অধীনে ছিল। সরকার ২০১০ সালে বীমা আইন তৈরি করার কারণে বীমা শিল্পে একটি শৃঙ্খলা এসেছে। এর আগে বীমা কোম্পানিগুলো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। ফলে তারা ১০০ টাকা আয় করতে গিয়ে ১২০ টাকা খরচ করে ফেলত। ২০১৪ সালের বীমা নীতি প্রণয়নের ফলে বীমা ক্ষেত্রে আরো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এসেছে। বিশেষ করে আইডিআরএ অনেক অবদান রেখেছে এ খাতে। 

মুজিব বর্ষ উপলক্ষে যেসব গ্রাহক বীমার প্রিমিয়াম যথাসময়ে পরিশোধ করেনি তাদের বিলম্ব ফি গ্রহণ করা হবে না। ১ মার্চ বীমা দিবস থেকে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পর্যন্ত এ ১৭ দিন কোনো বিলম্ব ফি ব্যতীতই আমরা তাদের প্রিমিয়াম গ্রহণ করব।

বীমা খাতের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ কী?

যে প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তি যত উন্নত সে প্রতিষ্ঠান তত এগিয়ে যাবে। আমরা ভার্চুয়াল মিটিংয়ের মাধ্যমে আমাদের কর্মীদের সব নির্দেশনা দিয়ে দেব। সরকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার উদ্যোগ হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা’, ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা’ ও যেসব শ্রমিক বিদেশে যাবে তার বীমাসহ নানা বীমা এখন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি একসঙ্গে এসব সেবা নিশ্চিত করা গেলে এ খাত আরো এগিয়ে যাবে।

আমরা যদি প্রতিটি মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক বীমা নিশ্চিত করতে পারি তাহলে দেশ আরো এগিয়ে যাবে। ২০২০ সালে করোনার আঘাত না এলে বীমা খাতে একটি বিপ্লব ঘটে যেত। তবে দেশে এখন সরকার ও বীমা কোম্পানিগুলো যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে ভালো কিছু আশা করা যায়। 

এ খাতে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব। যার আয়ের ওপর পরিবার নির্ভরশীল তার জীবন বীমা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আগে বীমা আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ ছিল না। বিশেষ করে বিভিন্ন বীমা কোম্পানির স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বীমা খাতে ইমেজ সংকটে পড়েছে। এ কারণে গ্রাহকদের মাঝে বীমা নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। 

বঙ্গবন্ধু যদি বীমা পেশায় না আসতেন তাহলে দেশের বীমা খাত এতটা এগিয়ে যেত না। তাকে সামনে রেখেই আমরা বীমার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছি। তিনি বীমা পেশায় আসার কারণেই আমরা বীমা দিবস পেয়েছি।

বীমা খাত নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?

২০২১ সাল বীমা শিল্পের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। আগামী দিনে মানুষ ব্যাংকের চেয়ে বীমা খাতের চাকরিকে বেশি প্রাধান্য দেবে। আইডিআরএ ও সরকারের প্রচেষ্টায় বীমা খাত আরো সুশৃঙ্খল হবে। আইডিআরএ যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে যেমন ব্যাংক ইন্স্যুরেন্স, বিভিন্ন স্থায়ী সম্পদের বীমা ও প্রতিবন্ধী বীমা বাধ্যতামূলক ও এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানিতে জনবল নিয়োগে ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করা প্রভৃতি উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে বীমা খাত আরো এগিয়ে যাবে। 

যে দেশ বীমা শিল্পে যত বেশি উন্নত সে দেশ তত বেশি উন্নত। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে জিডিপিতে বীমার অবদান অনেক। আশা করি আগামী দিনে দেশের ঘরে ঘরে বীমা কর্মী ও গ্রাহক তৈরি হবে।

শ্রুতলিখন: এহসান আব্দুল্লাহ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন